গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান ‘কমিউনিটি ক্লিনিক’

সেবিকা দেবনাথ:
‘বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিক যেন পৌরাণিক ফিনিক্স পাখি। পাখিটি যতবার আগুনে ঝাঁপ দেয়, ততবারই নতুন করে বেঁচে ওঠে। তেমনি ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে তৈরি কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো বন্ধ হওয়ার পর আবার দারুণভাবে ফিরে এসেছে।’ ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ‘কমিউনিটি ক্লিনিক-হেলথ রেভল্যূশন ইন বাংলাদেশ’ বইতে বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিককে এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে।

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বিশ্বের মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রকল্প। মা ও শিশুর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে এ প্রকল্প।

জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক মার্গারেট চ্যান বাংলাদেশ সফরে এসে কমিউনিটি ক্লিনিকের উদ্যোগকে ‘বিপ্লব’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তারা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেক্টরের এই সাফল্যকে ‘রোল মডেল’ হিসেবে অনুসরণ করতে বিশ্ববাসীকে পরামর্শ দিয়েছেন।

বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি এন পারানিথারান এ প্রকল্প সম্পর্কে বলেন, ‘কমিউনিটি ক্লিনিক গোটা বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য নতুন এক ধারণা। প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি করে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের এই অনবদ্য ধারণার জনক বাংলাদেশ।’

সার্বিক প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যার আওতায় অন্তঃসত্ত্বা নারী প্রসবপূর্ব (প্রতিষেধক টিকাদানসহ) এবং প্রসবপরবর্তী (নবজাতকের সেবাসহ) সেবা প্রদানকারী কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো সময়মতো প্রতিষেধক টিকাদান যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, পোলিও, ধনুষ্টঙ্কার, হাম, হেপাটাইটিস-বি, নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়া, কুষ্ঠ, কালা-জ্বর, ডায়রিয়াসহ, অন্যান্য অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং সেগুলোর সীমিত চিকিৎসা সুবিধা দিচ্ছে। এছাড়া জ্বর, ব্যথা, কাটা/পোড়া, হাঁপানি, চর্মরোগ, ক্রিমি এবং চোখ, দাঁত ও কানের সাধারণ রোগের েেত্র লণ ভিত্তিক প্রাথমিক চিকিৎসাও দেয়া হচ্ছে। কিনিকগুলোতে অস্থায়ী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সংক্রান্ত বিভিন্ন উপকরণসহ বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হালনাগাদকৃত সর্বশেষ ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১৩ হাজার ২৩৬ টি কমিউনিটি কিনিক চালু আছে। বর্তমানে প্রতি মাসে ৮০ থেকে ৯০ লাখ মানুষ কমিউনিটি কিনিক থেকে সেবা নেন। কমিউনিটি কিনিকে নির্ধারিত ৩০ প্রকারের ওষুধ দেয়া হয়। এর মধ্যে দুটি জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী। বর্তমানে নয় শতাধিক কমিউনিটি কিনিকে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থা চালু আছে। মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবার েেত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে কমিউনিটি কিনিক। প্রতিটি কিনিকেই সরবরাহ করা হয়েছে ল্যাপটপ। কমিউনিটি কিনিক থেকে সেবা নিচ্ছেন প্রায় এক কোটি মানুষ।

জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) এক জরিপে দেখা গেছে, বাড়ির পাশের কিনিক থেকে ওষুধ আর পরামর্শ নিয়ে ৮০ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্ট।

এই পরিসংখ্যানের সত্যতা মেলে বিভিন্ন এলাকার কমিউনিটি কিনিক থেকে সেবা গ্রহীতাদের বক্তব্যে। সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার ঘুঙ্গাদিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা জাহেদা বেগম (২১), নাজমিন আক্তার (২৮), লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রপুর ইউনিয়নের উত্তর বালাপাড়া গ্রামের সালমা বেগম কমিউনিটি কিনিকের সেবা গ্রহণ করে কেবল সšুÍষ্টই নন, তারা নিয়মিত স্বাস্থ্য সেবা ও পরামর্শ গ্রহণের জন্য কমিউনিটি কিনিককেই ভরসা করেন।

ঘুঙ্গাদিয়া ইউনিয়নের ঘুঙ্গাদিয়া একাডেমির শিক দুই সন্তানের মা জাহেদা এ প্রতিবেদককে জানান, তার বড় সন্তানের বয়স আড়াই বছর। ছোটটার ছয় মাস। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ঘুঙ্গাদিয়া কমিউনিটি কিনিক থেকে দুই সন্তান গর্ভে থাকাকালীন এবং প্রসব পরবর্তী সেবা নিয়েছেন। তিনি পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য সেবার জন্যও কমিউনিটি কিনিকের ওপরই ভরসা করেন। ঘুঙ্গাদিয়ার অপর বাসিন্দা নাজমিন আক্তার তার সাত মাসের ছেলের জ্বর, ডায়রিয়ার বা যেকোন স্বাস্থ্য সেবার জন্য কমিউনিটি কিনিকে যান। তার মতে, এটা হাতের কাছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্য সেবা।

লালমনিরহাটের সালমা বেগমের বিয়ে হয়েছে দু’বছর। প্রথমবারের মত গর্ভবতী হয়ে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন পার্শ্ববর্তী উত্তর বালাপাড়া কমিউনিটি কিনিকের সাথে। সেখানে নিয়মিত চেক-আপ ও স্বাস্থ্য পরামর্শ নিতেন। ওই কমিউনিটি কিনিকেই তার নিরাপদ প্রসব হয়।

ঘুঙ্গাদিয়া কমিউনিটি কিনিকের হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার রুনা বেগম বলেন, মা ও শিশুস্বাস্থ্যসহ সকল সাধারণ রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা এখানে দেয়া হয়। মায়েদের প্রসব পূর্ব ও পরবর্তী বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া হয়। মায়েরা এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছে। শেরপুর জেলার নকলা এবং ফরিদপুর জেলার চর ভদ্রাসন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গত বছরের তথ্য অনুযায়ী, কমিউনিটি কিনিকগুলোতে সেবাগ্রহীতার দিনদিন সংখ্যা বাড়ছে।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর সারাদেশে সাড়ে ১৩ হাজার কমিউনিটি কিনিক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালে প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০১ সাল পর্যন্ত সারাদেশে ১০ হাজার ৭২৩টি কিনিক প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট মতায় আসার পর এই প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার পুনরায় মতায় আসার পর প্রকল্পটি চালু করে। ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত সময়ের জন্য ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করে প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে আসায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি উন্নয়ন (এইচপিএনএসডিপি) কর্মসূচিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে কমিউনিটি কিনিক প্রকল্প। এর মধ্য দিয়ে ‘কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার’ অপারেশনাল প্ল্যানের কার্যপরিধি ও অবকাঠামো আরও মজবুত হবে। এ উন্নয়ন কর্মসূচি আগামী ২০২১ সাল পর্যন্ত চলবে। তবে অভিযোগ উঠেছে, কমিউনিটি কিনিক প্রকল্পের ঈর্ষণীয় সাফল্য ম্লান করে দিতে একটি চক্র কাজ করছে। কিনিকের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে এবং কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডারদের (সিএইচসিপি) চাকরিও শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, কমিউনিটি কিনিকের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ বাড়ির পাশেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন। এ প্রকল্প কখনও বন্ধ হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আবিষ্কার এই ‘কমিউনিটি কিনিক প্রকল্প’।

রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে এ প্রকল্প বন্ধ করে দিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। মতায় এসে প্রকল্পটি আবার চালু করে আওয়ামী লীগ সরকার। আর এ প্রকল্পটি আজ বিশ্বে স্বাস্থ্যসেবার রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যতে কমিউনিটি কিনিকগুলোই হবে দেশের স্বাস্থ্যসেবার পরিসংখ্যানের তথ্যভান্ডার।

কমিউনিটি কিনিক প্রকল্পের সাবেক পরিচালক ও অতিরিক্তি সচিব ডা. মাখদুমা নার্গিস বলেন, কমিউনিটি কিনিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। জনগণকে সম্পৃক্ত করে যেকোনো উদ্যোগ গ্রহণ করলে তা সফল হবেই, এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই কমিউনিটি কিনিক। কমিউনিটি কিনিক এমন একটা উদ্ভাবনী শক্তি, যার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়েছে। এটা বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট অর্জন। এ অর্জন আমাদের গর্বিত করেছে।

আজকের বাজার: আরআর/ ০৭ জুন ২০১৭