নকশিকাঁথায় ভাগ্য বদল করে জীবন সংগ্রামের চাকা ঘুরিয়েছেন অদম্য নারী সেলিনা আক্তার । স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর সেলিনা মাত্র ২০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ঘরে বসেই নকশিকাঁথার ব্যবসা শুরু করেন। ৬ বছরের মধ্যেই নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করেছেন অন্তত ৫০ জন অসহায় বেকার নারীর।
ভোলা সদর উপজেলার পৌর ৮নং ওয়ার্ডের কাঠালি এলাকার বেপারি বাড়ীর বাসিন্দা মো. আলমের সহধর্মীনি সেলিনা আক্তারের(৩২) তিনি গড়ে তুলেছেন ‘গ্লামার জোন নকশিকাঁথা’ নামের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বেগম রোকেয়া দিবসে জেলা প্রশাসন কর্তৃক পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ জয়িতার পুরস্কার।
জানা গেছে,পারিবারিকভাবে বিয়ের পর উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন সেলিনা আক্তার। সেলিনা আক্তার বাসস’কে জানান,সংসার জীবনে স্বামী ও দুই মেয়েকে নিয়ে প্রথম দিকে ভালোভাবে তাদের সংসার চললেও এক সময় তার সংসারে আর্থিক টানাপোড়েন শুরু হয়। নিজেই বেরিয়ে পড়েন চাকরির খোঁজে। কিন্তু চাকরি না পেয়ে হতাশ হন। ভাবেন, চাকরি ছাড়া টাকা আয় করা যায় না। এরপর ইউটিউবে নকশিকাঁথা ডিজাইন ও সেলাই সিষ্টেম দেখেন এবং সিদ্ধান্ত নেন নিজেই নকশিকাঁথার ব্যবসা শুরু করবেন। বড় ভাইয়ের থেকে ২০ হাজার টাকা ধার নিয়ে নেমে পড়েন এ ব্যবসায়। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
নিজের ইচ্ছেশক্তি এবং একাগ্রতায় নকশিকাঁথা তৈরি করে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন এ নারী। সূত্রমতে, ভোলার মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে ২০২৩ সালে পেয়েছেন ভোলা সদর উপজেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা। বর্তমানে অনলাইন ও অফলাইন দুইভাবেই কাঁথা বিক্রি করছেন তিনি। এই নকশীকাঁথার চাহিদাও রয়েছে বেশ। ৩’শ টাকা থেকে শুরু করে ১৫ হাজার টাকা দামের নকশি কাঁথা রয়েছে তার কাছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকজন নারী এসেছেন তার কাছে নকশিকাঁথা ডিজাইন ও সেলাই শিখতে। আবার কেউ কেউ এসেছেন প্রতিদিনের মতো কাজ করতে।
সেলিনা আক্তার নিজেই তাদের কাজ তদারকি করছেন আবার কাঁথায় ডিজাইন করছেন। বর্তমানে ব্যবসা ও সংসার নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন এ জয়িতা।
সেলিনা আক্তার বলেন, ছোটবেলা থেকেই সেলাই ও আঁকার প্রতি ঝোঁক ছিল তার। সংসার জীবনে আমার মেয়েরা পড়াশোনা শুরু করার পর নানান কারণে সংসারের পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়। তখন চিন্তা করলাম আমার কিছু করার দরকার। প্রথমে মনে করেছিলাম মেয়েরা চাকরি ছাড়া টাকা উপার্জন করতে পারে না। কয়েক বছর চাকরির পেছনে ছুটেও চাকরি পেলাম না। চিন্তা করলাম চাকরি ছাড়া কিছু করা যায় কিনা। হঠাৎ একদিন ইউটিউবে দেখি নকশিকাঁথার ব্যবসা করে অনেকে আয় করছে।
২০ হাজার টাকার সুতা-কাপড় কিনে ব্যবসায় নেমে পড়লাম। এরপর থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। এখন মাসে প্রায় এক লাখ টাকার উপরে আয় করি।
তিনি আরো বলেন, নকশিকাঁথা বিক্রির অর্থ দিয়ে দুই মেয়েকে পড়াশোনা করিয়েছি। এক মেয়েকে ধুমধাম করে বিয়ে দিয়েছি। একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দিয়েছি।
আলহামদুলিল্লাহ আমার সংসারও এখন ভালো চলছে। এছাড়া আমার প্রতিষ্ঠানে ৫০ থেকে ৬০ জন নারী কাজ করে। তারা অনেকে নিজেরাও নিজেদের মতো ঘরে বসে কাজ করে উপার্জন করছেন। নারীদের ঘরে বসে না থেকে কিছু করার পরামর্শ এ উদ্যোক্তার।
সেলিনা আক্তারের কলেজ পড়ুয়া মেয়ে ইসরাত জাহান মিম বলেন,পড়াশোনার পাশাপাশি আম্মুকে নকশিকাঁথার কাজে সাহায্য করি। আমি এখন ডিজাইন ও সেলাইয়ের কাজ করতে পারি। এতে আম্মুর অনেক সাহায্য হয়।
সেখানে কাজ করতে আসা কুলসুম ও সাজেদা নামের অপর দুই নারী বলেন, স্বামী রিকশা চালায়। সংসারে চারজন সদস্য। স্বামীর রোজগারে হয় না। এখানে কাজ করে যে টাকা পাই সে টাকা সংসারে ব্যয় করি। আমরা কোনো কাজ না পারলে সেলিনা আপা তা দেখিয়ে দেন। আকারভেদে প্রতিটি কাঁথা থেকে ২’শ থেকে ৪’শ টাকা পাই। এখানে কাজ করে যে টাকা পাই এতে আমাদের সন্তানদের পড়াশোনার খরচ মিটাতে পারি। বর্তমানে আমরা অনেক ভালো আছি।
সেলাই শিখতে আসা ফেরদৌস বেগম বলেন, সেলিনা আপার কাছ থেকে নকশিকাঁথা সেলাইয়ের কাজ শিখতে আসছি। এখান থেকে কাজ শিখে বাড়িতে গিয়ে নিজেরাও নিজেদের মতো করে নকশি কাঁথা সেলাই করার পর বিক্রি করে কিছু টাকা আয় করি।
জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ইকবাল হোসেন বাসস’কে বলেন, সেলিনা আক্তার সফল ও সংগ্রামী নারী। তিনি তার সংগ্রামের মাধ্যমে নিজে সাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি জেলার অসহায়-বিধবা নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। তার যে কোনো প্রয়োজনে আমরা তার পাশে আছি। ২০২৩ সালে সেলিনা আক্তারকে অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসেবে শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা দেয়া হয়। ভোলার নারীদের সাবলম্বী করতে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর নানা পদক্ষেপের কথাও জানান তিনি।(বাসস)