দেশের পুঁজিবাজারে আবারও চরম আস্থাহীনতা আর আতংক দেখা দিয়েছে।নিঃস্ব হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। প্রতিদিনই ধারাবাহিকভাবে কমছে সূচক ও শেয়ারের দর। নির্বাচন সামনে রেখে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা ছিল বছরটিতে পুঁজিবাজার স্বাভাবিক থাকবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে পুরো উল্টো ।
বিনিয়োগকারীদের ভাষায় দেশের পুঁজিবাজার চলছে চরম অস্বাভাবিকভাবে।একাধিক বিনিয়োগকারীর মতে গত এক সপ্তাহে যে যেখানেই বিনিয়োগ করেছেন সেখানেই মুলধনের ৩০ শতাংশ হারিয়েছেন। এইভাবে চলতে থাকলে আবারও পুঁজি হারিয়ে পথে বসতে হবে বলেও অনেকেই আশংকা প্রকাশ করেন।
চলতি মাসের মধ্যে ১২ কার্যদিবসের প্রতিদিনই কমেছে সূচক ও শেয়ারের দাম।ধারাবাহিক সূচকের পতন সাধারণ বিনিয়োগকারীর মধ্যে ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের পুঁজিবাজারধসের আতঙ্ক আবারও ভর করছে।পুঁজিবাজারের এই দুটি বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শাসনামলে হওয়ার কারনে অনেকের আশংকা আবারও সেই কেলেংকারির পূঃনরাবিত্তি ঘটতে যাচ্ছে হয়তো!
রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচকের পতনে লেনদেন শেষ হয়। একই সঙ্গে কমেছে লেনদেনও ।
ডিএসইএক্স বা প্রধান মূল্য সূচক ৫২ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৩৯০ পয়েন্টে নেমে এসেছে। চলতি মাসে্র প্রথম কার্যদিবসে যেখানে এই সূচক ছিল ৫ হাজার ৬৯৮ পয়েন্টে।অর্থাৎ ১২ কার্যদিবসে ডিএসই’র প্রধান সূচকের পতন হয়েছে ৩০৭ পয়েন্ট। একই সাথে লেনদেনও কমেছে। রোববার ডিএসইতে ৩৯৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়। যা আগের কার্যদিবসের চেয়ে ৯৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা কম। বৃহস্পতিবার ডিএসইতে ৪৯২ কোটি ৭৯ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে।
ডিএসইএস বা শরীয়াহ সূচক ১২ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে এক হাজার ২৬৫ পয়েন্টে। আর ডিএস৩০ সূচক ১৬ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ২ হাজার ৯ পয়েন্টে।
এদিন ডিএসইতে মোট লেনদেনে অংশ নিয়েছে ৩৩৪টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড। এর মধ্যে দর বেড়েছে ৫০টির, কমেছে ২৬১টির। আর অপরিবর্তিত রয়েছে ২৩টি কোম্পানির শেয়ার দর।
অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই)একইভাবে লেনদেন শেষ হয়।সিএসই’র সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ১৬০ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১৬ হাজার ৬৪৩ পয়েন্টে।সিএসইতে ১৬ কোটি ৮০ লাখ টাকার লেনদেন হয়। সিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে ২১৭টি কোম্পানির শেয়ারও মিউচ্যুয়াল ফান্ড।এর মধ্যে কমেছে ১৫১টির আর দর বেড়েছে ৪৩টির, অপরিবর্তিত রয়েছে ২৩টির শেয়ার দর।
কোনরকম বাছবিচার ছাড়াই সব ধরনের শেয়ারের দরপতনে সূচক একের পর এক মনস্তাত্ত্বিক সীমা ভেঙে নিচে নেমে যাচ্ছে । প্রথম দফায় ডিএসইর সূচক ৬ হাজারের মাইলফলকের নিচে নামার পর অনেক বিনিয়োগকারী ভেবেছিলেন সূচক হয়তো ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু উল্টো তা সাড়ে ৫ হাজার পয়েন্টের মাইলফলকের নিচে নেমে এসেছে।
গত জুনের বাজেট-পরবর্তী সময়ে ডিএসইতে সূচক যতটা বেড়েছিল, তা ১২ কার্যদিবসের পতনে প্রায় আগের অবস্থাতেই ফিরে গেছে।বর্তমান ডিএসইএক্স সূচক লেভেল ছিল প্রায় গত বছরের ২৯ মে’র অবস্থানে।
বাজারে এ দরপতনের বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমান আজকের বাজারকে বলেন, এটা অস্বাভাবিক কিছু না, গত কয়েক বছরের তুলনায় বর্তমানে মার্কেট ভালো আছে। বাজেটের আগে সবাই একটু সতর্ক অবস্থান নেয়, তাই কারেকশন হয়।বাজারের তারল্য সংকটের কিছুটা প্রভাব রয়েছে বলে জানান আজকের বাজারকে। পুঁজিবাজারে চীনের প্রভাব নিশ্চয়ই পড়বে একটু সময় লাগবে। কারন মাত্র চুক্তি স্বাক্ষর হলো, আরও কিছু কাজ বাকি রয়েছে ।তবে তিনি বলেন বাজারের সব কিছুই নির্ভর করে বিনিয়োগকারীদের উপর।
গত কয়েক দিনে বাজারের একাধিক ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ একেবারেই কমে গেছে। অনেক ব্যাংক তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিয়ে অন্যত্র বিনিয়োগ করছে।অনেকে ডলার কিনে লগ্নি করছে। ব্যাংক খাতে হঠাৎ করে আমানতের সুদ হার বেড়ে যাওয়ায় অনেকে পুঁজিবাজারের পরিবর্তে ব্যাংকে টাকা ডিপোজিট করছে।
এদিকে ডিএসইর কৌশলগত বিনিয়োগকারী ইস্যুকে কেন্দ্র করে মতিঝিলের শেয়ারবাজারে পাড়ায় বেশ কিছু গুঞ্জন ভেসে বেড়াচ্ছিল গত কয়েক মাসে । যদি চীনের প্রতিষ্ঠানের কাছে শেয়ার বিক্রির অনুমোদন দেওয়া না হয়, তবে বাজারে তার বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে চীন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের কৌশলগত বিনিয়োগকারী হওয়ার পরও বাজারের পতন কেনো হচ্ছে? এর জবাব কে দিবে?ক্ষুব্দ বিনিয়োগকারীদের এমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় মতিঝিল পাড়ার ভিবিন্ন ব্রোকারেজ হাউজ ঘুরে।
সাধারন বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ পুঁজিবাজারের দেখার কেউ নেই। তাদের ধারনা বিনিয়োগকারীদের ডেকে এনে নিঃস্ব করা হচ্ছে। কেউ কেউ অভিযোগের আঙ্গুল তুলেন নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ খোদ বিএসইসি’র চেয়ারম্যানের দিকে।
একাধিক বিনিয়োগকারী আজকের বাজারকে বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বল মনিটরিং আর নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্যই কাজ করে, বাজারের জন্য না তাই এই অবস্থা। যে চেয়ারম্যান বিগত ৭ বছরে বাজারকে ভালো করতে পারেনি। বাজারের বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরাতে পারেনি সেখানে তাকেই আবার নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাহলে এই বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে কিভাবে? এভাবেই ক্ষোভের সাথে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেন আজকের বাজারের কাছে।
তবে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী মনে করেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকি দুর্বলতার কারণেই বাজারে নানাভাবে কারসাজির ঘটনা ঘটে। দেখা যায়, যেদিন বাজারে বিএসইসির তদারকি শক্তিশালী থাকে, সেদিন খুব বেশি সূচক কমে না। একাধিক বিনিয়োগকারী বলেছেন, বাজারে যদি সংকটই থাকবে তাহলে মাঝেমধ্যে বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটে কীভাবে? আসলে একটি গোষ্ঠী তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বাজারকে নানাভাবে ব্যবহার করছে। আর তাতে বারবার নিঃস্ব হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
একাধিক বিনিয়োগকারী বলেন এইভাবে ধারাবাহিকভাবে বাজারের পতন হলে আমরা নিঃস্ব হয়ে যাবো। ফলে বাজারে নতুন কোন বিনিয়োগের আগ্রহ থাকবেনা। তাই সংশ্লিষ্ট সবারই উচিত বাজারকে ভালো রাখার জন্য কাজ করা।
বাজারের সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিবিএ’র প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমেদ সাদেক আজকের বাজারকে বলেন, আমরা আশা করেছিলাম চীনের সাথে ডিএসই’র চুক্তি হয়েগেলে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে কিন্তু ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন থেকে শুরু করে কিছু বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠিন করে ফেলছে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এখনও পকৃত এডি রেশিও,সিআরআর এর সুবিধা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পায়নি।
বাজারের সাম্প্রতিক এ দরপতনের পেছনে কোনো কারসাজি রয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন সঠিকভাবে বলা কঠিন তবে আমার মনে হয় কোন একটা চক্র হয়তো বাজারকে অস্বভাবিক করে শেয়ার সংগ্রহ করছে।কারন সামনে বাজার অনেক ভালো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন আমরা খুব শীগ্রই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বিএসইসি’র চেয়ারম্যান এর সাথে পুঁজিবাজারের বিষয় নিয়ে বসবে ডিবিএ।
তবে এই বিষয়ে অনেক চেষ্টা করেও বিএসইসি’র দায়িত্বশীল কারো মতামত পাওয়া যায়নি।
জাকির/আজকের বাজার