চাকরি ছেড়ে কুলচাষে দীপ্তি ছড়াচ্ছেন দীপ্তিময়

পোশাক শিল্পকারখানার নিম্ন বেতনের চাকরি ছেড়ে কুল চাষ করে এখন এলাকায় দীপ্তি ছড়াচ্ছেন তরুণ উদ্যোক্তা দীপ্তিময়।

চাকরির বেতনের টাকায় সংসারে সচ্ছলতা আনতে না পারলেও কুল চাষ করে লাখ টাকা আয় করছেন তিনি।

রাঙামাটি ঘুরতে গিয়ে ছাক্রাছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশুতোষ তঞ্চঙ্গ্যার কুল বাগান দেখে প্রথম কুল চাষে উদ্বুদ্ধ হন দীপ্তিময়। পরে ইউটিউব থেকে জেনে নেন কুল চাষের পদ্ধতি ও পরিচর্যা। নিজেদের পাঁচ একর পাহাড়ি জায়াগায় বল সুন্দরী জাতের প্রায় ৭০০ কুল গাছ লাগান। ২০২৪ সালের মার্চ মাসে কুলের চারা লাগিয়ে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে কুল তুলতে শুরু করেছেন।  শুধু বল সুন্দরীই নয়, তার বাগানে আছে ভারত সুন্দরী এবং আপেল কুল গাছ।

তরুণ এই উদ্যোক্তা দীপ্তিময় তঞ্চঙ্গ্যা (৩৫) জেলার সদর উপজেলার সদর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড রেইচা সাতকমল পাড়ার বাসিন্দা গোলাপ কুমার তঞ্চঙ্গ্যা ও সুবালা তঞ্চঙ্গ্যা দম্পতির পুত্র। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছোট। তার স্ত্রী জোনাশ্রী তঞ্চঙ্গ্যা। দুই ছেলে মেয়ে সীথি তঞ্চঙ্গ্যা ও সৃজন তঞ্চঙ্গ্যা ।

সরেজমিনে দেখা যায়, বান্দরবান সদর উপজেলার রেইচা সাত কমলপাড়া থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি পাথুরে ঝিড়ি বেয়ে ওপরে উঠলেই তার বিশাল বাগান।

পাহাড়ের চারপাশে সারি সারি কুলগাছ। ফলের ভারে গাছগুলোর শাখা-প্রশাখা মাটিতে নুইয়ে পড়ছে ।

বাসসের সাথে আলাপকালে দীপ্তিময় জানান, ২০২৪ সালে খুলনার পাইক গাছা থেকে অনলাইনে অর্ডার করে দেড় হাজার চারা সংগ্রহ করেন তিনি। প্রতিটি চারা কিনতে খরচ হয় ২৫ টাকা। চারা ক্রয়, ভূমি উন্নয়ন ও শ্রমিকের মজুরি বাবদ প্রথম বছরে ব্যয় হয় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। গত বছরের মার্চের শেষের দিকে লাগানো হয় চারা।

নভেম্বর থেকে ফল তোলা শুরু হয়েছে। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত কুল তোলার মৌসুম। তবে দেখা যায় এই ফেব্রুয়ারিতেও তার বাগান থেকে কুল তোলা হচ্ছে।

দীপ্তিময় বলেন, প্রথমে কিছু ব্যাংক ঋণ এবং ভাইদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমি এ উদ্যোগ নিই। আমার বড় দুই ভাই এই বাগানের কাজেও সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করছেন। আমরা তিন ভাই মিলেই এখন বাগান করছি।

প্রথম বছর বাগানে ভালো কুল হলেও এ কুল বিক্রি করতে যেয়ে প্রথম বাধার সম্মুখীন হন দীপ্তিময়। প্রথমে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা তার কুল কিনতেই চাননি।

দীপ্তিময় বলেন, এখানে স্থানীয় কুল ব্যবসায়ী আছেন। তবে তারা আমার কাছ থেকে প্রথমে ফল কিনতে চান নি। তাই প্রথম প্রথম আমি কিছু বড়ই তাদের খাওয়ার জন্য দেই এবং বিক্রি করতে দিই। দেখা গেলো পর্যটকরা তাদের কুল কিনছে। এরপরেই স্থানীয়রা আমার থেকে কুল কিনতে ভীড় করে। পরিচিতি পাওয়ার পর চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকাররা আসেন আমার বাগানে।

চাকরি ছেড়ে কেন কুল বাগান করতে এসেছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে এই তরুণ উদ্যোক্তা বলেন, গার্মেন্টসে সামান্য বেতন পেতাম। তা দিয়ে সংসার চলতো না। আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে। বড় মেয়ে এখন রেইচা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণিতে পড়ে। দিন দিন সংসারের খরচ বাড়ছে। মনে হলো, চাকরির বেতনে হবে না। আয় বাড়াতে হবে। তাই চিন্তা করলাম বাগান করব। দেখি ভাগ্যে কি থাকে। সেই অনুসারে নিজের এলাকায় চলে আসি। রাঙামাটি যেয়ে আশুতোষ তঞ্চঙ্গ্যা স্যারের কুল বাগান দেখে বড় ও মেঝ ভাইকে বলি। পাহাড়ে পানি না থাকায় কুল চাষকে তারা প্রথমে অসম্ভব মনে করেছিলেন। তারপরও তারা আমার পাশে থেকেছেন এবং বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন।

তাদের সহযোগিতা ছাড়া এ যাত্রা আমরা কাছে অনেক বেশি কঠিন হতো।

সরেজমিনে দেখা যায়, পাথুরে ঝিঁড়ি পথ বেয়ে প্রায় দেড় হাজার ফুট উপরে উঠতে হয় তার বাগানে। বাগানের চারপাশে নেই কোন বসতি। পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে দেখা যাবে পাঁচ একর জুড়ে কুল বাগান। সারিবদ্ধভাবে লাগানো হয়েছে কুল গাছ। এক একটা গাছের উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট । ফলের ভারে অনেক গাছের শাখা প্রশাখা ভেঙে পড়েছে। গাছের গোড়ায় কুল পড়ে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে। সেসব ফল শুকানোর জন্য কেউ কেউ কুঁড়িয়ে নিচ্ছেন। আরো দেখা যায়, ১৫ থেকে ২০ জন শ্রমিক কুল ছিঁড়ে পাহাড়ি থুরং (এক ধরনের বিশেষ ঝুড়ি) ভরছেন। পড়ে সেসব ফল নিয়ে যাচ্ছেন পাইকারের কাছে। পাইকাররা সেসব ফল বস্তা বন্দী করছেন। কোন ধরনের সড়ক যোগাযোগ না থাকায় শ্রমিকরা পাথুরে ঝিড়িঁ বেয়ে সমতলে নিয়ে আসছেন। একটু করে পা পিঁছলেই হাজার ফুট নিচে পড়ে যেতে পারেন কুল বহনকারীরা। আর সেই সাথে আছে পিচ্ছিল বড় বড় পাথর । তাই খুব সাবধানে কুলের ভার নিয়ে নামছেন তারা। ফলের বটু নরম করার জন্য কেউ কেউ ঝিঁড়ি থেকে মোটর দিয়ে পানি তুলে গাছের গোড়ায় ছিটাচ্ছেন।

ফল ছিঁড়তে ছিঁড়তে দীপ্তিময় বলেন, এক বছরের কম সময়ে গাছগুলো ফল দেওয়া শুরু করে। প্রতিদিন গড়ে ১৫ থেকে ২০ মণ ফল বিক্রি করি। প্রতি কেজি কুল বিক্রি করি ১০০ থেকে ১২০ টাকা করে। তবে আগাম কুল বিক্রি করি কেজি প্রতি ২০০ টাকা করে। প্রতিদিন গাছে ৪৫ কেজিরও বেশি ফল পাওয়া যায়।

তিনি বলেন, এবছর চারগুণ বড়ই হয়েছে। বিক্রিও করেছি ভালো। এখন আরো দুটি বাগান কিনেছি। ওটাতেও কুল বাগান করার চিন্তা ভাবনা আছে। দীপ্তিময়ের নামডাক শুনে সবাই আসছেন তার বাগান দেখতে। প্রতিদিনই কয়েকজন ফোন দেন বাগান দেখার জন্য। অনেকে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন নিজের জমিতে কুল বাগান করতে।

বান্দরবান সদর ইউনিয়নের গোলিয়াখোলার ১নং ওয়ার্ড কমিশনার শহিদুল ইসলাম বলেন, দাদার বাগানে আসলাম। কুল খুবই মিষ্টি। চারপাশে কুল আর কুল। এখানে না আসলে বুঝতাম না এত সুন্দর বাগান। আমি দেখে খুব উদ্বুদ্ধ হয়েছি। আমিও ওনার পরামর্শ নিয়ে চারশ থেকে পাঁচশ চারা গাছ আমার বাগানে লাগাব।

বাগানে কাজ করতে আসা বান্দরবান সদর ইউনিয়নের রেইচার বাসিন্দা রইত্য রানী তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, এ বাগানে তিন জাতের বড়ই আছে। প্রত্যেকটা জাতের বড়ই খুব মিষ্টি।

এখানে বড়ই এর চাহিদা আছে। স্থানীয় বাজারে বিক্রির সাথে সাথে মালিক পাইকারদের কাছেও বিক্রি করেন। দয়ামালা তঞ্চঙ্গ্যা নামের আরেকজন বলেন, প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা বিক্রি করা হয়। স্বাদও বেশি।

বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এম এম শাহ নেওয়াজ বলেন, পার্বত্য জেলা বান্দরবানে দিন দিন কুল আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কুল সুস্বাদু ও জনপ্রিয়। দেখতে চমৎকার। এবছর ১৫০০ হেক্টর জমিতে কুল চাষ হচ্ছে। তবে ১০-১৫% বল সুন্দরী চাষ হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, যেহেতু অনেকেই কুল আবাদ করে লাভবান হয়েছেন, তাই আমরা কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। কীভাবে চারা রোপণ ও  গাছের পরিচর্যা করতে হয়। অধিদপ্তর থেকে বিনামূল্যে সার ও বীজ দেয়া হয়।(বাসস)