নিম্নস্তরের ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ এবং উচ্চস্তরের ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য নূন্যতম ১০৫ টাকা নির্ধারণ করে ৬৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের দাবি করেছেন তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো। সিগারেটের ৪টি স্তরকে ২টি স্তরে নিয়ে আসারও প্রস্তাব করা হয়। এছাড়াও সকল ক্ষেত্রে ১০ শলাকা সিগারেটে ৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ, সকল তামাকজাত পণ্যে ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং স্বাস্থ্য উন্নয়নে ২ শতাংশ সারচার্জ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়।
শনিবার রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটে ‘কেমন তামাক কর চাই’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) রিসার্চ ডিরেক্টর ড. মাহফুজ কবীর লিখিত বক্তব্যে বলেন, করারোপের ফলে তামাকের প্রকত মূল্য ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশে তামাকের ব্যবহার ৫ শতাংশ হ্রাস পায়। এদেশে ৩ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ অকাল মৃত্যু বরণ করেন।
তিনি বলেন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারে অর্থনৈতিক ক্ষতি ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, যা একই বছরের তামাক খাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা বেশি। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সঙ্গে তামাকজাত পণ্যের দাম সেভাবে বৃদ্ধি করা হয় নাই। গতবছর বাজেটে নিম্নস্তরের সিগারেট মূল্য বৃদ্ধি করা হলেও উচ্চস্তরের সিগারেটের মূল্য বৃদ্ধি পায় নাই। এতে প্রকৃত পক্ষে নিম্ন শ্রেণীর মানুষদের তামাক ব্যবহারে ব্যয় বাড়লেও মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তদের ব্যয় বাড়ে নাই।
ড. মাহফুজ বলেন, বিশ্বে যেসব দেশে সিগারেটের মূল্য অত্যন্ত কম বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, সিগারেটের প্রকৃত মূল্য ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। ২০০৯ এর তুলনায় ২০১৭ সালে সিগারেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৫ লাখ বৃদ্ধি পেয়েছে। সিগারেটের প্রকৃত মূল্য হ্রাস পাওয়ার কারণে সিগারেটের ব্যবহার কমছে না। তিনি বলেন, ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী সংখ্যা এ দেশে বেশি। বাংলাদেশে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২ কোটি ২০ লাখ এবং ধূমপায়ী ১ কোটি ৯২ লাখ। ধোঁয়াবিহীন ব্যবহারকারী সংখ্যা বেশি হলেও তামাক রাজস্বের ০.২ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। এই জন্য এখনি সময় ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্যকে সরকারের কর জালের মধ্যে নিয়ে আসা। এছাড়াও সরকারের কাছে ই-সিগারেট এবং হিটেড তামাক পণ্যের উৎপাদন, আমদানি এবং বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধের দাবি করেন ড. মাহফুজ কবীর ।
প্রগতির জন্য জ্ঞান (প্রজ্ঞা) এবং এন্টি টোব্যাকো মিডিয়া এ্যালায়েন্সর (আত্মা) যৌথ আয়োজনে সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ। পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, অর্থনীতি অনেক সময় সমাধান দিতে পারে না। সবার আগে মানুষের স্বাস্থ্যের কথা ভাবতে হবে। দেশে তামাক পণ্যের দাম অনেক কম, তাই ওইসব ব্যবহার করতে কারও পকেটে চাপ পড়ে না। ধূমপানকারীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ সিগারেটের কম মূল্য।
তিনি বলেন, কুষ্টিয়া জেলাতে সবচেয়ে বেশি তামাক উৎপাদন করা হয়ে থাকে। সেসব কৃষকদের সচেতনতার মাধ্যমে অন্য চাষবাদে আগ্রহী করে তুলতে হবে। তাদের বুঝাতে হবে তামাকের চেয়ে অন্য ফলন চাষ করলে লাভ বেশি। তাই সরকারকে এসব কৃষকদের সুনজর দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সারচার্জ হিসেবে যে ১২০০ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়া যায় তা সচেতন বৃদ্ধি করতে ব্যয় করতে হবে। অর্থের প্রকৃত ব্যবহার ঘটাতে হবে। সরকার প্রতিবছর বাজেটের আগে তামাক পণ্যের ওপর কর আরোপের যে ফরমূলা আমাদের দেয়, তা পূরণ করে না। কিন্তু আমাদের থেমে থাকলে চলবে না। আমরা জানি সরকার আমাদের কথা দিয়ে কথা রাখবে না, কিন্তু আমাদের পথ থেকে সড়ে গেলে হবে না। তামাকের ব্যবহার কমাতে এই আন্দোলন চলমান থাকবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী বলেন, ১৩ থেকে ১৫ বছরের শিশু কিশোররা শতকরা ৭ ভাগ ধূমপান করে, এই হার বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। তামাকের আসক্তি কমাতে উচ্চহারের কর আরোপের কোন বিকল্প নেই। শুধুমাত্র কর আরোপের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
তিনি বলেন, তামাকের খারাপ দিক প্রাথমিক শিক্ষা থেকেই বোঝাতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে একজন শিশু যা শিক্ষা পায় তা তার রক্তে মিশে যায়। প্রাথমিক পর্যায় থেকে শিশুদের বোধে যদি তামাকের খারাপ দিকটি তুলে ধরতে পারি তাহলে দেশে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক কমে যাবে। পাঠ্যবই-এ তামাকের কুফল অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সবার এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।
বিআইডিএসইয়ের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন বলেন, যে কেউ জেনে শুনে বিষপান করতে চাইলেই আমি দেব কিনা সেটা এখনি ভাবতে হবে। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে তামাকের বিরুদ্ধে সচেতনামূলক কর্মকা- আয়োজন করতে হবে। যেসব দোকানদার অপ্রাপ্তদের কাছে সিগারেট বিক্রি করে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আমাদের তামাকের বিরুদ্ধে সব কথা বলতে হবে, বলতে বলতেই কিছুটা হলেও সফলতা আসে।
তিনি বলেন, জর্দা যে কত ক্ষতিকর এটা অনেকে জানে না। ধোঁয়াবিহীন তামাকের বিরুদ্ধেও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে করতে হবে। যারা তামাক ব্যবহার করে তারা হয়ত সহজে ছাড়তে পারবে না, কিন্তু যারা এখনও ধূমপান করেন না তাদের তো এ থেকে বাঁচাতে পারি। এজন্য তামাকের ওপর উচ্চ কর আরোপ করতে হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, তামাক পণ্য থেকে অনেক কর আরোপ হয় এটা শুধু ভাবলে হবে না। মূলত তামাক পণ্য ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্যখাতে যে ব্যয় হয় এটা নিয়ে ভাবতে হবে। সব ধরনের তামাক পণ্যে ১৫ শতাংশ ভ্যাট রাখতে হবে। একইসঙ্গে কর্পোরেট করহার কমানো যাবে না।
সূত্র - জনকণ্ঠ