ভোটের চাপে ভ্যাট যেন হারিয়ে না যায়

কারিগরি প্রস্তুতি ও রাজনৈতিক ঐক্যমতের অভাব এবং সামাজিক তাৎপর্যকে অনুধাবন করতে না পারায় নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কিন্তু দুই বছর পর নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। নির্বাচনের ডামাডোলে যেন ভ্যাটের প্রস্তুতি হারিয়ে না যায়।

১০ জুলাই সোমবার রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে ‘২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট পরবর্তী পর্যবেক্ষণ’ বিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

তিনি বলেন, ভ্যাট আইন কার্যকর হয়নি বলে ভ্যাট সম্পর্কিত সব কার্যক্রম বন্ধ করে দিলে হবে না। দুই বছর পর বা নির্বাচনের পরই নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের কথা বলা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে যে সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে- সেগুলোকে এগিয়ে নিতে হবে। নির্বাচনের পর যখন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করা হবে- তখন সবকিছু যেন নতুন করে শুরু করতে না হয়।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, নতুন ভ্যাট আইনকে টেনে তোলার জন্য এই দুই বছরে আরও বেশি প্রস্তুতি নিতে হবে। সেজন্য ভ্যাট অনলাইন প্রকল্প চালু রাখা ও সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

তিনি বলেন, নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হয়নি। কেন বাস্তবায়ন করা গেল না- তার মূল্যায়ন করে শিক্ষা নেওয়া উচিৎ। আমরা মনে করি, ৩টি কারণে ভ্যাট আইন কার্যকর হয়নি। সেগুলো হলো- কারিগরি বা টেকনিক্যাল প্রস্তুতিতে ঘাটতি; রাজনৈতিক নেতাদের মত পার্থক্য এবং প্রশাসনিক দূরদর্শীতা ও রাজনৈতিক দক্ষতার অভাব।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কারিগরি বা টেকনিক্যাল প্রস্তুতিতে ঘাটতির ফলে ভ্যাট আইনের প্রয়োগ এবং এর প্রভাবের ব্যাপারে সামগ্রিক স্বচ্ছতা ছিল না। অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের যথেষ্ট সক্ষমতা বৃদ্ধির করার প্রয়াস কম ছিল। ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক নেতাদের মতের ভিন্নতা ছিল। এছাড়া ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের ফলে কী প্রতিক্রিয়া আসতে পারে- তা আগে থেকে অনুধাবন করা হয়নি। প্রশাসনিক দূরদর্শীতা এবং রাজনৈতিক দক্ষতার অভাবে এমনটি হয়েছে।

তিনি বলেন, নতুন ভ্যাট আইনের পক্ষে অবস্থান করছে সিপিডি। আমরা সব সময় বলে আসছে, নতুন ভ্যাট আইন একটি আধুনিক পদ্ধতি। এর মাধ্যমে কর আহরণ, সমতা বিরাজ ও প্রতিযোগিতা সৃষ্টির সুযোগ বাড়বে। তবে আমাদের প্রেক্ষাপটে ১৫ শতাংশ ভ্যাট যৌক্তিক নয়। এটাকে ১২ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছিলাম। ১২ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণ করে কারিগরি প্রস্তুতি নেওয়া হলে নতুন ভ্যাট আইনের এমন পরিণতি হতো না।

সিপিডির সম্মানীত ফেলো বলেন, ভ্যাট আইন কার্যকর না হওয়ায় আমদানি পর্যায়ে এর খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। সম্পূরক শুল্ক অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে প্রয়োগের ফলে রাজস্ব কিছুটা বাড়তে পারে। যে সব সেবা খাতে খণ্ডিত ভিত্তিতে ভ্যাট হিসাব করা হতো- সেখান থেকে ভ্যাট বেশি আসবে।

তিনি বলেন, ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হওয়া ভ্যাট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় ঘাটতি থাকবে। ভ্যাট ঘাটতি পূরণের জন্য প্রত্যক্ষ কর, এনবিআর বর্হিভূত রাজস্ব আদায় ও কর বর্হিভূত রাজস্ব আদায়ে জোর দিতে হবে।

বাজেট ঘাটতি সম্পর্কে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, গত ১০ বছর ধরে বাজেট, সংশোধিত বাজেট ও প্রকৃত অর্জন- এই তিনটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাজেট ঘাটতির হিসাব করা হচ্ছে। প্রতি বছরই সংশোধিত বাজেটে ২০-৩০ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়।

তিনি বলেন, অর্থবছরের শেষে সংশোধিত বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা তা অর্জন দেখানো হচ্ছে। মূলত বাজেটের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হচ্ছে না; সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হচ্ছে। এবারও মূল বাজেটের লক্ষ্যমাত্রায় রাজস্ব ঘাটতি ৩৭ হাজার কোটি টাকা। মূলত প্রাক্কলনের গুণগত মান না থাকায় এই ঘাটতি হয়েছে।

দেবপ্রিয় বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রাজস্ব বোর্ডের প্রবৃদ্ধি ১৯ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছরে ঘাটতি থাকবে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। আর যে হারে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে সে হিসেবে ধরলে, প্রবৃদ্ধি হবে ১৫ শতাংশ; এমনটি হলে ঘাটতি থাকবে ৫১ হাজার কোটি টাকা। আর জিডিপির সঙ্গে তুলনা করলে রাজস্ব ঘাটতি হবে ৫৫ হাজার কোটি টাকা।

তিনি বলেন, ভ্যাটের ঘাটতি পূরণে ব্যক্তি খাতে কর আদায় বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে করযোগ্য এক তৃতীয়াংশ মানুষও কর দেয় না। রাজস্ব ঘাটতি দূর করতে এলাকাভিত্তিক, পেশাভিত্তিক আয়কর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। করের ভিত্তি প্রসারিত না হলে বর্তমান করদাতাতের অত্যাচার করা হবে।

তিনি আরও বলেন, ট্যাক্সনেট বাড়াতে ট্যাক্সের সুবিধাগুলোর দেশের অন্যান্য বিভাগে সম্প্রসারণ করতে হবে। এনবিআরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে জনবল ও অবকাঠামো সুবিধা দিতে হবে।

দেবপ্রিয় বলেন, প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। দেশের আইনি এবং বেআইনি আয় দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে সৎ উপার্জনকারীরা করের চাপে থাকবে- এটা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। অবৈধ অর্থ উপার্জন ও পাচারকারীদের নাম-পরিচয় ঘোষণা হওয়ার পরও যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে সৎ করদাতাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। পাচার রোধ এবং প্রত্যক্ষ কর আদায়ে জোর দিতে হবে।

ফোর-জি লাইন্সেস সম্পর্কে তিনি বলেন, এই বছর ফোর-জি লাইন্সেস থেকে কর বর্হিভুত অনেক আয় হবে। ফোর-জি বিক্রির ক্ষেত্রে বাঁধা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে লক্ষ্য রাখতে হবে। সম্প্রতি একটি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে; দুইটি একীভূত হয়েছে। প্রতিযোগিতা ও সর্বোচ্চ বিক্রি বাড়াতে বাইরে থেকে বিনিয়োগকারী নিয়ে আসতে হবে।

আজকের বাজার:এলকে/ এলকে/ ১০ জুলাই ২০১৭