মাত্র ৭০ হাজার টাকায় স্টিল স্ট্রাকচার বিল্ডিং তৈরী করছি আমরা: এইচ এম জাহিদুল ইসলাম

কনস্ট্রাকশন সেক্টরে নতুন যোগ হয়েছে স্টিল মেইড পদ্ধতি। ২০০৯ সাল থেকে শুরু হলেও সম্প্রতি এর ব্যবহার বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। এ সেক্টর নিয়ে কাজ করেন প্রকৌশলী এইচ এম জাহিদুল ইসলাম। এ এল এম স্টিল বিল্ডিং টেকনোলজির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। নতুন এ পদ্ধতি নিয়ে তিনি খোলামেলা আলোচনা করেছেন আজকের বাজার ও এবিটিভির সঙ্গে। আলোচনার মূল অংশ তারই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

স্টিল মেইড বিল্ডিং হচ্ছে কনস্ট্রাকশন সেক্টরের নতুন টেকনোলোজি। যেটার কাঠামো পুরোটাই স্টিল দিয়ে তৈরি করা হয়। বসবাসের জন্য মানুষ সব সময়ই নতুনত্ব পছন্দ ও গ্রহণ করে। আদিম যুগে মানুষের ঘরবাড়ির প্রয়োজন ছিল না। তারা গুহায় বাস করতো। এরপর আস্তে আস্তে গাছের ডালপালা দিয়ে ঘর-বাড়ি বানানো শুরু, এরপর মাটি দিয়ে, পরে টিন দিয়ে, ছন দিয়ে, এভাবে ধীরে ধীরে ইট-পাথরের দালান তৈরি হতে শুরু করলো। ইটের দালানের শুরুর দিকে কিন্তু মোটা দেয়াল ছিল। চুন সুরকি দিয়ে ইটের গাঁথুনি হতো। এরপর সিমেন্ট ও রডের ব্যবহারে দেয়াল সরু  করে রুমের ভেতর জায়গা বাড়ানো হলো। এতেও যখন চাহিদা পূরণ হচ্ছিল না তখন,স্টিল স্ট্রাকচারের আবিষ্কার হলো। এটা নিয়েই এখন এগোচ্ছে।  এটা কনস্ট্রাকশন সেক্টরের লেটেস্ট ভার্সন। এর পর লেটেস্ট আরো কিছু আসতে পারে। তা নিয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।

স্টিল বিল্ডিংয়ের সুবিধা

প্রযুক্তি খাত থেকে শুরু করে যে কোনো সেক্টরেই দেখা যায়, লেটেস্ট ভার্সন অবশ্যই কিছু নতুন নতুন সুবিধা নিয়ে আসে। তাই মানুষও সেটি গ্রহণ করে। এটিরও কিছু বিশেষ সুবিধা রয়েছে। এ সেক্টরের মূল অ্যাডভান্টেজ হচ্ছে, আরসিসি স্ট্রাকচারের চেয়ে স্টিলের স্ট্রাকচারের ওজন অনেক কম। একটা ১০ তলা বিল্ডিং আরসিসি’তে করলে যে ওজন হবে, স্টিল দিয়ে করলে ওজন অর্ধেকে নেমে আসবে। এরপর পরিবেশ দূষণ হয় না। আরসিসি দিয়ে একটা বিল্ডিং করলে দেখা যায়, ইট, বালু, রড রাস্তায় রাখা হয়। এরপর মিক্সিংয়ের সময় পুরো এলাকা দূষিত হয়। স্টিল বিল্ডিংয়ে কিন্তু পরিবেশ দূষিত হওয়ার সুযোগ নেই। এর পুরো স্ট্রাকচার তৈরি করা হয় ফ্যাক্টরিতে। এরপর যেখানে বিল্ডিংটি হবে সেখানে গিয়ে শুধু সেটিং করা হয়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ইন্ডাস্ট্রি বা ফ্যাক্টরিতে হাই ভোল্টেজের ম্যাশিন ব্যবহারের জন্য কলাম স্পেস সুবিধামতো তৈরি করা যাবে। যেটা আরসিসিতে সম্ভব হয় না।

নানাবিধ সুবিধার কারণে, মানুষ এখন স্টিল স্ট্রাকচার ব্যবহার করছে। পদ্মা  সেতু এর অন্যতম উদাহরণ। এ সেক্টরের আরেকটি সুবিধা হচ্ছে, রিসেল ভেল্যু। যতদিন ইচ্ছে ব্যবহারের পর এটি খুলে বিক্রি করা যাবে। আর আরসিসি দিয়ে বিল্ডিং করলে রিসেইল তো করা যায়ই না উল্টো বরং ভাঙতে টাকা খরচ করতে হয়।

এ সেক্টরের চ্যালেঞ্জ
এ সেক্টরে দুটি চ্যালেঞ্জ আপাতত বড় মনে হচ্ছে। প্রথমত, এ সেক্টরটি নতুন হওয়ায় দক্ষ শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও আমরা ট্রেনিং করিয়ে নিই। দ্বিতীয়ত, গভর্নমেন্ট পলিসি। আমাদের এ সেক্টর নিয়ে সরকারের চিন্তা অনেক কম। যেমন, আমরা  র-ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করি সেগুলোর ডিউটি অনেক বেশি। এসব সমস্যার সমাধান হলে  সেক্টর থেকে আরও অনেক ভালো কিছু হবে।

সরকারের প্রতি চাওয়া
এখনো পর্যন্ত আমরা ইন্ডাস্ট্রি লেভেলেই বেশি কাজ করছি।  তাই আমরা চাই এ সেক্টরটিকে শিল্পের সুবিধা দেওয়া হোক। সাংগঠনিকভাবেও অনেকবার আমাদের দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। তখন কথা দিলেও পরে এর কোনো বাস্তবায়ন হয় না কি কারণে আমার জানা নেই।

বাজেটে প্রত্যাশা
আমরা ইন্ডাস্ট্রি করার ক্ষেত্রে যে র-ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করি সেটার ডিউটি এখন ২৫ শতাংশ। এবং কাস্টমস ডিউটি, ভ্যাট-ট্যাক্স  সব মিলিয়ে প্রায় ৬১ শতাংশ ডিউটি দিতে হয়। বাজেটে আমাদের চাওয়া সিডি ভ্যাট বা কাস্টমস ডিউটি যেন ২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে আনা হয়।

স্টিল বিল্ডিংয়ের বর্তমান অবস্থা
আজ থেকে ১০/১২ বছর আগের কথা চিন্তা করলেও দেখা যায়, বাংলাদেশে যে সকল স্টিল বিল্ডিং হতো সবই ইমপোর্ট করা হতো। এখন কিন্তু ইমপোর্ট কমে গেছে। নেই বললেই চলে। আমরা শতভাগ চাহিদা মেটাতে সক্ষম। আমাদের প্রডাকশন ক্যাফাসিটি অনুযায়ি এটাও বলতে পারি, পদ্মা সেতুর জন্য বাইরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমরাই করতে পারতাম। বর্তমানে কিছু এমন কোম্পানিও রয়েছে, যারা বাইরে এক্সপোর্ট করে। আমাদের প্রোডাকশন লাইনও আন্তর্জাতিক মানের। সব মিলিয়ে প্রায় ৫ লক্ষ শ্রমিক কাজ করছে এই সেক্টরে। প্রায় ৫ হাজার পেশাদার ইঞ্জিনিয়ার রয়েছে। আমাদের এখানে কাজ করে দক্ষ হয়ে অনেকে দেশের বাইরেও যাচ্ছে।

মনিটরিং ব্যবস্থা
আর্কিটেকচার সেক্টর মনিটরিংয়ের জন্য রাজউক রয়েছে। তারা জমি নির্ধারণ ও কতটুকু জমি পাশে ছাড় দিতে হবে এ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে। এর বাইরে ইন্টারনাল যে মনিটরিং সেটা আমাদের দেশে নেই। শুধু স্টিল বিল্ডিং না। কোনো সেক্টরেই নেই। এমনকি কোনো সংস্থাও মনিটরিং করে না। সব দেশেই এই মনিটরিংটা রয়েছে। আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি এই মনিটরিংটা খুবই জরুরি।

এ এল এম স্টিল বিল্ডিংয়ের বিশেষত্ব
আমরা শুরু থেকেই চেষ্টা করছি কোয়ালিটি মেইনটেইন করতে। শুরুতে আমাদের তেমন সাপোর্ট ছিল না। এখন আমরা অত্যাধুনিক মেশিন ব্যবহার করছি।  সাফল্যের সঙ্গে বাজারে অবস্থান করছি। আমাদের অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে, আমরা কিছু নতুন টেকনোলোজি নিয়ে কাজ করি। যা অন্য কোম্পানিতে দেখা যায় না। আমরা সেলফ সাপোর্টেড আর্র্চ রুফ করছি এটা ব্যবহার করলে ভেতরে বিমের প্রয়োজন হয় না। এটা খুব কম খরচ ও টেকসই একটা পদ্ধতি। ২০০৯ সাল থেকে এটি আমরা করে আসছি।

আরেকটা নতুন টেকনোলোজি আমরা এনেছি গ্রামীণ টিনের ঘর যারা ব্যবহার করে তাদের জন্য। বর্তমানে দেখা যায় অধিকাংশ টিনের ঘরেই মরিচা ধরা। এবং কোনো নিম্নমানের র-ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরি। আমরা এখানে প্যাকেজ সিস্টেমে উন্নতমানের ঘর তৈরি করে দিব। ৩০ বছরের গ্যারান্টি দিব। ১০ ফিট বাই ১২ ফিট একটি ঘর মাত্র ৭০/৮০ হাজার টাকার মধ্যে পেয়ে যাবেন তারা।

এই মুহূর্তে আমার ফ্যাক্টরিতে  প্রায় ২০০ শ্রমিক কাজ করছে। এছাড়া ইঞ্জিনিয়ার, এডমিন, অফিস সহকারি রয়েছে প্রায় ৩০ জন। সাপোর্টিং ওয়ার্কার রয়েছে প্রায় ১৫০ জন।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এ সেক্টরকে আরও এগিয়ে নেওয়া। শুরু থেকেই আমার ধ্যান জ্ঞান এই স্টিল সেক্টর নিয়ে। এর বাইরে কোনো পরিকল্পনা নেই। প্রায় ১৬ বছর ধরে এই স্টিল সেক্টরের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছি।

রড ফ্যাক্টরির সঙ্গে স্টিল বিল্ডিংয়ের পার্থক্য
রডও স্টিল ফ্যাক্টরি তবে তারা মাত্র একটি প্রডাক্ট তৈরি করে।  রড দিয়ে আরসিসি কনস্ট্রাকশন বা এঙ্গেল বানিয়ে বিভিন্ন স্ট্রাকচার তৈরি করা হয়। কিন্তু আমরা স্টিল প্লেট ইমপোর্ট করে বিল্ডিং স্ট্রাকচার তৈরি করি। পুরো বিল্ডিং নির্মাণ করি। যদিও মানুষের মধ্যে এ নিয়ে বিভ্রান্তি কাজ করে। কিন্তু বুঝতে হবে, ওরা স্টিল মনে করে রডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। আমরা ওদের থেকে অনেক বিস্তৃত। ওদের রডও অনেক ক্ষেত্রে আমাদের কাজে লাগে। আমরা স্ট্রাকচার তৈরি করি। যার মধ্যে, বিল্ডিং আছে, ব্রিজ আছে, টাওয়ার আছে। যেটার মধ্যে ডিজাইন রয়েছে। যেমন- হাতিরঝিলে যে এম্ফি থিয়েটার রয়েছে (স্টিলের) ওটা আমাদের করা।

প্রকৌশলী এইচ এম জাহিদুল ইসলাম
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
এ এল এম স্টিল বিল্ডিং টেকনোলজি

আজকের বাজার: আরআর/ ২৯ মে ২০১৭