গর্ভধারণে ব্যর্থতা একটি কঠিন সমস্যা।আমাদের খাদ্যাভাস ও বিভিন্ন কারণে এই সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন ধরণের চেষ্টা করেও অনেকে ফল পান না। অথচ আমরা যদি একটু সচেতন হয়ে চলি তাহলে অনেংকাশেই এ সমস্যা এড়িয়ে চলা যায়। আসুন জেনে নেই গর্ভধারণে ব্যর্থতার কারণ।
সঠিক পুষ্টির অভাব
ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলসে অবস্থিত সেন্টার ফর মেইল রিপ্রোডাক্টিভ মেডিসিন অ্যান্ড ভ্যাসেক্টমি রিভার্সালের পরিচালক এবং ইউরোলজির বিশেষজ্ঞ ফিলিপ ওয়ের্থম্যান বলেন, ‘আমাদের শরীরে ফ্রি র্যাডিকেলের সঙ্গে ফাইট করার জন্য অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট সুপরিচিত। ফ্রি র্যাডিক্যাল ক্যানসার ও অন্যান্য রোগ সৃষ্টি করতে পারে, এমনকি পুরুষের বন্ধ্যাত্বও বৃদ্ধি করতে পারে। অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টের বিভিন্ন উৎস রয়েছে, কিন্তু এসবের মধ্যে শুক্রাণু স্বাস্থ্যের জন্য সর্বোত্তম হচ্ছে জিঙ্ক, ভিটামিন সি, সেলেনিয়াম, ভিটামিন ই, ফলিক অ্যাসিড ও লাইকোপিন।’ আপনি এসব সাপ্লিমেন্ট হিসেবেও গ্রহণ করতে পারেন, যা ক্ষতিগ্রস্ত শুক্রাণুর পরিমাণ কমাতে পারে। ডা. ওয়ের্থম্যান সয়া গ্রহণ হ্রাস করতেও পরামর্শ দিয়েছেন, কারণ যেসব পুরুষেরা প্রচুর পরিমাণে সয়া খায়, তারা সয়া না খাওয়া পুরুষদের তুলনায় লো স্পার্ম কাউন্টের দিকে বেশি চালিত হয়।
আপনি যথেষ্ট চেষ্টা করেননি
আমাদের মধ্যে অনেকেই তাদের প্রজনন বছরসমূহের উত্তম অংশটা প্রেগন্যান্ট হওয়ার চেষ্টা না করে কাটিয়ে দেন, সুতরাং তারা যখন শেষপর্যন্ত বাচ্চা নিতে প্রস্তুত হন তখন বিস্ময়ের সঙ্গে অনুধাবন করেন যে, গর্ভধারণ করতে সময় লাগছে বা ব্যর্থ হচ্ছেন। নিউ ইয়র্ক সিটির গ্রিনউইচ হসপিটাল অ্যান্ড এনওয়াইইউ মেডিক্যাল সেন্টারের অ্যাটেন্ডিং ফিজিশিয়ান অ্যানেট ব্রাউয়ার বলেন, ‘এমনকি ২৫ বছর বয়স্ক দম্পতিদেরও তাদের জীবনের সর্বোচ্চ উর্বরতার সময়ে প্রতিমাসে প্রেগন্যান্সির সম্ভাবনা ২০ শতাংশের কাছাকাছি। ছয় মাস শেষে এসব দম্পতিদের ৬০-৮০ শতাংশ এবং ১২ মাস শেষে ৮৫-৯০ শতাংশ দম্পতি প্রেগন্যান্সি অর্জন করে। অবশিষ্ট ১০ শতাংশ দম্পতি পরবর্তী এক থেকে দুই বছরের মধ্যে কনসিভ করার সম্ভাবনা আছে, কিন্তু ১২ মাস ভালো সহবাসের পর তাদের একজন প্রজননসংক্রান্ত এন্ডোক্রিনোলজিস্টের কাছে যাওয়া উচিত।’ যদি আপনার নিয়মিত পিরিয়ড হয় এবং কনসিভ করার জন্য সমীচীন সময় থাকে, তাহলে কনসিভ প্রচেষ্টার জন্য নিজেকে কিছু মাস সময় দিন।
*আপনার সঠিক টাইমিং হচ্ছে না
প্রকৃতপক্ষে একজন নারীর কনসিভের জন্য একটি শর্ট উইন্ডো বা ফার্টাইল উইন্ডো রয়েছে যে সময়টাতে সে উর্বর থাকে। ডা. ব্রাউয়ার বলেন, ‘ফার্টাইল উইন্ডো হচ্ছে ওভিউলেশনের আগ থেকে ওভিউলেশনের দিন পর্যন্ত ছয় দিন সময়। কনসিভ করার জন্য সর্বাধিক সম্ভাবনাময় সময় হচ্ছে, ওভিউলেশনের পূর্ব থেকে ওভিউলেশনের দিন পর্যন্ত তিন দিন সময়। যেসব নারীরা ওভিউলেশন কিট মনিটরিং করে এবং স্মাইলি ফেসের জন্য অপেক্ষা করে অথবা তাপমাত্রা পরিবর্তনের অপেক্ষায় থাকে, তাদের কনসিভের জন্য সর্বাধিক সম্ভাবনাময় সময় ফসকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’ তিনি পরামর্শ দেন, যদি আপনার নিয়মিত অনুমেয় পিরিয়ড হয়, তাহলে ওভিউলেশন কিট ব্যবহার করে নির্ণয় করার চেষ্টা করুন যে প্রতি চক্রের কোন দিনগুলোতে আপনার ওভিউলেট হয়, যদি আপনি একবার বুঝতে পারেন যে প্রতিমাসের কোন সময়ে আপনার ওভিউলেট হয়, তাহলে ওভিউলেশন পর্যন্ত কয়েকদিন টাইমিং ইন্টারকোর্স বা যৌনসহবাস করুন। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার ২৮ দিনের চক্র থাকে এবং ওভিউলেট ১৪শ দিনে হলে ১০ম, ১২শ ও ১৪শ দিনে যৌনসহবাস করুন। ডা. ব্রাউয়ার বলেন, ‘যদি আপনার পক্ষে ওভিউলেশনের সময় নির্ণয় করা সম্ভব না হয়, একজন রিপ্রোডাক্টিভ এন্ডোক্রিনোলজিস্টের শরণাপন্ন হোন যিনি আপনাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন।’
আপনি টাইমিংয়ের ওপরঅত্যধিক নির্ভরশীল
যখন আপনি কনসিভের চেষ্টা করবেন, তখন টাইমিং অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেই সঙ্গে গর্ভধারণের জন্য স্বাভাবিক পন্থা অবলম্বনের সর্বোত্তম চেষ্টা করাও গুরুত্বপূর্ণ। ক্যালিফোর্নিয়ার ফাউন্টেইন ভ্যালিতে অবস্থিত মেমোরিয়ালকেয়ার অরেঞ্জ কোস্ট মেডিক্যাল সেন্টারের রিপ্রোডাক্টিভ এন্ডোক্রিনোলজিস্ট ডেভিড ডিয়াজের মতে, টাইমিং সেক্সুয়াল কন্টাক্ট অপ্রয়োজনীয় মানসিক চাপের কারণ হতে পারে এবং শেষপর্যন্ত বৈবাহিক বিবাদ সৃষ্টি করতে পারে যখন যৌনসহবাসটা সুখানুভবের পরিবর্তে রুটিনমাফিক কাজ হয়ে দাঁড়ায়। নিয়মিত পিরিয়ড চক্রের নারীদের সাধারণত প্রথম পিরিয়ড দিন আরম্ভের পর ১২ থেকে ১৬ দিনের মধ্যে ওভিউলেট বা ডিম্বাণু উৎপাদন হয়। সন্তান উৎপাদনে রোমান্সে মাতুন এবং জন্মনিরোধক পরিহার করুন।
আপনি খুব একটা যৌনসহবাস করেন না
যদি আপনি মাসে নির্দিষ্ট কয়েকটা দিন যৌনসহবাস করেন, তাহলে কনসিভ নাও হতে পারে। প্রতিমাসে শুধুমাত্র কয়েকটা দিন থাকে যখন আপনি প্রেগন্যান্ট হতে পারেন। একজন পুরুষের শুক্রাণু কোনো নারীর মধ্যে পাঁচদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে, যার মানে হচ্ছে নারীটির প্রয়োজনীয়ভাবে ওভিউলেট না হলেও তিনি প্রেগন্যান্ট হতে পারেন। ডা. ডিয়াজ বলেন, ‘অনেক দম্পতি ধারণা করে যে, নারীর চক্রের সর্বোত্তম উর্বর দিন আসা পর্যন্ত পুরুষের শুক্রাণু জমা করে রাখা উচিত, কিন্তু বাস্তবে এর সম্পূর্ণ বিপরীতটাই সত্য হতে পারে।’ তিনি যোগ করেন, ‘যৌনসহবাসের ফ্রিকোয়েন্সি সপ্তাহে তিন থেকে চার বার হচ্ছে প্রেগন্যান্সির সম্ভাবনা বাড়ানোর সাধারণ উপায়।’
মানসিক
ফার্টিলিটি প্রিজারভেশন অ্যান্ড থার্ড পার্টি রিপ্রোডাকশনের পরিচালক এবং ফিউচার ফ্যামিলির উপদেষ্টা লিন ওয়েস্টফ্যাল বলেন, ‘স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কনসিভ প্রচেষ্টার বিভিন্ন অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিশেষ করে এটি হাইপোথ্যালামাসের রেগুলেটরি রেসপন্সকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা ওভিউলেশনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক হরমোনকে প্রভাবিত করে।’ তিনি আরো বলেন, ‘যেসব দম্পতি উচ্চমাত্রার স্ট্রেস দ্বারা প্রভাবিত হয়, তাদের যৌনকামনা হ্রাস পায়, যার ফলে তাদের যৌনসহবাস কম হয় এবং প্রেগন্যান্সির সম্ভাবনা হ্রাস পায়।’ আপনার স্ট্রেসের মাত্রা নিম্ন করার জন্য মেডিটেশন, নিয়মিত এক্সারসাইজ, আকুপাংচার, পর্যাপ্ত ঘুম এবং স্বাস্থ্যকর ডায়েট মেনে চলতে পারেন।
ধূমপান
আপনি তামাক বা মারিজুয়ানা যেটাই স্মোক করেন না কেন, এসবের প্রত্যেকটিই প্রজনন উর্বরতা হ্রাস করতে পারে। ডা. ডিয়াজ বলেন, ‘মারিজুয়ানা শুক্রাণুর তৎপরতা এবং যৌনাকাঙ্ক্ষা হ্রাস করতে পারে, যে কারণে যৌনসহবাস কমে যায় এবং মারিজুয়ানার সঙ্গে অ্যালকোহলের ব্যবহার আরো মারাত্মক সমস্যার দিকে চালিত করে। তামাকের ব্যবহার বহুবিধ দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুস, শ্বসন ও হৃদযন্ত্রের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তামাক পাতা ও সিগারেট পেপার পোড়ানোর ফলে ক্ষতিকর কেমিক্যাল বাই-প্রোডাক্ট উৎপন্ন হয়, যা ডিম্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, গর্ভনিষেকের হার হ্রাস করে এবং গর্ভপাতের হার বৃদ্ধি করে।’ প্রেগন্যান্ট হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করতে ধূমপান ছাড়ুন।
মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান
কিছু গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রচুর পরিমাণে অ্যালকোহল পানের সঙ্গে কনসিভ ব্যর্থতার সম্পর্ক আছে। ডা. ওয়ের্থম্যান বলেন, ‘এর মানে আপনাকে এটা বলা হচ্ছে না যে, আপনি পুরোপুরি ককটেল বা মদ্যপান ছেড়ে দেবেন (দৈনিক এক বা দুইটি ড্রিংক গ্রহণযোগ্য), কিন্তু অত্যধিক মদ্যপান আপনার উর্বরতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, সেই সঙ্গে সামগ্রিক স্বাস্থ্যও।’ যদি আপনি ড্রিংক করতে চান, ওয়াইন হচ্ছে সবচেয়ে স্মার্ট অপশন, কারণ এটি বিয়ার বা অন্যান্য হার্ড লিকারের তুলনায় আপনার ওজন কম বাড়াবে এবং এর সামান্য স্বাস্থ্য উপকারিতাও আছে।
অতিরিক্ত ওজন
অতিরিক্ত ওজনের সঙ্গে অনেক শারীরিক সমস্যার সম্পর্ক আছে। এর মধ্যে কনসিভ ব্যর্থতাও অন্তর্ভুক্ত। অতিরক্ত ওজনের স্থূলকায় যেসব দম্পতিরা কনসিভ করতে চান তাদের অনিয়মিত পিরিয়ড, বিরল ওভিউলেশন বা ওভিউলেশন ঘাটতি, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, প্রি-ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, যকৃতে চর্বি জমা এবং জরায়ুসংক্রান্ত স্থানে হাইপারপ্লেসিয়া থাকতে পারে। ডা. ডিয়াজ বলেন, ‘স্থূলকায় নারীদের জটিল প্রেগন্যান্সির উচ্চ ঝুঁকি ও মৃতবাচ্চা প্রসবের বর্ধিত ঝুঁকি রয়েছে।’ অবসটেট্রিক্স অ্যান্ড গাইনিকোলজিতে প্রকাশিত এক গবেষণা থেকে জানা যায়, যেসব নারীদের বিএমআই ৪০ এর চেয়ে বেশি তাদের শিশু মৃত্যহারের ঝুঁকি স্বাভাবিক ওজনের নারীদের তুলনায় বেশি ছিল। উপযুক্ত পুষ্টি গ্রহণ, এক্সারসাইজ সম্পাদন, অতিভোজন নিয়ন্ত্রণ এবং অতিভোজন প্ররোচক স্ট্রেস কমিয়ে অতিরিক্ত ওজন সমস্যার সমাধান করতে পারেন। ডা. ডিয়াজ বলেন, ‘আমরা একজন বিহেভিয়ার মডিফিকেশন স্পেশালিষ্ট নিয়োগ করেছি, যিনি আমাদের রোগীদের অতিভোজন প্ররোচক স্ট্রেস কমাতে সহায়ক সামগ্রী ব্যবহারে গাইড করতে সাহায্য করেন।’
প্রযুক্তির ব্যবহার
এটি আপনার কাছে আষাঢ়ে গল্পের মতো মনে হতে পারে, কিন্তু এর বৈজ্ঞানিক সত্যতা আছে। উচ্চ তাপমাত্রা (বিশেষ করে ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট এবং ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর) শুক্রাণু ধ্বংস করতে পারে। ডা. ওয়ের্থম্যান ক্ষতিকর তাপমাত্রা থেকে শুক্রাণুকে রক্ষা করতে কোলের ওপর ল্যাপটপ না রাখতে, হট টবে না থাকতে এবং অত্যধিক হট বাথ না নিতে উপদেশ দিচ্ছেন। একস্থানে বসার ফলে যে তাপ উৎপন্ন হয় তাতেও শুক্রাণুর ক্ষতি হতে পারে। ডা. ওয়ের্থম্যান বলেন, ‘দীর্ঘসময় এক পজিশনে অবস্থান (যেমন- ডেস্ক ওয়ার্কিংয়ের সময়) স্কোটাল টেম্পারেচার বৃদ্ধি করে। এটি আরো তীব্র হতে পারে যদি কোলে ল্যাপটপ নিয়ে বসেন, যা কেবলমাত্র অধিক তাপ উৎপাদন করে। তাই একটি ডেস্কের ওপর কম্পিউটার রাখুন এবং তাপমাত্রা কমাতে কিছুক্ষণ পরপর বসা থেকে ওঠে হাঁটুন।’
আজকের বাজার/আরজেড