কোনটা এগুচ্ছে, নারীর ক্ষমতায়ন, নাকি পুরুষতান্ত্রিকতা?

আমাদের উচ্চ আদালতকে আবারও সাধুবাদ দিচ্ছি। এক সপ্তাহের মধ্যে আদালত দুটি অতি গুরত্বপূর্ণ বিষয়ে বেশ সাড়াজাগানো নির্দেশনা দিয়েছেন। দুটি বিষয়ই বাংলাদেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার, ব্যক্তির ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার বিশেষত নারীর সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কিত। নির্দেশনার সঙ্গে আদালত বেশ কিছু কড়া মন্তব্য করেছেন আমাদের দেশের নিম্ন বিচারিক আদালতের বিচারক, পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-এর ভূমিকা নিয়ে।

প্রথম নির্দেশনাটি এসেছে ১ সেপ্টেম্বর। বিষয়,চিত্রনায়িকা পরীমণির রিমান্ড হয়রানি ও প্রলম্বিত জামিন শুনানি। পরীমণি জামিন পেয়েছে এবং জেল থেকে মুক্তিও পেয়েছে। তবে উচ্চ আদালত হস্তক্ষেপ না করলে সে এখনও কারাগারে বন্দি থাকত। কারণ ঢাকা মেট্রোপলিটন সেশন আদালত তার সর্বশেষ জামিন আবেদনটির শুনানির দিন নির্ধারণ করেছিল ১৩ সেপ্টেম্বর। এর আগে পরীমণির জামিন শুনানি কেন দ্রুত শুনানির নির্দেশনা দেয়া হবে না এই বলে এক রুল জারি করেছিলেন। সেই রুলের শুনানির দিন ছিল ১ সেপ্টেম্বর।

এর সাথে আদালত বলেছেন, পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা রিমান্ড চাইলেই আসামিকে রিমান্ডে পাঠাতে হবে এমনটা কোন সভ্য দেশে চলতে পারে না। পরিস্কার বুঝতে পেরেছি পরীমণিকে একটি মাদক মামলা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিম্ন আদালতে পরপর তিনবার পুলিশের রিমান্ড আবেদনে আদালত বেশ ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। আমার কথা হলো, উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে নিম্ন আদালত শেষ পর্যন্ত জামিন শুনানি ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ৩১ আগস্ট এগিয়ে আনেন। জামিনও মঞ্জুর করেন। গল্প এখনও শেষ হয়নি। পরীমণিকে বারবার রিমান্ডে নেয়া, আবেদন ও তা গ্রহণ করার কি যৌক্তিক কারণ ছিল বা রিমান্ডে নেয়ার জন্য আদৌ কোন উপাদান ছিল কিনা তা ব্যাখা করার জন্য নিম্ন আদালতের দুই বিচারক ও এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে উচ্চ আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছে।

উচ্চ আদালতের দ্বিতীয় প্রশ্নটি এল ৫ সেপ্টেম্বর রবিবার। এর সঙ্গে ক্ষুদ্ধ মনোভাবের প্রকাশ। সম্প্রতি পরীমণিসহ বেশ কয়েকজন নারীর (জেকেজি হেলথ কেয়ারের সাবরিনা আরিফ চৌধুরী ও কলেজ ছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়া) ব্যক্তি অধিকার ক্ষুন্ন হয় এমন সব ছবি, ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এগুলো নিয়ে বেশ রসালো প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছে।

ব্যক্তির মানহানিকর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনকারী এমন ছবি, ভিডিও ও প্রতিবেদন বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে সরিয়ে ফেলার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্ট রিট করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি তাসমিয়াহ নুহিয়া আহমেদ। রিটের শুনানিতে আদালত বলেছেন, বিটিআরসি কী করে? তাদের কি প্রতিনিয়ত নির্দেশনা দিয়ে এসব বন্ধ করতে হবে, মনে হয় এতে বিটিআরসি আনন্দ অনুভব করে? দেখতে ভালো লাগে? আমরা সন্তান-সন্ততি নিয়ে থাকি না? আমাদের পরিবার আছে না? সব সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায় কেন (প্রথম আলোর সৌজন্যে) অন্যত্র আদালত বলেছেন, বিটিআরসি এসব ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ক্ষুন্নকারী আপত্তিকর বিষয়গুলো অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে সরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা আছে। আদালত এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট একটি নীতিমালাও করে দিয়েছেন।

লক্ষ্যণীয় যে, সম্প্রতি যাদের ব্যক্তিগত গোপন বিষয়গুলো ভাইরাল হয়েছে তাদের বেশিরভাগই নারী। রিটে যাদের নাম দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে কলেজ ছাত্রী মুনিয়া বাদে বাকিরা বিভিন্ন মামলার আসামি। মজার বিষয় হলো, এদের সকলেরই ব্যক্তিগত বিষয়গুলো ছিল মূলত তাদের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে। মুনিয়ার মৃত্যুর পর তার মোবাইল ফোন জব্দ করে পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা।

পরীমণিসহ অন্য আসামিদের মোবাইল ফোনও তাদের গ্রেপ্তারের পর পুলিশের হাতে। পুলিশের কাছে জব্দ থাকা সময় যদি তাদের মোবাইল ফোনে ধারণকৃত কোন ছবি, ভিডিও বা কথাবার্তা প্রকাশ্যে চলে আসে তবে তার দায় কার? নিশ্চয় এ ব্যাপারে যে প্রশ্ন তার জবাব দিতে হবে তাদেরই যারা আসামিদের মোবাইল ফোন জব্দ করেছেন। ভাইরাল হওয়ার পর এগুলো দ্রুত সরিয়ে নেয়ার কাজ যে বিটিআরসির সেটা উচ্চ আদালত সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নির্দেশনা দিয়েছেন।

এখানে মনে পড়ছে, আমাদের দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে একটি অতি বিতর্কিত ও সমালোচিত আইন আছে। আইনটি বিতর্কিত হয়েছে এ কারণে যে এটির ব্যবহার বা অপব্যবহার হচ্ছে মূলত সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে। এর অধীনে যারা মামলা করেছেন তাদের বেশিরভাগই সরকারি দলের লোক। সামাজিক মাধ্যমে ঠুনকো কোন পোস্ট যা কোন সরাকারি দলের লোক,পুলিশ বা আমলার বিরুদ্ধে কটাক্ষ বা সমালোচনামূলক মনে হচ্ছে, তাৎক্ষণিক মামলা ঠুকে দেয়া হচ্ছে। পুলিশ তা আমলে নিচ্ছে, গ্রেপ্তার করছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক থাকা অবস্থায় জামিন বঞ্চিত হয়ে কারাগারে মারা যান লেখক ও উদ্যোক্তা মোসতাক আহমেদ। এখনও বেশ কয়েকজন এই আইনের আওতায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করছেন। অথচ এই আইনের একটি মূল উদ্দেশ্য হল সামাজিক মাধ্যমে নারী যে প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন, স্কুল কলেজের অনেক মেয়েরা এই হয়রানির কারণে পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়েছে। কেউবা আত্মহত্যা করতেও বাধ্য হচ্ছে। এই জঘন্য অপরাধের জন্য যারা দায়ী তারা দিব্যি আমাদের সমাজে মুক্ত মানুষ হিসেবে ঘুরছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এদের ক’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা আমরা জানি না। এই আইনের ফলে নারীর যৌন হয়রানি ও তার বিরুদ্ধে পুরুষতান্ত্রিক যৌনতার আক্রমণ কিছুটা কমেছে বলে আমরা জানি না। একদিকে আমরা আমাদের দেশে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে গর্ব করছি, আর সেই একই সমাজ নারীকে পুরুষতান্ত্রিক মনোভঙ্গিজাত নানা হেনস্থা, অপমান ও যৌনতার জাঁতাকলে পিষ্ট করছি। ক্ষমতায়ন নাকি পুরুষতন্ত্র এগিয়ে যাচ্ছে তা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। খবর-ইউএনবি

আজকের বাজার/আখনূর রহমান