এপ্রিল ১৮,২০১৮: আজকের বাজার প্রতিবেদকঃ দূর্ভোগ আর ভোগান্তির চরম সীমায় ঠেকেছে রাজধানীর গণপরিবহন যাত্রীসেবা। সরকারী ছুটি বা সাপ্তাহিক ছুটি কিম্বা রাজধানীতে কোনো সমাবেশও নয়, তারপরও নগরীর রাস্তায় গণপরিবহন চলাচলের দৃশ্য দেখে মনে হতে পারে দেশে বাসের আকাল লেগেছে। তবে এ দৃশ্য স্বাভাবিক নয়, এটি কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে দাবি সাধারণ যাত্রীদের। সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পর থেকেই রাজধানীতে গণপরিবহন সেবায় দেখা দিয়েছে সংকট।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও দেখা মিলছে না বাস। নগরীতে চলাচলকারীদের অভিযোগ, আগের মতো অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের জন্য যাত্রীদের জিম্মি করতেই বাস বন্ধ রাখা হয়েছে। অফিসগামী যাত্রীরা দীর্ঘ সময় অপেক্ষারপর গাড়ির দেখা পেলে, হুরাহুরি করে জীবন বাঁজি রেখে উঠতে গিয়েই শিকার হচ্ছেন দূর্ঘটনার।
সিটিং এর নামে বাস ভাড়া নিয়ে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছিল, পকেট কাটার সিটিং সার্ভিস লোকাল হওয়ার পর, কমেনি ভাড়া বরং বেড়েছে দ্বি-গুন। সিটিংয়ে যে ভাড়া ছিল ১০ টাকা লোকালে সে ভাড়া ১৫ থেকে ২০ টাকা করা হয়েছে। কোথাও কোথাও চাওয়া হচ্ছে ২৫ টাকা পযর্ন্ত। একই সাথে গাড়ির মধ্যে গাদাগাদি করে উঠতে হচ্ছে যাত্রীদের। এদিকে বাসের ভাড়া নিয়ে পরিবহন স্টাফদের সাথে যাত্রীদের তর্কাতর্কি, এমনকি হাতাহাতিও হচ্ছে গেল কদিন ধরে।
এদিকে সোমবার রাজধানীর মিরপুর এলাকায় সিটিং সার্ভিস নিয়মে অতিরিক্ত ভাড়া না দেয়ায় পরিবহন শ্রমিকদের হামলার শিকার হয়েছেন ৭১ টেলিভিশনের প্রযোজক আতিক রহমান। একই দিনে পরিবহন শ্রমিকদের হামলার শিকার হয় দৈনিক সমকালের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ইন্দ্রজিৎ সরকার।
তবে যাত্রীদের অভিযোগ, সরকার সিটিং সার্ভিস বাতিল করে দেয়ায় পরিবহন সেক্টরের লোকজনই, নিজেরাই এই সংকট তৈরি করেছে। সাধারণ মানুষকে ইচ্ছে করেই ভোগান্তিতে ফেলচ্ছে।’
গণপরিবনে দূর্ভোগের বেশি শিকার হচ্ছে শিশু এবং মহিলারা। বাসে ওঠানামায় শারীরিক ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তারা। একই সাথে বাসের মধ্যে থাকতে হচ্ছে গাদাগাদি করে। এতে করে অসুস্থ হয়ে পড়ছে শিশুরা।
গুলিস্তান থেকে মিরপুরগামী যাত্রী মোরসালিন আজকের বাজারকে বলেন, ‘সিটিং সার্ভিস তুলে দেয়ায় জনগণের ভোগান্তি আরো বেড়েছে। পরিবহন কর্মীরা আগের চেয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। বিআরটিএর চার্ট অনুযায়ী ভাড়া নেয়া হচ্ছে না, আবার সর্ব নিম্ন ভাড়াও নিতে নারাজ তারা। আগের মতই ভাড়া আদায় করছে, উল্টো গাড়ি বোঝাই করে যাত্রী তুলছে নামাচ্ছে যত্রতত্র।’
প্রতিদিন বাসে চলাচলকারী কলেজ ছাত্রী সুমাইয়া সুমি আজকের বাজারকে বলেন, লোকাল বা সিটিং কোন সমস্যা নয়। সমস্যা এদের মনে। প্রতিদিনকার চলাচলে কতবার যে বাস ড্রাইভার বা কন্ডাক্টর-হেলপারদের কাছে নিজের সম্মানখোয়াতে হয়, হিসেব কষেও তা বের করা যাবে না।
সিটিং সার্ভিস তুলে দেয়ার সরকারী সিদ্ধান্তের সাথে মালিক পক্ষ এক মত হলেও, প্রকৃত অর্থে তারা একমত নয় বলেও অভিযোগ উঠেছে। সরকারের চাপের মুখে তারা এ সিদ্ধান্তে মত দিয়েছে বলে জানান এক বাসের কন্ট্রাকটর। তিনি বলেন, মালিক পক্ষ কি নিজে নিজে সিটিং তুলতে চাইছে। সরকার বাধ্য করছে সিটিং বন্ধ করতে। আর এ কারণেই রাস্তায় বাসের সংখ্যা কম। যাতে সরকার আবারো বাধ্য হয় সিটিং নামাতে।
এদিকে বাস প্রতি জমা নিয়ে চালক ও মালিকপক্ষের দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে বলেও সূত্র জানায়। পরিবহন চালকদের দাবি, বাস লোকাল হওয়ায় আয় কমেছে,কিন্তু মালিকপক্ষকে আগের হারেই প্রতিদিন টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে।
বাস চালকদের এ অভিযোগ নাকচ করছেন পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা। তারা বলেন, ‘এসব কথা যারা বলছেন, তারা মিথ্যা বলছেন। বাস লোকাল হওয়ার পর থেকে চালকদের আমরা অনেক ছাড় দিচ্ছি। আগের চেয়ে দৈনিক সাতশ’ থেকে আটশ’ টাকা করে কম নেওয়া হচ্ছে।
বাসের এমন নৈরাজ্য ঠেকাতে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান বলেন, ‘ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য বন্ধ করতে আমাদের অভিযান চলমান আছে। প্রতিটি বাসে ভাড়ার তালিকা টাঙ্গিয়ে রাখা এবং সে অনুযায়ী ভাড়া আদায় করা বাধ্যতামূলক। এর ব্যতয় পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ রাস্তায় বাস চলাচল স্বাভাবিক করতে তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বন্ধ রাখা বাসের তালিকা করছি। জরিমানার ভয়ে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে বাস চলাচল বন্ধ রাখলে ওই বাসের রুট পারমিট বাতিল করা হবে।’
যাত্রী ভাড়া নিয়ে এই নৈরাজ্য বেশির ভাগ বাসেই অব্যাহত রয়েছে। স্বাধীন, দিশারী, এটিসিএল, এফটিসিএল, গ্যালাক্সি,এয়ারপোর্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ পরিবহন, স্বজন, বসুমতি, মিরপুর পরিবহন, বিকল্প, অসিম, সুপ্রভাত, শিকড়,ইউনাইটেড, বিহঙ্গ প্রভৃতি পরিবহন কোম্পানীর বাসে লোকালের নামে সিটিংয়ের মতো অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
অপর দিকে মিরপুর রুটের জাবালে নূর, জাবালে তুর, আকিক, তেঁতুলিয়া, রব রব, অ্যাকটিভ, অছিম, বসুমতি, নূরে মক্কা, প্রজাপতিসহ অধিকাংশ পরিবহনের অসংখ্য বাস বিভিন্ন স্থানে বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গণপরিবহনে যাত্রী ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য থামাতে গত ৪ এপ্রিল ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি ঘোষণা দেয়, ১৫ এপ্রিল থেকে ঢাকায় সিটিং সার্ভিস কিংবা গেট লক সার্ভিস বলে কিছু থাকবে না। এ ঘোষণা কার্যকর করা হয় ১৬ এপ্রিল থেকে।
বিআরটিএ জানিয়েছে, ২০১৫ সালে সরকার সর্বশেষ গণপরিবহনের যাত্রী ভাড়া পুনর্নিধারণ করে। সে অনুযায়ী মিনিবাসে প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া জনপ্রতি ৬০ পয়সা এবং বড় বাসে ১ টাকা ৬০ পয়সা। বিআরটিএ’র ঘোষণা অনুযায়ী, যে কোন রুটে যাত্রীদের সর্বনিম্ন ভাড়া বড় বাসে জনপ্রতি সাত টাকা এবং মিনিবাসে পাঁচ টাকা।
আজকের বাজারঃএসআর/এলকে/১৮-০৪-২০১৭