নিজস্ব অর্থায়নে লালদিয়া টার্মিনাল করা সম্ভব

লালদিয়া টার্মিনাল বিদেশি কোন প্রতিষ্ঠানকে না দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজে নির্মাণ করলেই বাংলাদেশ লাভবান হবে বলে মন্তব্য করেছেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রাক্তন সভাপতি এম এ লতিফ এমপি।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণ বিষয়ক প্রকল্পের রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল (আর এফ পি) এর টর (শর্ত) নির্ধারণের বিষয়ে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। সভার শুরুতে বুয়েট প্রতিনিধি ড. রাকিবুল হোসাইন স্লাইড প্রেজেন্টেশানের মাধ্যমে তাদের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের রিপোর্ট তুলে ধরেন।

বন্দর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যবহারকারীদের নিয়ে রোববার ২৮ জানুয়ারি দুপুরে বন্দর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র মিলনায়তনে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান অতিথি বলেন, ‘প্রায় দুই যুগ ধরে লালদিয়া টার্মিনাল, বে টার্মিনাল ও পতেঙ্গা টার্মিনাল নির্মাণের কথা চলে আসছে। অবশেষে লালদিয়া টার্মিনাল বাস্তবায়নের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এটি অবশ্যই সুখবর।’

তিনি বলেন, ‘দেশের সক্ষমতা না থাকলেও, চট্টগ্রাম বন্দরের আর্থিক সক্ষমতা সবসময়ই ছিলো। বন্দরের যে পরিমাণ নগদ অর্থ রয়েছে, তা দিয়ে লালদিয়া টার্মিনাল কয়েকটি বানানো সম্ভব। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে দৌঁড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই। চট্টগ্রাম বন্দর নিজেই এই টার্মিনাল নির্মাণ করে, এরপর ব্যবহারের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে লিজ দেওয়া যেতে পারে।

এতে শুধু বন্দরের নয়, দেশেরই লাভ। বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে পুরো প্রকল্পটি দিয়ে দিলে, বিভিন্ন শর্তারোপ করে আলাপ-আলোচনা করার পরও অনেক সময় দেশের স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব হয় না। তাই বন্দরের উচিৎ নিজের অর্থায়নে এই টার্মিনাল তৈরি করা।’

তিনি আরো বলেন, ‘দেশের অবকাঠামোর যে অভাবনীয় উন্নয়ন হচ্ছে, তার সঙ্গে বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সারাদেশে শতাধিক ইকনোমিক জোন তৈরি করতে বলেছেন। দেশের অর্থনীতিতে এটি ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। চট্টগ্রাম বন্দরকেও এ উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আগাতে হবে। বন্দর উন্নত না হলে অর্থনীতিতে কাঙ্খিত উন্নয়ন হবে না।’

চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম খালেদ ইকবালের সভাপতিত্বে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি বলেন, লালদিয়া মাল্টি-পারপাস টার্মিনাল প্রকল্প চট্টগ্রাম বন্দরের প্রথম পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ(পিপিপি) প্রকল্প। সারা বিশ্বেই বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল অপারেটর দিয়ে বন্দরগুলো পরিচালিত হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে তা এই প্রকল্পের মাধ্যমে শুরু হতে যাচ্ছে। ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে রিকোয়েন্ট ফর কোটেশান (আর এফ কিউ) দিয়ে বিপুল সাড়া পাই। সেখান থেকে পাঁচটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা এখন রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল (আরএফপি) নিয়ে আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছি। সেক্ষেত্রে টরগুলো (শর্ত) কি হবে তা আমরা এই সভার আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারণ করবো।

তিনি আরো জানান, সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ টার্মিনাল নির্মাণ করে আগামী দুই বছরে এটি ব্যবহার শুরু করা সম্ভব। পঁচিশ বছর ব্যবহারের পর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এই টার্মিনাল বন্দরকে হস্তান্তর করবে।

সভায় সিএন্ডএফ এজেন্টস এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন বাচ্চু বলেন, ‘এই টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই চট্টগ্রাম বন্দরের হাতে থাকতে হবে। কোন জাহাজ কোথায় আসবে সেটা চট্টগ্রাম বন্দরের বার্থ মিটিংয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোন বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে এই টার্মিনালের একক দায়িত্ব দেওয়া উচিৎ হবে না। এছাড়া, লালদিয়া টার্মিনালেও যেন চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ বহাল থাকে আমি সেটা সুপারিশ করছি। শ্রমিক মজুরি হারও চট্টগ্রাম বন্দরকেই নির্ধারণ করে দিতে হবে।’

চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, ‘সরকারি কাজের যে ধীরগতি সবসময় আমরা দেখে আসছি, তা এই পিপিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এই সমস্যা সমাধান আশু প্রয়োজন।

এছাড়া, চট্টগ্রামে বর্তমানে নির্মাণাধীন মেরিন ড্রাইভের সঙ্গে লালদিয়া টার্মিনালকে সংযুক্ত করা গেলে চট্টগ্রাম শহরের মধ্যদিয়ে বন্দরের কার্গো যাতায়াত করতে হবে না। এতে ভোগান্তি নিরসন হবে এবং কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ের খালি জায়গাগুলোকেও এই প্রকল্পের আওতায় এনে কাজে লাগানো যেতে পারে।’

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান কার্যক্রমে ব্যবহৃত বড় বড় যান চলাচলের কারণে নগরীর সল্টগোলা থেকে সিমেন্ট ক্রসিং পর্যন্ত দীর্ঘ যানজট লেগে থাকে। বন্দর ট্রাফিকের সঙ্গে নগর ট্রাফিকের মধ্যে সমন্বয় করা জরুরি। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত নগরবাসীর অন্যতম বিনোদনের জায়গায়। পাশেই রয়েছে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর। তাই এই দুটো বিষয়কে মাথায় রেখে নতুন টার্মিনালের যান চলাচলের রুট নির্ধারণ করতে হবে।

চট্টগ্রাম চেম্বার পরিচালক অঞ্জন শেখর দাস বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এই টার্মিনাল নির্মাণ সময়োপোযোগী সিদ্ধান্ত। বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি অবশ্যই কানেকটিভিটির উপরও জোর দিতে হবে। প্রয়োজনে নতুন রোড, ওভারব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। নতুন টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ চট্টগ্রাম বন্দরের হাতেও থাকতে হবে। ব্যবসায়ীরা যাতে কারো কাছে জিম্মি হয়ে না পড়েন, সেটা দেখতে হবে।

আমরা জেনেছি এই টার্মিনাল নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করার ২৫ বছর পর চট্টগ্রাম বন্দরকে হস্তান্তর করা হবে। এটি যেন দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহার উপযোগী করে বানানো হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া কন্টেনার হ্যান্ডেলিংসহ সর্বক্ষেত্রে সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে বন্দর কর্তৃপক্ষকে।’

বাংলাদেশ ফ্রেইড ফরোয়াডার্স এসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর এবং নতুন যেসব টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে সেগুলো থেকে পঞ্চাশ বা ততোধিক ওয়াগন বিশিষ্ট ট্রেনের মাধ্যমে বাইরে কোথাও পণ্য স্থানান্তর করে সেখান থেকে পণ্য পরিবহন করা প্রয়োজন। না হয়, বন্দরে শুধু পণ্য ওঠা-নামার কাজই হওয়া উচিৎ। এখান থেকেই যদি পণ্য পরিবহন করা হয় তবে চট্টগ্রাম শহর যানজটমুক্ত রাখা সম্ভব হবে না।’

শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের সভাপতি আহসানুল হক চৌধুরী বলেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নতুন টার্মিনাল নির্মাণ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া ড্রেজিং কে করবে সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। ড্রেজিংয়ের দায়িত্ব টার্মিনাল নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার সুপারিশ করছি আমি। তাছাড়া ট্যারিফ নির্ধারণও বন্দর কর্তৃপক্ষের হাতে থাকতে হবে।’

মায়ের্সক বাংলাদেশ লিমিটেডের অপারেশন ম্যানেজার সরোয়ার আলম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা জেনেছি লালদিয়া টার্মিনালে চারটি বার্থ থাকবে, তারমধ্যে দুটি থাকবে কন্টেনার টার্মিনাল। কিন্তু বর্তমানের প্রয়োজনের তুলনায় এটি যৎসামান্য। তাই পৃথিবীর অন্যান্য বন্দরের মতো এই টার্মিনালের সঙ্গে মূল বন্দরের সমন্বয়ের মাধ্যমে আইটিটি ফ্যাসিলিটি বাড়াতে হবে।’

চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী খায়রুল মোস্তফা বলেন, ‘২৫ বছরের জন্য যারা আমাদের এখানে আসবেন, তাদেরকে অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। আর এফ পি’তে কমার্শিয়াল অপারেশন ডেট গ্যারান্টি, অপারেশন পারফর্মেন্স গ্যারান্টির শর্ত নিশ্চিত করতে হবে।

পরিবেশ অধিদপ্তর প্রতিনিধি সেলিনা আক্তার বলেন, টার্মিনাল নির্মাণের টর নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমাদের অধিদপ্তরের কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। টার্মিনাল নির্মাণের পূর্বেই সাইট ক্লিয়ারেন্স নিতে হবে।’