তুষ পদ্ধতিতে হাঁসের বাচ্চা ফুটিয়ে স্বাবলম্বী দুই শতাধিক পরিবার

একটা সময়ে চরম আর্থিক সংকটে দিনানিপাত করতাম। মানুষের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করেও ঠিকমত সংসার চলতো না। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় দিনমজুরের কাজ করতে গিয়ে তুষ ও হারিকেন বাতির উত্তাপে হাঁসের বাচ্চা ফোটানো শিখে আসার পর আর আমাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে খুব সুখেই আছি। এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এসব সাফল্যের গল্প বলেন সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার মহেষ রৌহালী গ্রামের মো. শাহ আলম।

মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনি তুষ ও হারিকেন পদ্ধতীতে হাঁসের বাচ্চা ফুটানোর হ্যাচারি করে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। এখন হারিকেন বাতির উত্তাপে ১ মাসেই তার হ্যাচারিতে ২ লাখ ৫০ হাজার ডিমের হাঁসের বাচ্চা ফুটান তিনি।

শুধু শাহ আলম নয় তুষ পদ্ধতিতে হাঁসের বাচ্চা ফুটিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন বিরৌহালী, পংরৌহালী ও মহেষ রৌহালীসহ আশাপাশের গ্রামের অন্তত দুইশাতাধিক পরিবার। এই এলাকায় প্রথমে শাহ আলম হ্যাচারী কার্যক্রম শুরু করলেও অল্প পুঁজিতে ভালো লাভ পাওয়ায় এ পদ্ধতিটি ছড়িয়ে পড়েছে আশে পাশের কয়েকটি গ্রামে।

সরেজমিনে বিরৌহালী, পংরৌহালী ও মহেষ রৌহালী গ্রামের বেশ কয়েকটি হারিকেন বাতির হ্যাচারিতে গিয়ে দেখা গেছে, বাঁশের মাচার উপর সারিবদ্ধভাবে রাখা রয়েছে লাখ লাখ হাঁসের ডিম। এসব ডিম লেপ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। আর মাচার নিচে প্রয়োজন সংখ্যক হ্যারিকেন বসিয়ে পরিমাণ মতো তাপ দেয়া হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার নির্দিষ্ট সময় শেষে ডিম ফুটে হাঁসের বাচ্চা বের হচ্ছে। প্রতিটি হ্যাচারিতেই ডিম ও বাচ্চার পরিচর্যার কাজ করছেন ৬ থেকে ৭ জন করে শ্রমিক।

উৎপাদনকারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এ পদ্ধতিতে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটতে সময় লাগে মাত্র এক মাস। প্রথমে ডিমগুলোকে রোদে দিতে হয়। একদিন রোদ লাগার পর সেগুলো সিলিন্ডারে বসানো হয়। এই সিলিন্ডার তৈরি করা হয় ধাড়ি (চাচ) দিয়ে। এটি ধানের তুষ দিয়ে পরিপূর্ণ করা হয়। একটি সিলিন্ডারে এক হাজার ডিম রাখা যায়। সিলিন্ডারের পাশে একটি স্থানে তুষে আগুন দিয়ে সিলিন্ডারে তাপ দেয়া হয়। প্রতি তিন ঘণ্টা পর পর ডিমগুলো নড়াচড়া করতে হয়। এভাবে ২০/২৫ দিন তাপ দেয়ার পর ডিমগুলো একটি চটে বিছিয়ে রাখতে হয়। ২৭ থেকে ২৮ দিনের মধ্যেই সেগুলো থেকে বাচ্চা বের হয়। এক হাজার ডিম থেকে গড়ে ৭০০ বাচ্চা হয়। ভালো ডিম হলে বাচ্চার পরিমাণ আরো বেড়ে যায়। তবে ঋতু পরিবর্তনের সাথে বাচ্চা উৎপাদনের পরিমান কম বেশি হয়ে থাকে।

প্রতিটি ডিম ৮ থেকে ১০ টাকা দরে কিনতে হয়। একদিনের হাঁসের বাচ্চার দাম হয় সাধারণত ২০ থেকে ২৫ টাকা। ডিমের দামের ওপর বাচ্চার দাম অনেক সময় কম বেশি হয়ে থাকে। সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতিতে বাচ্চা ফুটানোর কারণে এখানকার বাচ্চার চাহিদা সারা দেশে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মুনসিগঞ্জ,নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, রংপুর, চাপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ব্যবসায়ী ও পাইকাররা এখান থেকে বাচ্চা সংগ্রহ করে থাকেন।

সফল হ্যাচারি ব্যবসায়ী শাহ আলম বলেন, তুষ পদ্ধতিতে হাঁসের বাচ্চা ফুটিয়ে আশাপাশের কয়েকটি গ্রামের দুইশাতাধিকের বেশি পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে। কম টাকায় ভালো লাভ হওয়ায় এ ব্যবসার সাথে অন্যান্য আশেপাশের অনেক গ্রামের মানুষও এখন এগিয়ে আসছে। আবার যাদের নিজেদের হ্যাচারি করার সামর্থ নেই তারা আশেপাশের বাড়ির হ্যাচারিতে কাজ করছেন।

আমরা পুরুষরা শুধু ডিম কিনে এনে দেই। বাকি সব কাজ মহিলারাই করে। আমাদের কিছু করতে হয় না। আমরা হাল-চাষসহ আমাদের অন্যান্য কাজ করি। আর যাদের হ্যাচারি বড় তারা কর্মচারি রাখেন।

তিনি বলেন, এই হ্যাচারি পদ্ধতী আসায় এলাকার বেকার সমস্যার সমাধান হচ্ছে। অনেক শিক্ষিত ছেলা এখন হ্যাচারি তৈরি করছে। সহজ শর্তে স্থানীয় ব্যাংক বিশেষ করে কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ দেয়া হলে এ শিল্প আরো এগিয়ে যাবে। লাভজনক এই শিল্পে ঋণ দিলে ব্যাংকও লাভবান হবে। বিরোইল গ্রামের রফিকুল ইসলাম বলেন- ‘এই কাজের জন্য খুব একটা পরিশ্রম করতে হয় না। মাঝে মধ্যে কাজ করলেই হয়। ডিমগুলো নাড়াছাড়া করা ছাড়া আর কোন কাজ নেই। তাই এ কাজ আমরা মহিলারাসহ আমাদের ছেলে মেয়েরাও করতে পারে।’

তিনি বলেন- ‘হাঁসের বাচ্চা ফুটিয়ে আমরা অনেক ভালো আছি। তবে সরকার যদি এ ব্যাপারে মহিলাদের প্রশিক্ষণ ও ঋণ দিত তাহলে আমাদের আরও ভালো হতো।’ নওগাঁ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজনু সরকার বলেন, এ পদ্ধতি সারা দেশের জন্য একটি মডেল। উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে এটি ছড়িয়ে দিতে পারলে সারা দেশের যুব সমাজ এর মাধ্যমে উপকৃত হবে।

এ প্রসঙ্গে উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সোহেল আলম বলেন, আমরা তাদের সব ধরনের টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে পরিদর্শণে যাই, তাদের সাথে কথা বলি এবং কোন সমস্যা আছে কি না জানতে চাই। ভ্যাকসিন বা চিকিৎসার ব্যাপারে কোন সমস্যা হলে আমরা সাথে সাথে সাপোর্ট দিচ্ছি। তথ‌্য-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান