গ্রীষ্মের ফল উৎপাদনে উত্তরবঙ্গ ঐতিহ্যের ধারক

গ্রীষ্মের প্রচন্ড খরতাপে বিপর্যস্ত জীবনে প্রশান্তি এনে দিয়েছে মধুমাসের রকমারী ফল। বাজারে নানান ফলের পসরা নাগরিক জীবনে এনে দিয়েছে উৎসবের আমেজ। জামরুল শেষ হয়ে বাজারে এখন আম, লিচু, তাল আর জামের প্রচুর সরবরাহ। বাজারে আসতে শুরু করেছে কাঁঠাল আর ড্রাগন। বিপুল এ ফলের সমারোহ সমৃদ্ধ করছে ইফতারির টেবিলকে। আর এভাবেই মধুময় হয়ে উঠেছে মধুমাস।
গ্রীষ্মের ফল উৎপাদনে উত্তরবঙ্গের রয়েছে প্রাচীন ঐতিহ্য।

উত্তরবঙ্গের মধ্যভূমির অবস্থানে থেকে নাটোরও এ ঐতিহ্যের ধারক। গ্রীষ্মকালীন ফল নাটোরের অন্যতম অর্থকরি উৎপাদন। লাভজনক বলে এলাকার মানুষ ফল উৎপাদনে অনেক সচেতন ও আগ্রহী । তাই বিগত বছরগুলোতে নাটোরে ফলের আবাদি জমি ও ফলন- উভয়ই ক্রমশ: বেড়েছে।

নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চার বছর আগে জেলায় তিন হাজার ৪৯০ হেক্টর জমিতে ৩৮ হাজার ৩৯০ টন আম উৎপাদন হয়েছিল। চলতি বছর আমের আবাদি জমি বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৮৪৪ হেক্টর। আশা করা হচ্ছে ফলন হবে ৬২ হাজার ৩২৮ টন। ২০১৪ সালে জেলায় ৬০৮ হেক্টর জমি থেকে দুই হাজার ১৪৯ টন লিচু উৎপাদন হলেও চলতি মৌসুমে এক হাজার ১৪৫ হেক্টর আবাদি জমি থেকে ছয় হাজার ৬৮৬ টন লিচু উৎপাদন হবে। এবার ৬৩ হেক্টর এলাকা থেকে ২৫৬ টনের অধিক জাম এবং ১০৫ হেক্টর এলাকা থেকে এক হাজার ৬৮৩ টন তাল পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে । ১৫ হেক্টর জমি থেকে ৮৩ টন জামরুল পাওয়া গেছে বলে প্রাথমিক পরিসংখ্যানে জানা গেছে। এবার ২৯৩ হেক্টরে প্রায় সাড়ে চার হাজার টন কাঁঠাল হবে বলে আশা করা হচ্ছে। নাটোরে ৪৬০ হেক্টর পেয়ারার আবাদি জমিতে সম্ভাব্য ফলন পাঁচ হাজার টনের অধিক এবং প্রায় দেড় হাজার হেক্টর কলার আবাদি জমিতে সম্ভাব্য ফলন হবে ২৮ হাজার ৩৪৩ টন। বাঙ্গির আবাদি জমি ৭৯০ হেক্টর এবং প্রত্যাশিত ফলন প্রায় ৩০ হাজার টন। ৫৩ হেক্টর থেকে বেল হবে ৩৩১ টন। আর সম্প্রসারণশীল ড্রাগনের আবাদি জমি সাত হেক্টর এবং সম্ভাব্য ফলন ১১ টন।

নাটোরে চলতি মৌসুমে লিচুর ফলন ভালো। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুর এবং বাগাতিপাড়া উপজেলার তমালতলার লিচু প্রসিদ্ধ। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এসব এলাকার লিচু রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকাতে যাচ্ছে। নাজিরপুরের হামলাইকোল এলাকার কৃষক আবুল হোসেনের ২০ বিঘার অধিক জমিতে লিচুর বাগান রয়েছে।

তিনি বলেন, আমিসহ এলাকার সব লিচু ব্যবসায়ীরা মৌসুমের শুরুতেই বাগান বিক্রি করে দিয়েছি ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে। তিনি বলেন, বাগান বিক্রি করে দেওয়া এলাকার দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। বাজারে স্থানীয় জাতের প্রচুর লিচুর সমারোহ। দাম শ’প্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। মোজাফফর জাতের লিচু শেষ হয়ে বাজারে এখন পুরু শাস ও সুমিষ্ট বোম্বাই ও চায়না জাতের লিচু।

নাটোরের গুরুদাসপুর এলাকার আম চাষি আব্দুল গফুর বলেন ,নাটোরে এবার আমের বাম্পার ফলন হয়েছে। তুলনামুলকভাবে বাজারে আমের দাম কম। এলাকার ৪০ বছরের আম ব্যবসায়ী আব্দুল আওয়াল বলেছেন গাছে কেমিকেল না থাকায় প্রচন্ড গরমে এক সাথে সব আম পেকে বাজারে সরবরাহ বেড়ে গেছে।

নাটোরে ষ্টেশনবাজার ও নীচাবাজার এলাকায় আনাচে কানাচে আমের ডালি সাজিয়ে বসেছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ী কার্ত্তিক বিশ্বাস বলেন, স্থানীয় জাতের আম গড়ে ৩০ টাকা এবং কালুয়া সহ অন্যান্য আম ৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। অল্প দিনের মধ্যে বাজারে উঠতে শুরু করবে খেড়সা, ল্যাংড়া, পর্যায়ক্রমে আম্রপালী এবং সবার শেষে ফজলী ও আশ্বিনা। কলেজ শিক্ষক মাসুমা সুলতানা রুপা জানান, মাছ মাংসের বাজেট কমিয়ে বাঁচানো টাকায় নিয়মিত ফল কেনা হচ্ছে বাড়িতে। খরতপ্ত গ্রীষ্মে এবারের রোজায় ইফতারকে সমৃদ্ধ করছে রকমারী ফল, জানালেন নাটোর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসমাউল হুসনা।

বাজারে তিন চোখের তালের শাস বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা দরে। লাল রঙের জামরুল শেষ পর্যায়ে গড়ে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, সাদা-সবুজ রঙের জামরুল উঠবে ঈদের পরে। এবার জামের দাম অনেক বেশি। প্রতি কেজি জাম বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা দরে। আকারভেদে একটি বাঙ্গি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ৬০ টাকায়, পেয়ারা ৬০ টাকা কেজি আর কাঁঠাল একশ’ টাকার উপরে। মানুষের গাছ গাছালীর বাগান ও বাড়ির আঙিনায় করমচা, লটকন, ফলসা গাছে ফল ধরছে। মাঝে মধ্যে এসব দেশীয় ফল বাজারে উঠতে দেখা যাচ্ছে। প্রসিদ্ধ ফলের দোকানগুলোতে ড্রাগন বিক্রি শুরু হয়েছে। তবে মৌসুমের শুরু বলে দর আকাশচুম্বী। ফল ব্যবসায়ী সোহানুর রহমান জানান, ড্রাগনের কেজি গড়ে ছয়শ’ টাকা।

গ্রীষ্মকালীন ফল খাওয়া এবং ঈদকে উপলক্ষ করে নাটোরে গ্রামের বাড়ি অথবা আতœীয় বাড়িতে বেড়াতে আসছেন অনেকেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আর রাজি পাপ্পু বলেন, বাড়ি ফিরতে যানজটের বিড়ম্বনা থাকলেও ঈদ আর মৌসুমী ফল খেতে পরিবার নিয়ে নাটোরে আসছি। রাজধানী ঢাকা সহ দেশের অন্য জায়গাতে উপহার হিসেবে যাচ্ছে নাটোরের আম, লিচু আর ড্রাগন। সরাসরি পরিবহণ অথবা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে এসব ফল যাচ্ছে। নাটোর কন্টিনেন্টাল কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবস্থাপক শাহ আলম বলেন, প্রতিদিন গড়ে ১০ কার্টুন লিচু এবং ২৫ কার্টুন আম ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে। ঈদের পর থেকে উৎকৃষ্ট আমের পার্সেল আরো ব্যাপকভাবে যাওয়া শুরু হবে।

নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মোঃ রফিকুল ইসলাম বাসসকে বলেন, সচেতনতা বাড়ার ফলে নাটোরে রকমারী ফলের আবাদি জমি ও বাগানের সংখ্যা বাড়ছে। উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে এলাকার মানুষেরা ফল থেকে পর্যাপ্ত ভিটামিন ও অন্যান্যা খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে উপকৃত হচ্ছেন। গাছ থেকে আম পাড়তে সময়ের বিধি নিষেধ থাকায় আশা করছি নাটোরের আম ক্যামিকেলমুক্ত।

আরজেড/