তরুণ উদ্যোক্তা তৈরিতে বিজনেস হাব, সহায়ক নীতি ও ফান্ড দরকার

একটি দেশের মূল শক্তি তরুণ প্রজন্ম। এ শক্তি কাজে লাগিয়ে যেকোনো সেক্টরে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। আমাদের দেশের তরুণেরা উদ্যমী ও পরিশ্রমী হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণে বর্তমান প্রেক্ষাপটে তরুণ উদ্যোক্তা হওয়াটা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। ৩০ বছর ধরে বাংলাদেশের তরুণদের নিয়ে কাজ করছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। সম্ভাবনাময় এই প্রজন্মের বিভিন্ন দিক নিয়ে দৈনিক আজকের বাজার ও আজকের বাজার টেলিভিশনের (এবি টিভি) সাথে আলাপ করেছেন জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও ভাইয়া গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ভাইস চেয়ারম্যান শাখাওয়াত হোসেন মামুন। কথোপকথনের চুম্বক অংশ তাঁরই জবানিতে তুলে ধরা হলো দৈনিক আজকের বাজারের পাঠকদের জন্য।

আজকের বাজার ও এবি টিভিকে শুভেচ্ছা। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ তরুণদের নিয়ে কাজ করছে ৩০ বছর ধরে। আমাদের তরুণেরা উদ্যমী, তারা কাজ করতে চায়। তারা দেশের জন্য, জাতির জন্য অনেক কিছু করতে চায়, কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে তরুণ উদ্যোক্তা হওয়াটা বেশ কঠিন। প্রথমত, সরকারি পর্যায়ে যেটুকু সাহায্য প্রয়োজন, সেটুকু সব সময় সে পায় না। ফলে পুরো ব্যাপারটা তাকে নিজ উদ্যোগেই করতে হয়। সবাই তো আর পারিবারিকভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পায় না। ফলে তরুণদের পুরো কাজটা নিজেকেই করতে হয়। মূলধন সংগ্রহ, ট্রেডলাইসেন্স করা, অফিস, ডকুমেন্ট সংগ্রহ করাসহ যাবতীয় প্রসেস নিজেদের করতে হয়। আর এগুলো সংগ্রহ করতেই প্রায় এক বছর লেগে যায়। এরপরও ব্যাংক থেকে লোন দিতে চায় না। পাশাপাশি নানা রকম তথ্য নিতে গিয়ে হিমশিম খায় তারা। ফলে প্রথমেই সেই হবু উদ্যোক্তা বড় ধাক্কা খায়।

এখানে সরকার দুটি কাজ করতে পারে। এক. বিজনেস সেন্টার করা, যেখানে স্বল্প খরচে তরুণ উদ্যোক্তাদের ছোট স্পেসের অনেকগুলো রুম থাকবে। স্বল্পমূল্যে তিন বছরের জন্য রুম ভাড়া দিতে পারে সরকার। যেখানে ওয়ান স্টপ সার্ভিস থাকবে। যেখানে অফিস রুম হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। যেখানে ব্যাংকের বুথ থাকতে পারে, অর্থাৎ এখান থেকে তাকে পুরো সাপোর্ট দেওয়া হবে।
দুই. ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করা। তা না হলে এসব তরুণ বিদেশে চলে যাবে। তাকে নাসা নিয়ে যাবে, আমাজান নিয়ে যাবে, মাইক্রোসফট নিয়ে যাবে। নতুন জেনারেশন যারা তৈরি হচ্ছে, নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে আসছে, তারা কিন্তু এখানে পরিবেশ না পেলে বাইরের দেশে চলে যাবে।

ঢাকা চেম্বার কী করছে
আমরা ঢাকা চেম্বার অব কমার্স, এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গে কাজ করি। আমরা এক হয়ে সরকারের সঙ্গে আলাপ করেছি, সরকারও আন্তরিক, কিন্তু বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এখনো কিছু হচ্ছে না। সরকার বড় বড় গ্র“প অব কোম্পানিকে সহজেই ২০০ কোটি টাকা ব্যাংক লোন দেয়। দেখা যায়, অনেক সময় ব্যবসায় লস হওয়ার কারণে ২০০ কোটি টাকা মার যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সরকার যদি একশজন তরুণ উদ্যোক্তার মধ্যে এই ২০০ কোটি টাকা সমান ভাগ করে দেয়, তাহলে তারা কিছু একটা করতে পারবে। হয়তো সবাই সফল হবে না। এর মধ্যে যদি চার-পাঁচজনও সফল হয়, তাহলেও কিন্তু তারা সরকারকে কয়েক গুণ ফিরিয়ে দিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক ও সরকার এগিয়ে আসতে পারে।

আমার অভিজ্ঞতা থেকে অনেক তরুণকে ইনোভেটিভ আইডিয়া নিয়ে আসতে দেখেছি। কিন্তু মূলধনের অভাবে, মার্কেটের কারণে তারা দমে গেছে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন পোর্টাল, অ্যাপস প্রোডাক্টগুলো আমাদের বাজারে জায়গা করে নিতে পারছে না। ফলে তারা বাইরে চলে যাচ্ছে। বাইরের দেশে একটা মোবাইল অ্যাপস যেভাবে বাজার পায়, আমাদের এখানে সেভাবে সাড়া পায় না। তাই আমাদের সরকারকে এ ব্যাপারে প্রনোদনা দেওয়া উচিত।

জনশক্তি নেই ঠিক নয়
দক্ষ জনশক্তি আমাদের এখানে নেইÑ এ ব্যাপারে আমি একমত নই। কারণ, আমাদের ছেলেরাই নাসায় কাজ করছে, আমাজানে কাজ করছে, গুগলে কাজ করছে। আমরা আসলে দক্ষদের ধরে রাখতে পারছি না, তারা বিদেশে চলে যাচ্ছে। আমরা তাদের দোষ দিতে চাই না। আমরাই তাদের কাজের সুযোগ দিতে পারছি না। ফলে অদক্ষদের নিয়ে কাজ করছি। এই মুহূর্তে এদের জন্য পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। নইলে প্রতিনিয়তই আমরা দক্ষ জনশক্তি হারাতে থাকব।

বাজেট হোক জনবান্ধব
নতুন বাজেট হোক জনবান্ধব। দেশের জনগণ সুফল ভোগ করুক। শোনা যাচ্ছে, সরকার কমন (প্যাকেজ) ভ্যাট তুলে দেবে। এখন যেমন ৪ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ভ্যাট দিয়ে ট্যাক্স দিয়ে ব্যবসা করা খুবই কঠিন। কিন্তু সব ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট নীতি গ্রহণ করলে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হবে বলে আমি মনে করি। নারী উদ্যোক্তারা ফান্ড পাচ্ছেন, কিন্তু তরুণেরা পাচ্ছে না। আমি চাই তরুণদেরও ফান্ড দেওয়া হোক। যার দরকার নেই তাকে ফান্ড না দেওয়া, যার দরকার তাকে ফান্ড দেওয়া। ভ্যাটের আওতা বাড়ানো যেতে পারে। অর্থাৎ যেসব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ভ্যাট-ট্যাক্স দিচ্ছে না, তাদের খুঁজে বের করা উচিত। ভ্যাট-ট্যাক্সের বোঝা না বাড়িয়ে এনবিআরকে ট্যাক্স-ভ্যাটের আওতা বাড়ানোর জন্য বলা যেতে পারে।

তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য
তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য আমার বলার কথা হচ্ছে, বিদেশে না গিয়ে দেশে থেকেই যেন কিছু করার চেষ্টা করে। কারণ দেশ তার জন্য এরই মধ্যে বিনিয়োগ করে বসে আছে। দরিদ্র মা-বাবা তাঁদের কষ্টের ও পরিশ্রমের টাকা প্রতিটি সন্তানের জন্য বিনিয়োগ করছেন। সে কারণে তার কিছু দায়ভার আছে দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি। কষ্ট করে হলেও যেন দেশে বসে থেকেই কিছু করে। নিশ্চিয়ই একদিন তারা সফল হবে এবং সফলতা উপভোগ করতে পারবে। কারণ বাংলাদেশ ধীরে ধীরে সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। শুধু একটু সময়ের প্রয়োজন।

শাখাওয়াত হোসেন মামুন
সাবেক প্রেসিডেন্ট, জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
ভাইস চেয়ারম্যান, ভাইয়া গ্র“প অব ইন্ডাস্ট্রিজ