কালের পরিক্রমায় অনেকটাই কমে গেছে দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার। চাহিদা কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন এসব বাদ্যযন্ত্রের কারিগররা। থমকে গেছে তাদের জীবন। জীবিকার তাগিদে চৌদ্দ পুরুষের পেশা ছেড়ে খুঁজছেন নতুন পেশা।
বাঙালী সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী ধারা লোকগান। আর এসব লোকগানের অবিচ্ছেদ্য অংশ ঢাক, ঢোল, খোল, ডুগি, নাল, কঙ্কন, একতারা, দোতারা, সারিন্দা ও বাংলা ঢোলসহ হাতে তৈরি বাদ্য যন্ত্র। যুগ যুগ ধরে এসব বাদ্যযন্ত্র তৈরি করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন দেশের এক শ্রেণীর প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
লালমনির হাট জেলার সংস্কৃতির ইতিহাস থেকে জানা যায়, এ জেলায় প্রচলিত লোকসঙ্গীতের মধ্যে এখন ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি এবং বাউল সঙ্গীতই প্রধান। একসময় কুষাইন গান, কবি গান, পালাগান, সাদা পাগলার গান, গাঁথার গান প্রভৃতির প্রচলন থাকলেও এসব লোকসঙ্গীতের আসর এখন আর খুব বেশি নজরে পড়েনা।
লোকগানের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হাতে তৈরি বাদ্যযন্ত্রের চাহিদা তাই আগে সারাবছরই লেগে থাকতো। বাদ্যযন্ত্রের কারিগরদের জীবনও চলতো একই গতিতে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে একদিকে যেমন লোকগানের ধারা বদলেছে, অন্যদিকে আধুনিক প্রযুক্তি ও নিত্য নতুন বাদ্যযন্ত্রের ভীড়ে চাহিদা কমেছে দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের। বর্তমানে অনেক কারিগরই আর্থিক অভাবে পড়ে জীবন ও জীবিকার তাগিদে পূর্বপুরুষের এই পেশা ছেড়ে বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা।
জানা যায়, ১৭ শতকের শেষ দিকে এ এলাকাটির গোড়াপত্তন হয়। কথিত আছে, ১৭৮৩ সালে সাধারণ কৃষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লালমনি নামে একজন নারী কৃষক নেতা নুরুলদিনকে সাথে নিয়ে বৃটিশ সৈন্য ও জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন। সেই থেকে এ জায়গার নাম হয় 'লালমনি'। কাজেই এই এলাকার লোক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি যে অনেক পুরাতন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
জেলা সদরের বড়বাড়ী বাজারের ঢাক-ঢোলের কারিগর মানিক চন্দ্র দাস(৫৪) বাসস'কে জানান, শতাধিক বছরের বেশি সময় ধরে বংশপরম্পরায় এ পেশায় নিয়োজিত আছেন তার পরিবার। তাদের পূর্বপুরুষ ঢাক-ঢোলসহ অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র তৈরির কাজ করে আসছেন। বর্তমানে এ জেলায় মনিদাস সম্প্রদায়ের প্রায় শতাধিক পরিবার রয়েছে। এদের মধ্যে মাত্র ২৫- ৩০টি পরিবারের লোকজন এখনো পৈতৃক পেশা বাদ্যযন্ত্র তৈরি ও মেরামতের সঙ্গে জড়িত আছেন। আর বেশিরভাগ পরিবার অন্য পেশায় চলে গেছে।
মানিক চন্দ্র দাস বলেন, আমি আগে আমার বাবা ও দাদার সাথে কাজ করতাম। তখন এত বেশি কাজ থাকত যে আমরা ৫-৭ জন মিলেও কাজগুলো শেষ করতে পারতাম না। সে সময় খেয়েপড়ে দিন ভালই চলতো। কিন্তু গত ১০ থেকে ১২ বছর ধরে পৈতৃক এ পেশায় সন্তোষজনক আয় হচ্ছে না। এখন বছরে দুই থেকে তিন মাস এ কাজ হয়। এতে আর পেট চলে না। আমরা সরকারি কোনো সহযোগিতাও পাই না। যদি কোনো সহযোগিতা পাই, তাহলে আবারও প্রাণ ফিরে পাবে এ শিল্পটি।
জেলা শহরের বি.ডি.আর হাট এলাকার বাদ্যযন্ত্র তৈরির কারিগর সুশীল চন্দ্র দাস (৩৮) জানান, এক যুগ আগে শুধু বর্ষাকাল ছাড়া সারা বছরই তাদের মোটামুটি কাজ চলতো। কিন্তু এখন তাদের বছরের অধিকাংশ সময় কর্মহীন হয়ে বসে থাকতে হয়।
তিনি বলেন, এখন লোকজন মাঝে মাঝে আমাদের কাছে আসেন শুধু খোল তৈরি ও মেরামতের জন্য। বর্তমানে এসবের চাহিদা না থাকায় আমাদের বাদ্যযন্ত্র তৈরি ও মেরামতের কাজ ভুলে যাওয়ার দশা হয়েছে।
ঢোল বাদক নিরঞ্জন রায় (৪২) বাসসের সাথে আলাপকালে বলেন, যুগ যুগ ধরে এ জেলায় ঢাক বাদ্য তৈরি ও ঢাক বাজিয়ে আমাদের প্রায় শতাধিক শ্রমিক ও কারিগর তাদের জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। বিশেষ করে দুর্গাপূজা এলেই ঢাকের চাহিদা অনেকাংশে বেড়ে যায়। হিন্দু সম্প্রদায়ের ১২ মাসের প্রায় প্রতিটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ঢুলিদের নাচ-ই হচ্ছে অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ। আর ঢাকের বাদ্য (শব্দ) ছাড়া দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানসহ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কোনো অনুষ্ঠানই তেমন জমে উঠত না। কিন্তু এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় স্থান পেয়েছে ড্রাম ও গিটারসহ অন্যান্য উন্নত বাদ্যযন্ত্র। যা দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের চাহিদা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে।
এ বিষয়ে গীতিকার ও সুরকার সত্যেন্দ্রনাথ রায়(৫৫) বাসস'কে বলেন, ‘আজকাল গ্রামেগঞ্জে ভাওয়াইয়া গান, পালাগান ও যাত্রা গান তেমন একটা মঞ্চায়িত হয় না। আগে ঢোল, ঢুগি,তবলা, দোতরা, হারমোনিয়াম ছাড়া গানের আসরই জমতো না। এখন সেখানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় স্থান পেয়েছে ড্রাম ও গিটারের। যা দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের চাহিদা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে।
গ্রামেগঞ্জে সংস্কৃতি চর্চা কমে যাওয়া এবং সংস্কৃতির ধারা বদলে যাওয়ার কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন, রংপুর পুলিশ লাইন স্কুল এন্ড কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম। তিনি একজন সমাজকর্মী এবং সংস্কৃতি গবেষক।
জাহাঙ্গীর আলম বাসস'কে বলেন , এখন গ্রামগঞ্জে তেমন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মঞ্চে আয়োজন করা হয় না। এ কারণে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার নাই বললেই চলে। শিল্পীরাও বাদ্যযন্ত্র তৈরির কারিগরদের সােেঙ্গ যোগাযোগ রাখেন না। বাদ্যযন্ত্র তৈরির কারিগরদের মতো অনেক শিল্পীরাও মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় দেশীয় বাদ্যযন্ত্র বিলুপ্তির পথে। দেশীয় বাদ্যযন্ত্রগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হলে এর আধুনিকায়ন যেমন জরুরি, তেমন প্রয়োজন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা। আর তা না হলে বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢাক-ঢোল, তবলা, একতারা, দোতারা একদিন হারিয়ে যাবে।
সমাজ সেবা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সরকার ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে বয়স্ক ও বিশেষ ভাতা কর্মসূচি চালু করে। এরই ধারাবাহিকতায় লালমনিরহাট জেলায় ২০১৭-১৮ অর্থ বছর পযর্ন্ত ১২৬ জন বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী বয়স্ক ভাতা বা বিশেষ ভাতা সুবিধা পাচ্ছেন। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে সর্বমোট ৩৭৫ জন উপকারভোগী ভাতা পেয়ে আসছেন।
লালমনিরহাট সদরের সমাজসেবা অফিসার লায়লা আক্তার বাসস'কে বলেন, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাদ্যযন্ত্র তৈরির কারিগররাও প্রান্তিক জনগোষ্ঠি। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশ হিসেবে সমাজসেবায় আবেদন করলে তাদের আর্থিক সহযোগিতা দেবে সরকার। তিনি আরো বলেন, এ বিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরে তথ্য পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও আমরা বিশেষ কিছু গোষ্ঠী ও পরিবারকে সরকারিভাবে ভাতার আওতায় আনার পরিকল্পনা করছি।
লালমনিরহাট জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মুহাম্মদ মতিয়ার রহমান বাসস'কে বলেন, একটা সময় ব্যস্ত ছিল ঢাকঢোল তৈরির কারিগররা। কিন্তু কালের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন বাংলার ঐতিহ্য ঢাক-ঢোল, তবলা একতারা ও দোতারার চাহিদা কমেছে । তবে আমারা বাদ্যযন্ত্র তৈরির কারিগরদের বা সংশ্লিষ্ট অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের দিকে গুরুত্ব দিয়ে এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে কথা বলব এবং বিশেষ ভাতা সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করব। (বাসস)