দেশের বিস্কুট শিল্প বড় হচ্ছে : কাজী তৌহিদুজ্জামান

কাজী তৌহিদুজ্জামান। দীর্ঘদিন বিপণন নিয়ে কাজ করছেন। বর্তমানে অলিম্পিক ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেডের সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের  জেনারেল ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশের উদীয়মান বিস্কুট শিল্পের নানাদিক নিয়ে আজকের বাজার ও এবি টিভির সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁর সঙ্গে কথপোকথনের অনুলিখন তাঁরই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

বিস্কুট শিল্পের সার্বিক অবস্থা
বাংলাদেশে বিস্কুট শিল্পটা কিন্তু বড় হচ্ছে, গ্রো করছে, বাজার বড় হচ্ছে , প্রতিযোগিতা বাড়ছে, নতুন কোম্পানি আসছে, নতুন নতুন প্রোডাক্ট আসছে, পণ্যে  বৈচিত্র আসছে। সাধারণ ভোক্তারা বিভিন্ন ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের পণ্য পাচ্ছেন।  প্রোডাক্টে ভেরিয়েশন আসছে, ভেরিয়েশন বলতে বলছি, প্রোডাক্টের ভেরিয়েশন, টেস্টের ভেরিয়েশন, প্রাইসের ভেরিয়েশন।

বিশ্ব বাজারের অনেক পণ্যই বাংলাদেশে ছিল না । এখন নতুন নতুন অনেক পণ্য এ দেশে আসছে, মানুষ বিভিন্ন প্রোডাক্টের টেস্ট নিতে পারছেন, বিভিন্ন কোম্পানি আলাদা আলাদা পণ্য নিয়ে ব্যবসায় আসছে ফলে ক্রেতা ও ভোক্তাদের জন্য পণ্য বাছাইয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তারা আগে হয়তো এক রকমের বিস্কুট খেতে পারতো কিন্তু এখন নানা ধরনের স্বাদ ও বৈচিত্রের বিস্কুট হাতে পাচ্ছে। এটাই বড় সুবিধা।

অলিম্পিকের ব্যবসা ও বিশেষত্ব
অলিম্পিকের বড় বিশেষত্ব প্রোডক্টের কোয়ালিটি, টেস্ট। এসব কারণে অলিম্পিকের অবস্থান আজ এখানে। আমাদের চেয়েও পুরোনো কোম্পানি ছিল দেশে। যেমন আলামিন বিস্কুট। আবার নতুন করে শুরু হয়েছে যা বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। হক কোম্পানি অনেক পুরোনো, নাবিস্কোও বেশ পুরোনো। তার পরও অলিম্পিক নাম্বার ওয়ান তার কারণ প্রোডক্টের কোয়ালিটি এবং কোয়ালিটির কনসিন্সটেনসি, ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। এনার্জি প্লাস বিস্কুটের ২০ বছর ধরে একইরকম স্বাদ অুন্ন আছে যার জন্য মানুষ এনার্জি প্লাস কখনোই ছাড়েনা। নাটি, টিপ-এর টেস্ট সেই একই রকম, এসবের প্রতি মানুষের বিশ্বাস আছে। বিভিন্ন সময় টেস্টের রকমফের হয় না। কখনো খারাপ টেস্ট আসে না এটা একটা বড় সুবিধা। দ্বিতীয় কারণ হলো, আমাদের পণ্যের গুণমান খুবই রিচ। আমরা ভোক্তার দুয়ারে সব সময়ের জন্য পৌঁছতে পারি, তাদের পাশে থাকি।

এ ধরনের শক্তি-সামর্থ্য সবার নেই। মূলত এই দুটি কারণে অলিম্পিক অনেক সুবিধা পাচ্ছে। কনজ্যুমারের সফট কর্ণার আছে,বিশ্বাস আছে অলিম্পিক পণ্যের  প্রতি, প্রাইস নিয়ে,সর্বোপরি কোম্পানির প্রতি। তাই মানুষ অলিম্পিকের পণ্য কিনতে দ্বিধা করে না। দোকানে অলিম্পিকের কোনও প্রোডাক্ট দেখলে কিনে নিয়ে যায়। আসলে অলিম্পিক  পণ্যের উপর ভোক্তার বিশ্বাস আছে যা একদিনে তৈরি হয়নি। দীর্ঘ দিনের ব্যবসায় এমনটা তৈরি হয়েছে। অলিম্পিক পণ্যের গুণ  ও মানের  ধারাবাহিকতা, দাম, মানুষ হাতের কাছে পাচ্ছে এসব মিলিয়ে অলিম্পিক বিস্কুট আজকের অবস্থানে আসতে পেরেছে।

বিস্কুট শিল্পে ভ্যাট-ট্যাক্সের প্রভাব
বিস্কুট ব্যবসায় এতদিন ট্যারিফ ছিল। ২০১৭ সালের পয়লা জুলাই  থেকে তা উঠে যাবে। ১৫ শতাংশ ভ্যাট থাকবে আর ট্যারিফ উঠে যাবে। এসব কারণে বিস্কুটের ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স বেড়ে যাবে। যেমন, আমরা নাটি বিস্কুটের প্রতি ৭০ গ্রাম’র প্যাকেটে আগে যে ভ্যাট দিতাম তার চেয়ে এখন ১ টাকা ২ পয়সা বেশি দিতে হবে। এনার্জি প্লাস-এ ৬৪ পয়সা বেশি ভ্যাট দিতে হবে। এ রকম প্রত্যেকটি প্রোডাক্টের জন্য বেশি ভ্যাট দিতে হবে। আগে যে ট্যারিফ ছিল,নির্ধারিত দামের ওপর ১৫ভাগ ভ্যাট দিতে হতো এখন সেটা তুলে দেয়া হয়েছে।  বিক্রি-দামের উপর ভ্যাট দিতে হবে। তো সে কারণে খরচ কিছুটা বেড়ে যাবে।

ট্যারিফ নিয়ে বিস্তারিত
এখনো পর্যন্ত বিভিন্ন প্রোডাক্টের ওপর ট্যারিফ আছে। কিন্তু এর পর জুলাই মাস থেকে আর থাকবে না। যেমন, বিস্কিটের বিভিন্ন সেগমেন্ট ঠিক করাই থাকতো যে নির্দিষ্ট সেগমেন্টের  প্রোডাক্টগুলোর পার-কেজি’র কস্ট’র উপর ভ্যাট যোগ হবে।
ব্যবসায়ীদের কিছুটা উৎসাহ দেওয়ার জন্যই এমন ব্যবস্থা ছিল। তো সে ক্ষেত্রে যদি একটা প্রোডাক্টের প্রতি কেজিতে ৮৫ টাকা ট্যারিফ দেওয়া হয় কিন্তু সেই প্রোডাক্টটি বিক্রি করা হয় ১২০ টাকা কেজিতে, তখন ৮৫ টাকাই ভ্যাট দিতে হতো কিন্তু এখন ১২০ টাকা বা ১৫০ টাকা, যে দামেই বিক্রি করা হোক না কেন, ভ্যাট দিতে হবে ওই দামের উপরই। তাই দাম কিছুটা বেড়ে যাবে।

ট্যারিফের প্রভাব
ট্যারিফের ফলে কিছুটা ধাক্কা আসবেই। প্রথম কথা,আমরা যদি দাম না বাড়াই তাহলে লাভের উপর একটা প্রভাব পড়বে। তো কিছু ক্ষেত্রে যদি ট্যারিফটা সহনশীল পর্যায়ে থাকে তাহলে হয়তো আমরা দাম বাড়াবো না কিন্তু অসহনীয় হয়ে গেলে দাম বাড়াতে হবে। এই দাম বাড়ানোর ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভোক্তার উপর চাপ পড়বে। এখন প্রতিযোগিতার বাজারে কেউ ইচ্ছা করলেই দাম বাড়াতে পারবে না তাতে সে নিজেই চাপের মুখে পড়বে। এখানে স্ট্র্যাটেজিক্যাল কিছু ব্যাপার আছে হুট করে দাম বাড়ানো যাবে না, যে ট্যাক্স বাড়বে তাতে দাম নাও বাড়তে পারে। কোনো কোনো পণ্যের দাম বাড়তে পারে তবে তা ব্যতিক্রম হিসেবেই বিবেচিত হবে ।

চূড়ান্ত বাজেট ও আমাদের প্রত্যাশা
আমাদের দাবি হলো, ভ্যাট রেট ১৫ থেকে কমানো বা অন্যান্য র ম্যাটেরিয়ালসের  রিবেট দেওয়া যেতে পারে। তাহলে কিছু ক্ষতি হয়তো পুষিয়ে যাবে। সরকার  যেহেতু ট্যারিফ উঠিয়ে দিচ্ছে তাই সেই জায়গায় এমন কিছু হয়তো হবে না। কিন্তু হলে ভালো হবে।

ট্যারিফ উঠিয়ে দিতে সরকারের যুক্তি
শুধু বিস্কুট নয়,অনেক পণ্যের উপর থেকে ট্যারিফ উঠিয়ে দিচ্ছে সরকার। সরকার এখন একেবারে ফ্ল্যাট-ভ্যাট-রেটে চলে যাচ্ছে। এটা শুধু বিস্কুট শিল্পের জন্যেই নয় অন্য সবার জন্যও প্রযোজ্য।

দাম কম রেখে ভ্যাট সমন্বয় কিভাবে
কস্ট মিনিমাইজ করে ভ্যাট সমন্বয় কিভাবে করা সম্ভব? আমরা প্রথমেই ভোক্তা পর্যায়ে পুরো চাপটা দিব না। বিভিন্ন খাত থেকে খরচ কমিয়ে,দাম না বাড়িয়ে চেষ্টা করবো যাতে টিকে থাকতে পারি। সে ক্ষেত্রে হয়তো ভোক্তারা চাপটা অনুভব করবেন না। আমরা কোম্পানির লভ্যাংশ থেকে কিছু নিয়ে আর খরচ সমন্বয় করে ব্যবসা- কৌশল নির্ধারণের চেষ্টা করবো ।

অলিম্পিক-এ ক্যারিয়ার গড়তে
আমি যদি অলিম্পিক কোম্পানির সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের কথা বলি, তাহলে তারা অনেক নিবেদিত প্রাণ ও আন্তরিক একটা টিম। অলিম্পিকে কাজ করতে চাইলে প্রথম শর্ত-ই হলো নিবেদিত ও আন্তরিক হতে হবে। এখানে কোনোরকম কম কাজ  বা ফাঁকি দেওয়া বা অলসতা করার সুযোগ নেই। অলিম্পিকে তারাই টিকে থাকতে পারে যারা পরিশ্রমী। কারো কোয়ালিটি ডেভলপ হয়ে যায় যদি তার চেষ্টা  থাকে। আমরা তাদেরই অ্যাপ্রিসিয়েট করি যারা পরিশ্রমী, পরিশ্রম করতে ভয় পায় না, যাদের কাজের মধ্যে আন্তরিকতা আছে। অলিম্পকে যারা আছে তারা দীর্ঘ দিন ধরে আছে। যারা নতুন তাদের জন্য অলিম্পিক ফ্রেশ একটা জায়গা, নিজের ক্যারিয়ার গড়ার ভালো একটা জায়গা।

মার্কেটিং কি তরুণদের জন্য উপভোগ্য জায়গা ?
সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং তো এনজয় করারই জায়গা। আমি যদি পৃথিবীর আর সব পেশার কথা বলি, তাহলে বিপণন বিভাগের মতো উপভোগ্য জায়গা আর নেই। এখানে ইনস্ট্যান্ট এনজয় করা যায়। এমন চার্মিং জায়গা আর কোথায়?

একটা উদাহরণ দিয়ে বলছি, একটা ছেলে কোনো দোকানে গিয়ে যদি ১০০০ টাকার অর্ডার কালেক্ট করতে চায় কিন্তু সে যদি ওখান থেকেই ২০০০ টাকার অর্ডার কালেক্ট করে নিয়ে আসতে পারে তখন তার ফিলিংসটা কেমন হয়? সে অনেক উপভোগ করে আর এটাই তো তার অনেক বড় একটা পাওয়া। এই ছেলেটার কাজের গতি তখন বেড়ে যাবে। এই যে তার তৃপ্তি এটা অন্য কাজে পাওয়া যায় না। মার্কেটিং সেক্টরে ভাল করার উপায়  সম্পর্কে বলছি, যদি কারো পরিশ্রম ও আন্তরিকতা থাকে তবেই এখানে কাজ করা সম্ভব। কারো যদি অলসতার চিন্তা থাকে তবে কাজ না করাই উচিৎ। পরিশ্রম, সততা আন্তরিকতা যদি থাকে এখানে কেউ ফেইল করে না।

বিস্কুট শিল্পে চ্যালেঞ্জ
সেই রকম কোনও চ্যালেঞ্জ আসলে দেখছি না। বরং সেক্টর গ্রো করছে। চ্যালেঞ্জ তার জন্যই যে আসলে চ্যালেঞ্জ নিতে পারে না। আন্তর্জাতিকতার ফলে বাজারে নতুন প্রতিযোগিতা তৈরি হবে, নতুন নতুন পণ্য আসবে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশ এখানে অপারেশনে আসবে, তারা নতুন কিছু আনবে। যারা এখন বাজারে আছে তারা যদি তাল মিলিয়ে চলতে না পারে তাদের জন্যই চ্যালেঞ্জ । এগুলো ছাড়া বড় কোনো চ্যালেঞ্জ নেই।  বাংলাদেশের বিস্কুট বাজার একটি সম্ভাবনাময় বাজার।

কাজী তৌহিদুজ্জামান
জেনারেল ম্যানেজার
সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং
অলিম্পিক ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেড