বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অন্যদের বিরুদ্ধে আনা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাটি ছিল বিদ্বেষপূর্ণ প্রতিহিংসা বশত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ সকল আসামিকে খালাস দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় ঘোষণার পর আইনজীবীরা এই প্রতিক্রিয়া জানান।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টের দেয়া সাজার রায় বাতিল করেছেন আজ আপিল বিভাগ। এই মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে খালাস দেয়া হয়েছে। এই রায়ের ফলে তারেক রহমানসহ যাদের সাজা হয়েছিল ও আপিল করতে পারেননি, তারাও খালাস পেয়েছেন।
মামলায় খালেদা জিয়াসহ তিনজনের করা আপিল মঞ্জুর করে এই রায় দেয়া হয়।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ সর্বসম্মতিক্রমে এই রায় দেন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালাসের রায়ের ফলে এই মামলার আপীলকারী ও অন্য সকল দোষীদের মর্যাদা পুনরুদ্ধার হবে, নির্দোষ পুনঃনিশ্চিত হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে হওয়া অযৌক্তিক কার্যক্রমের অবসান ঘটাবে বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
এই মামলায় সাজা দেয়ার ক্ষেত্রে আইনের কল্পিত অপপ্রয়োগের প্রকাশ পাওয়া গেছে উল্লেখ করে রায়ের পর্যবেক্ষণে সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, এই মামলার আপীলকারী ও অন্য সকল দোষীদের মর্যাদা আজকের রায়ের ফলে পুনরুদ্ধার হবে। তারা যে নির্দোষ তা পুনঃনিশ্চিত হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে হওয়া অযৌক্তিক কার্যক্রমের অবসান ঘটাবে।
রায়ের পর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, যে মামলায় কিছুই ছিলো না। সেই মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ ৫ বছর থেকে ১০ বছর করেছেন। এটা খুবই দুঃখজনক। সেই মামলার মধ্যে কোনো সারবত্তাই ছিলো না। অর্থাৎ বিচার ব্যবস্থা বলে কিছু ছিল না। ফ্যাসিস্ট সরকার যেভাবে বলতো সেভাবে রায় হতো। আজকে মনে হয়েছে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করেছে। এই প্রসিকিউশন ছিলো ম্যালিসাস। একটা বিদ্বেষমূলক প্রতিহিংসামূলক। কার বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা? পুরো জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে। সারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা। আজ আপিল মঞ্জুর করা হয়েছে নিম্ন আদালত ও হাইকোর্টের রায় বাতিল করা হয়েছে। যারা আপিল করতে পারেননি তারাও নির্দোষ প্রমাণিত হল।
আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ফুলকোর্ট থেকে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অপর অপর সব আসামী ন্যায়বিচার পেয়েছেন। তিনি বলেন, এই মামলাটা ছিল শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত জিঘাংসা, প্রতিহিংসা এবং রাজনৈতিকভাবে খালেদা জিয়া ও তার পরিবারকে খাটো করার জন্য, নিশ্চিহ্ন করার জন্য, রাজনৈতিক চিন্তা চেতনায় এই মামলাটি দায়ের করা হয়ছিল।
তিনি আরো বলেন, আজ আদালতের রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হল বেগম খালেদা জিয়া নিষ্পাপ। সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। আজকের রায়ে প্রমাণিত হয়েছে, শেখ হাসিনা তার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস এবং ফ্যাসিজমকে দীর্ঘায়িত করার জন্য খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ অপর অপর আসামীদের এইখানে অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন। সব কিছু ছিল রাজনৈতিক স্কিমের অংশ। ৫ বছরের সাজাকে ১০ বছর করা হয়।
দুদকের আইনজীবী আসিফ হাসান জানান, মোট চারটা আপিল ছিলো। চারটাই মঞ্জুর করেছেন। হাইকোর্ট ডিভিশন এবং বিচারিক আদালতের রায় বাতিল করেছেন। সাথে সাথে যারা আপিল করতে পারেননি, তাদেরকেও খালাস দিয়েছেন। যেহেতু পুরো মামলাটাই বলেছেন-ম্যালিসাস প্রসিকিউশন (বিদ্বেষপূর্ণ কার্যধারা)। তাই তারাও এই সুবিধা পেয়ে খালাস পেলেন। দুইজনের মধ্যে একজন তারেক রহমান। আরেকজন কামাল সিদ্দিকী। রায়টি দুদককে জানাবো। তারপর দুদক সিদ্ধান্ত নিবে।
আদালতে বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, ব্যারিস্টার মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল ও ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। এছাড়া বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানিতে ছিলেন এডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল, জাকির হোসেন ভূইয়া, মাকসুদ উল্লাহ, ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া প্রমুখ। এই মামলায় আরেক আপিল কারি কাজী সালিমুল হক কামালের পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী এস এম শাহজাহান।
অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ ও অনির আর হক। আর দুদকের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী মো. আসিফ হাসান।
আপিল শুনানিতে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা সর্বোচ্চ আদালতকে বলেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠনের ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া সই-স্বাক্ষর করেছেন এমন কোনো নথি প্রসিকিউশন দেখাতে পারেনি। আর টাকা কোথা থেকে এসেছে, তাও দেখাতে পারেনি। আর যে অর্থ আত্মসাৎ করার কথা বলা হয়েছে তা ব্যাংক হিসাবে রক্ষিত আছে এবং সেই টাকা সেখানে আরো অনেক বেড়েছে। এই মামলার বিচারে সংবিধান ও আইন অনুসরণ করা হয়নি। মামলাটি আইনগত, মৌখিক, এমনকি শোনা সাক্ষ্য প্রমাণহীন। সর্বোপরি অনুমান নির্ভর ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এই মামলায় বেগম খালেদা জিয়াসহ অন্যদের সাজা দেয়া হয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজা বাড়িয়ে হাইকোর্টের দেয়া ১০ বছরের সাজার বিরুদ্ধে বেগম খালেদা জিয়ার করা লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে করা আবেদন) গত ১১ নভেম্বর মঞ্জুর করে ১০ বছরের কারাদণ্ড স্থগিতের আদেশ দেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির আপিল বিভাগ বেঞ্চ।
‘শুনানিতে দুদকের আইনজীবী মো.আসিফ হাসান আদালতকে বলেছিলেন যে, ‘জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের টাকা কিন্তু আত্মসাৎ হয়নি। জাস্ট ফান্ডটা মুভ হয়েছে। তবে সুদে আসলে অ্যাকাউন্টেই টাকাটা জমা আছে। কোনো টাকাই ব্যয় হয়নি।’
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বিচারিক আদালতে এই মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার দেয়া ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় বক্তব্য তুলে ধরে সর্বোচ্চ আদালতকে বলেন, কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই রাজবন্দীর জবানবন্দির প্রতিফলন বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যে উঠে এসেছে। এছাড়া বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন তিনি এতিম তহবিল সংক্রান্ত কোনো অনুদান গ্রহণ বা বিতরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না।’
বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বকশীবাজারে কারা অধিদপ্তরের প্যারেড গ্রাউন্ডে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড দেন। একই সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমানকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত। একই বছরের ২৮ মার্চ খালেদা জিয়ার সাজা বৃদ্ধি চেয়ে দুদকের করা আবেদনে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এরপর সাজা বৃদ্ধিতে দুদকের আবেদনে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত একটি হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ খালেদা জিয়ার সাজা পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছর করেন।
এদিকে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফ করেছেন রাষ্ট্রপতি। তবে রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমার পরেও মামলা দুটি আইনগতভাবে লড়ার কথা জানিয়ে বিএনপির আইনজীবীরা বলেন, বেগম খালেদা জিয়া আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। রাষ্ট্রপতি তার সাজা মওকুফ করেছেন। তবে সেখানে ক্ষমার কথা আছে। খালেদা জিয়া ক্ষমার প্রতি বিশ্বাসী নন। তিনি অপরাধ করেননি। তিনি ক্ষমাও চাননি। তাই এটা আইনগতভাবে মোকাবিলা করবেন।
সে অনুযায়ী আইনি লড়াই চালিয়ে যান বেগম খালেদা জিয়া। (বাসস)