অতিথি পাখির আগমন তিস্তার চরের পরিবেশে এক ভিন্নধর্মী জাঁকজমকপূর্ণ দৃশ্য সৃষ্টি করেছে। আর সেই দৃশ্য উপভোগ করতে নদী পাড়ে একত্রিত হচ্ছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ, যাদের জন্য এই সময়টা যেনো প্রকৃতির এক অনবদ্য উপহার। প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থীরা অতিথি পাখি দেখতে নদীপাড়ে ভিড় করছে । নতুন নতুন পাখি দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন তারা।
শীতের কুয়াসাচ্ছন্ন সকালে তিস্তা নদীর চর যেন এক অপূর্ব দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে ওঠে। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়তে থাকা অতিথি পাখির সুর যেন পরিবেশকে এক নতুন জীবন দেয়, আর সেই সুরে মুগ্ধ হয়ে নদীর পাড়ে ভিড় জমাচ্ছে পাখিপ্রেমী দর্শনার্থীরা।
হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আসা এসব পাখির বিচরণ তিস্তার বালুময় চরকে সাজিয়ে তোলে এক অনন্য সৌন্দর্যে, যেখানে পাখির উড়াউড়ি ও ছোটাছুটিতে মুগ্ধ হয় প্রতিটি চোখ।
সরেজমিনে দেখা যায়, তিস্তা নদীর ছোট ছোট জেগে ওঠা চরে বিচরণ করছে অগণিত নানা রঙের ছোট-বড় অতিথি পাখি। হাজার মাইল দূর থেকে এসে মোহনীয় করে তুলছে তিস্তার প্রকৃতি ও পরিবেশ। চরগুলোয় পাখির দলবেঁধে ওড়াউড়ি, ছোটাছুটি এবং ডুব সাঁতারের সুন্দর মুহূর্ত দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন মাঝি, কৃষাণ-কৃষাণি ও পাখিপ্রেমী দর্শনার্থীরা। জেগে ওঠা চরে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির উড়ন্ত দৃশ্য উপভোগ করতে পিছিয়ে নেই দর্শনার্থীসহ শৌখিন ও পেশাদার আলোকচিত্রীরাও। সকালে ও বিকেলে নদীর পাড় ধরে কিছু দূর এই দৃশ্য ধরা পড়ে চোখে। কেউ কেউ নৌকা ভাড়া করে নিয়ে খুব কাছে থেকে দেখা ও উপভোগ করছেন। সব মিলিয়ে তিস্তা নদী যেন অতিথি পাখির নির্ভয় বিচরণ ক্ষেত্র হয়ে উঠছে।
বনবিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শীতকাল এলেই বিশেষ করে প্রতি বছর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অতিথি পাখির কলতানে মুখর হয়ে ওঠে তিস্তা নদীর উভয় পাড়। এবারও পাখি আসছে। এবারে বেশ কিছু নতুন পাখি দেখা যাচ্ছে নদীতে। এর মধ্যে নানা প্রজাতির দুর্লভ হাঁস, ছোট কান প্যাঁচা, লম্বা পা তিসাবাজ, জিরিয়া, টিটি, মনকান্ড, চখাচখিসহ ৫০ থেকে ৫৫ প্রজাতির পাখির দেখা মিলছে তিস্তায়। তবে অচেনা পাখির ভিড়ে এবার তিস্তায় দেখা মিলেছে বিরল প্রজাতির পাখি পাতি মার্গেঞ্জারের। এই পাখি দেখতে অনেকটা রাজহাঁসের মতো। ঠোঁট, পা, পায়ের পাতা কমলা রঙের। ডানা ধূসর এবং সাদার মিশ্রণ।
আলোকচিত্রী রনজিত দাস বাসসকে বলেন, ‘শীতকাল এলেই তিস্তা নদীতে যাই দুর্লভ পাখি দেখতে এবং ছবি তুলতে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবারে তিস্তায় গত বছরের চেয়ে বেশি পাখির আগমন ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে উড়ে আসা এই অতিথি পাখিদের জন্য আমাদের নদীমাতৃক দেশের সৌন্দর্য যেমন মন কাড়ে, তেমনি কষ্টও লাগে যখন দেখি শিকারির হাতে বন্দী পাখি ও জবাই করা পাখি। আমাদের নদী, প্রকৃতি ও পরিবেশ প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছি। ধীরে ধীরে পাখির বাসযোগ্য স্থানগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, যার কারণে দেশে আসা অতিথি পাখিরা নিরাপত্তায় ভোগে এখন।’
তিস্তা পাড়ের বাসিন্দা গোলাম রব্বানী বাসসকে বলেন, ‘অনেক বছর ধরেই তিস্তা নদীর তীরে ও চরে পাখি আসছে। তিস্তা নদীর সঙ্গে এবং তিস্তা পাড়ের মানুষের সঙ্গে অতিথি পাখিদের হৃদয়ের সম্পর্ক অনেক গভীর। শীত এলেই পাখির কলতানে মুখরিত হয়ে ওঠে তিস্তাপাড়। যার কারণে তিস্তা নদীর আশেপাশের মানুষের ভাঙা-গড়া কষ্টের জীবনে এই অতিথি পাখিরা কিছুটা কষ্ট লাঘব করে। সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন এই অতিথি পাখি দেখি, ভালোই লাগে। বিকেলেও দেখা মেলে। এই সময়টা নদী ভাঙনের কষ্ট ভুলে মনটা ভরে যায় পাখি দেখে।’
এ ব্যাপারে রংপুরের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ কর্মকর্তা স্মৃতি সিংহ রায় ’বাসসকে বলেন, ‘প্রতিবছর শীত এলেই রং-বেরঙের নাম না জানা অনেক রকম পাখিতে ভরে যায় আমাদের জলাশয়, হাওড়, বিল ও পুকুর। আদর করে আমরা সেগুলোকে ‘অতিথি পাখি’ বলি। ঝড়, বৃষ্টি, তুষারপাতসহ প্রকৃতির প্রতিকূলতা থেকে বাঁচতে তারা পাড়ি জমায় হাজার হাজার মাইল দূরের আমাদের এই বাংলাদশে। ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশি পাখি আসে বাংলাদেশে। এই পাখিগুলো শিকারিদের হাত থেকে রক্ষায় সামাজিক বন বিভাগের একটি টহল টিম বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে। (বাসস)