দেশীয় খাদ্য পণ্যে আস্থা রাখতে হবে

নিত্য খাবারের পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাত বিকল্প খাবার হিসেবে বিস্কুট, চানাচুর, ড্রাইকেক বেশ জায়গা করে নিয়েছে। আমাদের দেশে এই সেক্টরে প্রায় ৪০০-৫০০ কোম্পানি রয়েছে। যদিও সংকট রয়েছে ভালো কোম্পানির। মানসম্পন্ন কোম্পানিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য লিডার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড। কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এম মোস্তাফা জামাল দেশীয় খাবারের বিভিন্ন দিক নিয়ে দৈনিক আজকের বাজার ও আজকের বাজার টেলিভিশনের (এবি টিভি) সাথে খোলামেলা আলোচনা করেছেন। আলোচনার অনুলিখন তাঁরই জবানিতে আজকের বাজারের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।

আমাদের নিয়মিত খাবারের (ভাত, মাছ, মাংস) বাইরে গিয়ে যদি প্রসেসড ফুড বা অলটারনেটিভ ফুড হিসেবে চিন্তা করি, তাহলে বিস্কুট, চানাচুর, ড্রাইকেক ইত্যাদি আমাদের খাবারের তালিকায় নিত্যদিনের সঙ্গী হিসেবে রাখি। আমাদের দেশের জনসংখ্যা যদি হিসাব করি, তাহলে আমরা দেখব যে প্রসেসড ফুডের ভোক্তাও অনেক বেশি। সে কারণেই এই সেক্টরের সার্বিক অবস্থার প্রসপেক্টটা বেটার অবস্থায় আছে। এই সেক্টরে প্রায় ৪০০-৫০০ কোম্পানি রয়েছে। আমি নিজেও এই সেক্টরকে বেছে নিয়েছি, কারণ আমি প্রায়ই ভেজাল খাবারের কথা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনতাম। আমাদের ভোক্তারা নিশ্চিত মনে এসব খাবার যাতে গ্রহণ করতে পারে, সে কারণেই এই সেক্টরে আমার আসা। তাদের যদি আমি বেটার ফুড ও স্বাস্থ্যকর খাবার দিতে পারি, তাহলেই আমি সফল হব। আমাদের কনজ্যুমার আইটেম প্রতিনিয়ত বাড়ছে, তেমনি ভোক্তাও বাড়ছে। আমি চাই আমাদের বাজারে আরও বেশি বেশি কোম্পানি আসুক, যাতে করে আরও ভালো ফুড, বেটার ফুড আমরা ভোক্তাদের দিতে পারি। আমরা অনেকেই জানি, আমাদের এসব পণ্য এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। আমরা এখনো শুরু করতে পারিনি, কিন্তু আমার পরিকল্পনা আছে আগামীতে রপ্তানি করার।

আমাদের দেশের জনসংখ্যার তুলনায় ভালো ভালো কোম্পানি এখনো কম। সতরাং আরও অনেক উদ্যোক্তা আসার সুযোগ এখনো রয়েছে। তারা যদি পরিকল্পনা নিয়ে আরও বেটার বেটার ফুড নিয়ে বাজারে আসে, তাহলে ভোক্তাদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবে। ভোক্তারাও বেটার ফুড গ্রহণ করতে পারবে।

আমদানিকারকদের সিন্ডিকেটের কারণে সমস্যায় পড়তে হয়

কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত সমস্যা ফেস করতে হয়, যেহেতু আমরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, আমাদের সব সময় বড় সাপ্লায়ারদের ওপর নির্ভর করতে হয়। প্রয়োজন হয় কিছু বেসিক ও মেজর আইটেমের। যেমন ময়দা, তেল, চিনি আমাদের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ‘র’ ম্যাটেরিয়ালস আইটেম বিগ ভলিয়ুমে লাগে না, এ ক্ষেত্রে যে সমস্যা ফেস করি তা হলো, প্রয়োজনের তুলনায় মার্কেটে সরবরাহ কম থাকে, সিন্ডিকেশনের প্রভাবে মার্কেটে শূন্যতা দেখা দেয়, এটা ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি। প্রতি বছর কিছু কিছু সময়ে আমাদের এই আইটেমের সিজনে (যেমন শীতকালে, আগস্টে) ইমপোর্টাররা আমাদের সাপ্লাই দিতে পারেন না। ফলে সপ্তাহ অন্তর, মাস অন্তর তেল, ময়দার দাম বেড়ে যায়। কিন্তু আমরা চাইলে ৬০ টাকার ব্রেড কিছুদিন পর পর দাম বাড়িয়ে ৬৫ টাকা করতে পারি না। আমরা তো আর ভোক্তাদের এসব কথা গিয়ে বলতে পারি না। সে কারণে আমাদের প্রতিনিয়ত লসের দিকে যেতে হচ্ছে এবং লাভের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হয়।

শিল্পে গ্যাসের বিকল্প নেই
শিল্পের জন্য এখন গ্যাস প্রধান একটি উপাদান। সরকার এখন শিল্পে গ্যাস দিচ্ছে না। ফলে আমাদের গ্যাসের বিকল্প হিসেবে ডিজেল আর বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। নিজস্ব জেনারেটরের ব্যবস্থা রয়েছে। বিদ্যুতের বাইরে আমরা এলপি গ্যাসের ব্যবস্থা রেখেছি, কিন্তু এলপি গ্যাসেরও দাম বেশি। যার ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের লাভের চেয়ে লসের পরিমাণ বেশি হচ্ছে। তবে বিদ্যুতের অবস্থা এখন অনেক বেটার। বিদ্যুৎ আমরা বেশ ভালোভাবে পাচ্ছি, উৎপাদন করতে পারি, সে কারণে সরকারকে ধন্যবাদ দিতে পারি।

অনেক সময় পরিদর্শকদের নিয়ে সমস্যা হয়
যে সেক্টর সম্পর্কে আমার ধারণা নেই, সেই সেক্টরে গিয়ে কিন্তু কাজ করতে পারব না। যেমন আমি আমার সেক্টর সম্পর্কে অবশ্যই ধারণা রাখি, ফলে এই সেক্টর সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে পারব। আবার আমার যে সেক্টর সম্পর্কে ধারণা নেই, সেই সেক্টর নিয়ে যদি আমাকে রিপোর্ট করতে বলা হয়, তাহলে আমি তো কিছু বলতে পারব না। ইদানীং বিএসটিআই থেকে পরিদর্শক যাঁরা ভিজিটে আসছেন, তাঁদের অনেকের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ধারণা আছে, অনেকের ধারণা নেই। যেমন প্রতিষ্ঠানের জন্য আমরা ‘ইস্ট’ ব্যবহার করি ব্রেড ও কেক বানানোর জন্য। এখন এই ইস্ট সম্পর্কে তাদের ধারণা থাকতে হবে। ইস্ট দিয়ে ব্রেড, কেক ফোলানো হয়। ইস্ট ব্যবহার না করলে রুটি বা কেক হবে না, আটা বা ময়দার দলা হবে। এখন দেখতে হবে আমরা ইস্টের পরিমাণ ঠিকভাবে দিচ্ছি কি না, বেশি দিচ্ছি কি না। বেশি দিলে ভোক্তার স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে। আমি সব সময় এসব বিষয় খেয়াল রাখি, যাতে কোনো অনিয়ম না হয়। সে কারণে পরিদর্শকদের এ বিষয়গুলো মাথায় নিয়ে কাজ করতে হবে। আমরা যদি অনিময় করি, তাহলে আমাদের যে শাস্তি হবে, সেই শাস্তি আমরা মেনে নেব।

সেক্টরে ভ্যাটের পরিমাণ নিয়ে আপত্তি

আমাদের এই সেক্টরে সো ফার ভ্যাট ছিল না। গত বাজেটে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। ভ্যাট আমাদের দিতে আপত্তি নেই। আমরা যারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, তাদের জন্য ভ্যাটের পরিমাণ বেশি হয়ে যায়। আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভ্যাট আরোপ করার জন্য সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ করব। আমাদের যদি ভ্যাটের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠান চালিয়ে নিতে পারব। আমি উদ্যোক্তা হিসেবে, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে অবশ্যই চাইব সরকারকে নিয়ম মেনে ভ্যাট দিতে। কিন্তু আমার ওপর যদি ভ্যাটের পরিমাণ বেশি চাপানো হয়, তাহলে আমি তো চাইব ফাঁক খুজতে, ফাঁকি দিতে। কিন্তু আমি অবশ্যই এই অনিয়ম করতে চাইব না।

আমাদের ব্র্যান্ড নেম ‘গুড ডে’ মানে শুভ দিন

আমরা অনেক ধরনের ব্রেড, বন, কেক, বিস্কুট, টোস্ট, চানাচুর করছি।
আমার সব সময় চেষ্টা থাকে ভালো প্রোডাক্ট তৈরি করার। সে কারণে পানি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে আমি বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করি। পানি নিয়ে ভোক্তাদের কোনো রকম চিন্তার অবকাশ নেই। আমার এখানে যারা কাজ করে, তাদের প্রতি মাসে একবার করে মেডিকেল চেকআপ করাই। আমি তাদের প্রতি মাসে সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডার প্রোভাইড করি। কারখানার হাইজেনিক ব্যাপারটির দিকেও সর্বাধিক নজর দিই। কারণ আমার ভোক্তা বয়স্ক থেকে শিশু পর্যন্ত। এখানে মানের ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।

তারপর প্রোডাক্টের ওজনের ব্যাপারে আমার চেষ্টা থাকে, যাতে ভোক্তা ওজনে বেশি ছাড়া কম না পায়। খাবারের মান নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারেও সর্বোচ্চ নজরদারি করা হয়, তারপর বাজারে ছাড়া হয়। আমাদের বেশ কিছু প্রোডাক্ট বাজারে বেশ চলছে। বিশেষ করে ব্রেড, কাপকেকের চাহিদা ব্যাপক। আমি আশা করব আমাদের ভোক্তাদের আমাদের দেশি প্রোডাক্টের প্রতি যে অজ্ঞতা বা আত্মবিশ্বাসের অভাব রয়েছে সেখান থেকে বের হয়ে আসবে। কারণ আমাদের দেশের প্রোডাক্ট এখন অনেক ভালো মান নিয়ে বাজারে আসছে। আমি ছাড়াও দেশের আরও অনেক বড় বড় ভালো ভালো কনজ্যুমার বাজারে আছে, যাদের প্রোডাক্টের মান অনেক অনেক ভালো। আপনারা আমাদের দেশের পণ্য নিশ্চিত মনে কিনে খেতে পারেন। আমরা বাইরের দেশের প্রোডাক্টের চেয়ে মানের দিক দিয়ে মোটেও পিছিয়ে নেই। কারণ আমাদের পণ্যও বাইরের দেশের ভোক্তারা কিনছে।

পাশাপাশি সরকারের কাছে আমার আবেদন, তারা যাতে আরেকটু মনোযোগ নিয়ে আমাদের মতো উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়ায়। ভ্যাটের পরিমাণ আয়ত্তের মধ্যে রাখে। আমাদের শিল্পে গ্যাসের ব্যবস্থা যাতে কর দেয়। এ ছাড়া আমদানিকারকেরা তাদের ইচ্ছামতো দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে একটা মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা রাখলে আমরা আরও বেশি করে দেশীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারি।

এম এ মোস্তফা জামাল
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, লিডার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড