হাওরে হাঁসের খামার করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন এ অঞ্চলের কৃষকেরা। হাওরে রয়েছে প্রকৃতির নানান বৈচিত্র্য, এখানে বর্ষায় এক রূপ, শীতকালে অন্যরূপ।হাওর প্রকৃতির এমন বৈচিত্র্যময় চরিত্রের সাথে তাল মিলিয়ে এ অঞ্চলের কৃষকেরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্যে ভিন্ন কিছু করার। ধান, মাছ চাষ করার পাশাপাশি হাওরে এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে হাঁসের খামার।হাওরে ধান উৎপাদনে প্রাকৃতিক দুর্যোগে অনেক সময় ফসল নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে।
কিন্তু হাঁসের খামারে এমন সম্ভাবনা কম থাকায় নিশ্চিত মুনাফার আশায় এ অঞ্চলে হাঁসের খামার দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাসস প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলছিলেন নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলার মেন্দিপুরের নূরপুর বোয়ালি গ্রামের বাসিন্দা ২৬ বছর বয়সী সজল মিয়া, হাওরপারে তাঁর একটি হাঁসের খামার রয়েছে। ৩১০০ শত হাঁসের এ খামারটিতে ডিম দেয় প্রায় ১৮০০ টি হাঁস।তার খামারে হাঁসের বাচ্চা উৎপাদন করা হয়,হাঁসের বাচ্চা, ডিম এবং হাঁস বিক্রি করে বছরে ৬০-৭০ লাখ টাকা আয় করেন তিনি।তার খামারে চৈত্র মাসে হাঁসের বাচ্চা উৎপাদন করা হয় এবং সে বাচ্চা জৈষ্ঠ্যমাসের শেষের দিকে বিক্রি করে দেওয়া হয়,তার খামার থেকে ডিম পাঠানো হয় ঢাকা, নোয়াখালী, বরিশাল, ভোলাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়।কৃষক বাবার সংসারে আর্থিক টানাপোড়ন চলছিল, বাবাকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করার জন্যে ই তিনি এ খামার গড়ে তুলেন।প্রাতিষ্ঠানিক কোন প্রশিক্ষণ না থাকলেও হাওরাঞ্চলে অনেক কৃষক বংশ পরম্পরায় পূর্বপুরুষদের শেখানো পদ্ধতিতে কৃষিকাজ ও হাঁস পালন করে আসছেন।
হাওরপারের বোয়ালী গ্রামের কৃষক আলী হোসেন জানান,
" ধান চাষের পাশাপাশি হাঁসের খামার করে আমরা লাভবান হচ্ছি,বন্যার পানি এসে অনেক বছর আমাদের ফসল নষ্ট করে দেয়,ফসল নষ্ট হলে আমরা তা ঘরে তুলতে পারি না।বছরে একটিমাত্র ফসল নষ্ট হয়ে গেলে সারাবছর আমাদের কষ্ট করে চলতে হয়,ফসল বিক্রি করেই আমাদের সংসার খরচ চলে,এজন্যই ধান চাষের পাশাপাশি আমরা লাভজনক কিছু করার চেষ্টা করছি,হাঁসের খামারে কম সময়ে বেশি লাভ করা যায়"
একই গ্রামের বাসিন্দা সোনা মিয়া জানান,
"হাঁস পালনে তেমন কোন ঝুঁকি না থাকায় কম সময়ে আমরা বেশি লাভবান হতে পারি, বর্ষায় মাঠঘাট যখন পানির নিচে থাকে তখন আমাদের বিকল্প কিছু করার থাকে না।হাঁসের খামার করে তখন আমরা সময় কাটাই,এতে একই সঙ্গে আমাদের নিজেদের আমিষের চাহিদা মিটাই এবং হাঁসের মাংস, ডিম বাজারে বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হই"
নেত্রকোনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাসস প্রতিনিধিকে জানান,
"নেত্রকোনার মানুষ এখন হাঁসের খামার করার জন্য বেশ আগ্রহী এবং তারা খামার করে লাভবান হচ্ছেন।আমরা ইতিমধ্যে এলডিডিপি প্রজেক্টের মাধ্যমে হাঁসের প্রডিউসার গ্রুপ (পিজি) তৈরি করেছি এবং সে সমস্ত পিজিকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে খামারিদের উন্নত, আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা লাভের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে,হাঁসের যেসব রোগবালাই হয় সেগুলোর জন্যে ভ্যাক্সিন দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি,বিশেষ করে ডাকপ্ল্যাগ এবং ডাক কলেরা,আমাদের প্রতিটি উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে পর্যাপ্ত ভ্যাক্সিনের ব্যবস্থা রয়েছে এবং খামারিদেরকেও আমরা উদ্ভুদ্ধ করছি তারা যেন ভ্যাক্সিন দেয়।হাঁসের এসব রোগ যদি প্রতিরোধ করতে পারি তাহলে এ পেশায় আরো অধিক সংখ্যক লোক সম্পৃক্ত হবেন।আশা করি আমরা খুব তাড়াতাড়ি এর একটি সুফল পাবো।হাঁসের মাংসের ব্যাপক চাহিদা বাংলাদেশে,এখান থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হাঁস সরবরাহ করা হচ্ছে, হাঁসের মাংস এবং ডিমের জনপ্রিয়তা দেশব্যাপী তৈরি হয়েছে। আমাদের নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার কুটুরিকোনা গ্রামে প্রায় ২০০ টি পরিবার হাঁসের বাচ্চা উৎপাদন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন । এখানকার হাঁসের বাচ্চা দেশব্যাপী সরবরাহ করা হচ্ছে।হাঁস লালন পালনে সকল প্রযুক্তিগত সহযোগিতা জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে দেয়ার সর্বোচ্ছ চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে নেত্রকোনা জেলায় সরকারিভাবে একটি হাঁসের হ্যাচারি স্থাপন করা হয়েছে, এখানে থেকে উৎপাদিত হাঁসের বাচ্চা এ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সরবরাহ করার পাশাপাশি আশেপাশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে। আমরা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনবল তৈরি করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।নেত্রকোনা জেলায় হাঁসের উৎপাদন এবং হাঁসের খামারে কিভাবে আরো সম্পৃক্ততা বাড়ানো যায় সে লক্ষ্যে আমি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।"
উল্লেখ্য যে, জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের তথ্যমতে নেত্রকোনা জেলায় ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ডিম, মাংস, দুধ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রায় ডিমের চাহিদা ছিলো ৫৩ কোটি,উৎপাদন হয়েছে ৫৩.৮০ কোটি, মাংস উৎপাদনের চাহিদা ছিলো ১.৭৩ লক্ষ মেট্রিক টন, উৎপাদন হয়েছে ১.৮০ লক্ষ মেট্রিক টন দুধ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ২.৮০ লক্ষ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছে ২.৯০ লক্ষ মেট্রিক টন। (বাসস)