চীনে কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ, ৫ কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা

চীনে করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাগেরহাটের কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ থাকায় লোকসানের মুখে পড়েছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা। সময় মতো ঘের থেকে কাঁকড়া বিক্রি করতে না পারায় ঘেরেই মারা যাচ্ছে অনেক কাঁকড়া। এ অবস্থা চলতে থাকলে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা করছেন জেলার কাঁকড়া চাষি ও ব্যবসায়ীরা।

বাগেরহাটের শরণখোলায় ছোট-বড় তিন শতাধিক কাঁকড়া ঘের রয়েছে। এসব ঘেরে প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিকটন কাঁকড়া মজুত রয়েছে বলে চাষিরা জানিয়েছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে এসব কাঁকড়া রপ্তানি করা না গেলে অধিকাংশ কাঁকড়া ঘেরে মারা যাবে। এতে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা চাষিদের। রবিবার শরণখোলা উপজেলার বেশ কয়েকটি কাঁকড়া ঘের ঘুরে চাষি, জেলে ও শ্রমিকদের সাথে ইউএনবির এ প্রতিনিধি কথা বলে জানতে পারেন, কাঁকড়া চাষের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছেন জেলার কয়েক হাজার জেলে-শ্রমিক। কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ থাকায় তারা রয়েছেন চরম দুরবস্থায়। উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতিতে রপ্তানিকারক, চাষি, জেলে, শ্রমিক সবাই হতাশ হয়ে পড়েছেন।

চাষিরা জানান, শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী, রায়েন্দা এবং ধানসাগর ইউনিয়নের সুন্দরবন সংলগ্ন ভোলা ও শ্যালা নদীসংলগ্ন লোকালয়ে মাটির বেড়ি ও বাঁশের পাটার ঘেরা দিয়ে দীর্ঘ ৭-৮ বছর ধরে কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে। জেলেদের মাধ্যমে সুন্দরবনসহ বিভিন্ন নদ-নদী থেকে ধরে আনা ছোট কাঁকড়া ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে কিনে ঘেরে ছাড়া হয়। এরপর আড়াই থেকে তিন মাস ঘেরে কাঁকড়া লালন-পালন করা হয়। বিক্রি উপযোগী পূর্ণাঙ্গ কাঁকড়ায় পরিণত হতে ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা খরচ পড়ে। এরপর পাইকারি ও রপ্তানিকারকদের কাছে বিক্রি করা হয়। বিগত বছরগুলোতে কাঁকড়া বিক্রি করে বেশ লাভবান হয়েছেন চাষিরা। কিন্তু এ বছর রপ্তানিতে হঠাৎ ধস নামায় পুরোটাই লোকসান গুণতে হবে তাদের। কাঁকড়া রপ্তানি সমস্যা দূর করতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন চাষিরা।

সোনাতলা এলাকার চাষি মো. পলাশ মাহমুদ জানান, তার ঘেরে এক হাজার ৫০০ কেজি কাঁকড়ার মধ্যে ২৫০ কেজি মারা গেছে। পাশ্র্ববর্তী জাহাঙ্গীর হোসেন হিরুর ঘেরে দুই হাজার কেজির মধ্যে মারা গেছে প্রায় ৩৫০ কেজি। তাদের এলাকায় ১৫০টি কাঁকড়া ঘের রয়েছে। প্রত্যেকের ঘেরের কাঁকড়া মরে যাচ্ছে। পলাশ মাহমুদ আরও জানান, আড়াই থেকে তিন মাসের মধ্যে কাঁকড়া পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয়। এর মধ্যে বিক্রি না হলে এমনিতেই মরে যায়। কারণ মা কাঁকড়ার পেট ডিমে পরিপূর্ণ থাকে। এছাড়া পুরুষ কাঁকড়ার খোলস পরিবর্তনের সময় এসে যায়। ডিম ছাড়া এবং খোলস পরিবর্তনের সময় সমস্ত কাঁকড়া সাগর, নদ-নদীতে চলে যায়। বদ্ধ জায়গায় থাকার কারণে তারা মারা যায়। রপ্তানি বন্ধ থাকায় বর্তমানে ঘেরে যে কাঁকড়া রয়েছে তা কেউ কিনছে না।

উত্তর রাজাপুর গ্রামের চাষি রফিকুল ইসলাম ও আসিফ খান জানান, তাদের উত্তর ও দক্ষিণ রাজাপুর এলাকায় ছোট বড় মিলে বেশকিছু কাঁকড়া ঘের রয়েছে। প্রত্যেক ঘেরেই ৩০০ থেকে দুই হাজার কেজি পর্যন্ত কাঁকড়া মজুদ রয়েছে। প্রতিদিন এসব ঘেরের কাঁকড়া মারা যাচ্ছে। বাজার চালু থাকলে গড়ে ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা কেজি দরে এসব কাঁকড়া বিক্রি হত। কিন্তু এখন পুরোটাই লোকসান হবে।

ধানসাগর এলাকার চাষি আলিম হাওলাদার জানান, তার ঘেরে ২ হাজার ২০০ কেজি কাঁকড়া ছিল। গত তিন-চার দিনে ৮০০ কেজি কাঁকড়া মরে গেছে। গত বছর তার প্রায় ৮ লাখ টাকা লাভ হয়। কিন্তু এবার লাভ তো দূরের কথা, আসলও বাঁচবে না। তিনি আরও জানান, তাদের এলাকা অতিরিক্ত লবণাক্ত হওয়ায় জমিতে ধান হয় না। তাই গ্রামের অধিকাংশ মানুষই এই কাঁকড়া চাষের ওপর নির্ভরশীল। শ্যালা নদীর কুল ঘেঁষে ধানসাগর, বটতলা, বান্দারহাট এলাকায় কয়েকশত ছোটবড় ঘেরে কাঁকড়ার চাষ হয়।এ বছর সকল চাষিই ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

চীনে কাঁকড়া রপ্তানিকারক বাগেরহাটের ব্যবসায়ী মো. আলামীন জানান, তারা শতকরা ৯৫ ভাগ কাঁকড়া চীনে রপ্তানি করেন। তাসনিন ইন্টার প্রাইজের মাধ্যমে সর্বশেষ গত ২৪, ২৫ এবং ২৬ জানুয়ারি চীনে সাত মেট্রিকটন কাঁকড়া রাপ্তানি করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে এরপর থেকে কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। এছাড়া রপ্তানি করা ওই সাত মেট্রিকটন কাঁকড়ার প্রায় ৪০ লাখ টাকা এখনও তারা পাননি। ফলে লোকসানের মুখে পড়েছেন কাঁকড়া রপ্তানিকারকরাও। একই সাথে চাষিদের ঘেরে কাঁকড়া মারা যাচ্ছে। সবমিলিয়ে কাঁকড়া চাষি, জেলে এবং ব্যবসার সাথে যুক্ত কয়েক লাখ মানুষ দুরবস্থায় পড়েছে।

শরণখোলা উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা বিনয় কুমার রায় জানান, শরণখোলার চাষিরা সাধারণত ১০ থেকে ১৫ দিন কাঁকড়া ঘেরে রাখার পর বিক্রি করে থাকে। কিন্তু চাষিরা গত ডিসেম্বর থেকে ঘেরে কাঁকড়া ছাড়ার পর আর ধরতে পারছেন না। অধিক পরিমাণ কাঁকড়া দীর্ঘদিন ধরে ঘেরে থাকার কারণে শরণখোলায় বিভিন্ন ঘেরে কাঁকড়া মরার খবর আসছে। তিনি আরও জানান, শরণখোলায় ছোট-বড় মিলে ২০০টি কাঁকড়া ঘের রয়েছে। চাষিরা সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন নদী-খাল থেকে লবণ পানির কাঁকড়া এনে তাদের মিঠা পানির ঘেরে ছেড়ে লালন-পালন করেন। পানির পরিমাণ কম হওয়ার কারণে এবং মা কাঁকড়ায় ডিম থাকায় কিছু কিছু ঘেরে সামান্য পরিমাণ কাঁকড়া মারা গেছে। করোনাভাইরাসের কারণে কাঁকড়া রপ্তানি বন্ধ থাকায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি জানান। এ অবস্থায় ভিন্ন দেশে কাঁকড়ার বাজার খোঁজার পরামর্শ দেন এই মৎস্য কর্মকর্তা।

বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ডা. মো. খালেদ কনক বলেন, বাগেরহাটের শরণখোলায় সামান্য কয়েকটি ঘেরে কাঁকড়া মরার খবর আসছে। তবে ওই সব কাঁকড়া কোনো ধরনের ভাইরাসে মারা যায়নি। অল্প পানিতে অধিক পরিমাণ কাঁকড়া চাষ করায় সামান্য কিছু কাঁকড়া মারা গেছে। যে সব ঘেরে অধিক পরিমাণ কাঁকড়া মজুত রয়েছে তা অন্যত্র ছাড়ার পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা। সূত্র-ইউএনবি

আজকের বাজার/আখনূর রহমান