নোয়াখালীতে কানের দুল বিক্রির টাকায় সফল খামারি নাজমা আক্তার

নিজের কানের স্বর্ণের দুল বিক্রি করে একটি প্রায় ২০ বছর আগে একটি দুধেল গাভী কিনেছিলেন গৃহবধূ নাজমা আক্তার (৩৯)। সেই একটি গাভীর দুধ বিক্রির আয় থেকে বাড়তে বাড়তে এখন তার খামারে গাভী ও বাছুরের সংখ্যা ৬০ টি। সাদা দুধের নহরে গ্রামের নববধূ থেকে ধীর ধীরে হয়ে উঠেছেন প্রতিষ্ঠিত খামারী এবং একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন চারজন শ্রমিকের। তাদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য খরচ বাদে গরুর দুধ বিক্রি করে মাসে গড়ে তার আয় প্রায় লাখ টাকা। চলার পথে রয়েছে নানা প্রতিকূলতা ও প্রতিহিংসা। সেসব প্রতিকূলতাকে জয় করে আরো সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চান তিনি।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের একলাশপুর গ্রামের নিজের বাড়িতে স্বামীর পাশে বসেই সফলতার গল্প বলছিলেন গৃহবধূ নাজমা আক্তার। তুলে ধরেন গরু লালন-পালনের শুরু থেকে খামারি হয়ে ওঠা এবং এর পেছনে ফেলে আসা নানা সফলতা ও কষ্টের কথা। তুলে ধরেছেন সরকারি কোন ঋন সহায়তা না পেয়েও করোনা ও বন্যার ভয়াবহ ক্ষতি কাটিয়ে কীভাবে টিকে আছেন সেই কাহিনীগুলো।

শুরুর দিকের কথা: ২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিয়ে হয়েছিল নাজমার। স্বামী মো. নুরুল আমিন থাকনে চট্টগ্রামে। সেখানে তিনি কাপড়ের ব্যবসা করতেন। বিয়ের পর সংসারের কাজকর্ম শেষে প্রায় সারাদিনও অলস সময় কাটত তার। এরই মাঝে মনে ভাবনা আসে বাড়িতে অবসর সময় নিজের চেষ্টায় কিছু একটা করার। স্বামীর কাছে আবদার করেন একটা গাভী কিনে দেওয়ার। স্বামীর কাছ থেকে টাকা খরচ না হয়, সে জন্য নিজের কানের এক জোড়া দুল তুলে দেন স্বামীর হাতে। ওই কানের দুল বিক্রি করা ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ফ্রিজিয়ান জাতের একটি গাভী কিনেছিলেন তিনি।

নাজমা আক্তার বলেন, প্রথম কেনা গাভীটি রাখার জন্য বাড়িতে আলাগা গোয়াল ঘরও ছিল না। তাই তিনি গাভী রাখার জন্য তিনি বাড়িতে রান্না ঘরকে বেছে নেন। রান্না ঘরের এক পাশে কোন রকমে রান্না করতেন। আরেক পাশে গরু রাখতেন। গরুকে ঘাস, খড় খাওয়ানো, গোসল করানো, গরুর দুধ দোহন, বিক্রি সব নিজেই করতেন। ওই গাভীর দুধ বিক্রি করে যে আয় হতো সেই টাকা খরচ না করে সঞ্চয় করতেন। ওই গাভীর বাছুর বড় হয় সেও বাচ্চা দেয়। এদিকে গাভীও পুণরায় একের পর এক বাচ্চা দিতে থাকে। এভাবে বাড়তে থাকে খামারের আকার।

নাজমা আক্তার বলেন, তার খামারে গরুরর সংখ্যা যখন ১০টিতে পৌঁছে, তখন চিন্তা করে খামারকে আরও বড় করার। বাড়ির পাশের প্রায় ৫০ শতাংশ জায়গা নতুন করে খামারের জন্য ঘর নির্মাণ করে সেখানে গরু লালন পালন শুরু করেন। এদিকে স্বামীকে উৎসাহিত করেন ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে খামারের দেখাশোনা করতে। স্বামী-স্ত্রী মিলে শুরু হয় নতুন পথচলা। ২০ বছরে খামারের পরিধি বেড়ে বর্তমানে গরুর সংখ্যা ৬০টি। খামারের নাম দিয়েছেন নাজমা ডেইরী।

নাজমা আক্তার জানান, স্বামী নুরুল আমিন চট্টগ্রামের ব্যবসা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে এসে যখন খামার দেখাশোনার কাজে যোগদেন তখন তার ভাবনায় আসে ডেইরীর খামারে গরু মোটাতাজা করার ব্যবসার। যে ভাবনা সেই কাজ, তিনিও ডেইরীর পাশাপাশি খামারে গরু মোটাতাজাও করেন। বছরের দুই ঈদে এবং শবেবরাত সামনে রেখে বিভিন্ন বাজার থেকে ছোট গরু কিনে এনে খামারে লালন পালন করে তা বাজারে বিক্রি করেন। সেটি পুরোটাই তার স্বামী দেখাশোনা করেন। তাতে বাড়তি একটা আয় হয় প্রতি বছর।

নাজমার ফার্মের দুধে তৈরী হচ্ছে দই, মিষ্টি: নুরুল আমিন বলেন, তাদের খামারে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ২০০ লিটার দুধ উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত দুধ তিনি পাইকারী দরে বিক্রি করে দেন জেলা শহরের একাধিক নামি-দামি রেস্তোরায় ও মিষ্টি তৈরীর দোকানে। ওই দুধ দিয়ে দোকানিরা নানা প্রকারের মিষ্টি, দুই তৈরী করে বিক্রি করেন। ক্রেতাদের কাছে তাদের ফার্মের দুধের আলাদা একটা চাহিদা রয়েছে। তবে বর্তমানে গো-খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আয়ে বেশ টান পড়েছে। আগে যে পরিমান আয় ছিল, বর্তমানে সব খরচ বাদ দিয়ে আয় অনেক কমে গেছে। এরপরও খামার নিয়ে আরও এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন তাদের।

করোনা ও বন্যায় বড় ক্ষতি: নাজমা আক্তার বলেন, করোনাকালে তার খামারে প্রতিদিন দুধ উৎপাদিত হতো প্রায় ৩০০ লিটার। লকডাউনের কারণে হোটেল রেস্তোরা বন্ধ ছিল। উৎপাদিত দুধ নিয়ে কতই না ভোগান্তিতে পড়েছিলেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঝুড়ি ভর্তি করে দুধ নিয়ে বাড়ির পাশের রাস্তয় গেলেও পুলিশ ধাওয়া করতো। পুলিশের ভয়ে মানুষজন ঘর থেকে বের হতে পারতো না। বাধ্য হয়ে শত শত মন দুধ আশেপাশের মানুষকে বিনা পয়সা দিতে হয়েছে। পাশাপাশি দুধের উৎপাদন কমিয়ে আনার জন্য গাভীগুলোকে খাবার খাওয়ানো কমিয়ে দিয়েছেন। কারণ খাবারের ওপর দুধের উৎপাদন নির্ভর করে।

নাজমা বলেন, করোনায় খামার বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। নামমাত্র মূল্যে বেশকিছু গরু বিক্রি করে দিয়েছেন। এরপর করোনা কমে এলে পুনরায় ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করেন। দুই বছরের মাথায় আবার দুধের উৎপাদন বাড়ে। নতুন করে আশার আলো দেখছিলেন দুচোখে। কিন্তু গত বছরের বন্যায় নতুন সংকটে পড়েন। গরুর খামারে কোমর সমান বন্যার পানি। একে একে গাভী ও বাছুর মারা যেতে থাকে। এক পর্যায়ে বাড়িতে নিজেদের থাকার পাকা ভবনের ভেতর খামারের সবগুলো গরু গাদাগাদি করে রেখে খামার টিকিয়ে রাখেন। এত কিছুর পরও বন্যার কারণে তার খামারের ১৫টি গাভী ও বাছুর মারা গেছে। যে গুলোর বাজার মূল্য ছিল ২৮ থেকে ৩০ লাখ টাকা। এত কিছুর পরও হাল ছাড়েননি। বন্যার পর পুনরায় খামার সংস্কার করে খামারে গরু লালন পালন করছেন।

পাননি সরকারি-বেসরকারি ঋন সহায়তা: নুরুল আমিন বলেন, মানুষের কাছে শুনেন ডেইরীখাতের উন্নয়নে সরকার স্বল্পসুদে খামারিদের ঋন দিয়ে থাকেন। বিভিন্ন সময় নানা প্রণোদনা দেন। কিন্তু করোনা ও বন্যায় তিনি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগস্ত হলেও সরকারি কোন ঋন সহায়তা কিংবা প্রণোদনা পাননি। এবারের বন্যায় ৩০ লাখ টাকার গরু হারিয়েছেন। উপজেলা প্রাণী সম্পদ দপ্তর থেকে সহায়তা পেয়েছেন মাত্র এক হাজার টাকা। এ ছাড়া একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার ঋন ছিল। বন্যায় যখন মানুষ ঠিকমতো খেতে পারেননি, তিনি তাদের ঋনের কিস্তি পরিশোধ করেছেন। পরবর্তীতে নতুন করে ঋন চাওয়ার পর বলা হয়, ক্ষতিগ্রস্ত খামারিকে ঋন দিলে টাকা আটকে যাবে। তাই নতুর ঋন পাননি।

হিংসার আগুনে পুড়েছে খড়ের গাঁদা: নাজমা আক্তার বলেন, স্বামী, সন্তান ও চারজন কর্মচারী নিয়ে তিনি অনেক পরিশ্রম করে খামার দাঁড় করিয়েছেন। দিনে দিনে তার খামারের আকার বেড়েছে। তার এই সাফল্যএলাকার কোন কোন মানুষের চোখে সইছে না। তারা নানাভাবে তাকে ঘায়েল করতে উঠেপড়ে লেগেছে। মাসখানেক আগে তার প্রায় তিন লাখ টাকা মূল্যের খড়ের গাঁদায় আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। জেলা শহর থেকে ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নেভান। কিন্তু ততক্ষনে তার সব খড় পুড়ে যায়।

স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের ঘর নাজমার: নারী উদ্যোক্তা নাজমা আক্তার দম্পতির সংসারে তিন ছেলে। বড় ছেলে তানিম ভূঁইয়া স্নাতক সম্মান তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত। মেঝ ছেলে তানজিম ভূঁইয়া এসএসসি পরীক্ষার্থী। আর ছোট ছেলে তামিম ভূঁইয়া পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে। বাবা-মায়ের পাশাপাশি তারা তিন ভাই মিলেমিশে খামারের কাজে সহায়তা করেন। তিনি বলেন, ছেলেদের বাহিরে আড্ডা দেওয়া অভ্যাস গড়ে উঠেনি। তারাও খামারের কাজে সহায়তা করে আনন্দ পায়।

প্রাণী সম্পদ দপ্তর যা বলল: জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, নাজমা আক্তার শুধু নারীদেরই নয়, আমাদের সমাজের সকলের জন্য একটি বড় উদাহরণ। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, ইচ্ছা থাকলে ছোট থেকে শুরু করে অনেক বড় কিছু করা যায়। নাজমা নিজের কানের দুল বিক্রি করে গাভী লালন, দিনে দিনে বড় খামারি হয়ে উঠেছেন, শুনতেই ভালো লাগা কাজ করে। তার অগ্রযাত্রায় প্রাণী সম্পদ দপ্তরের সর্বাত্বক সহায়তা থাকবে। তবে বন্যায় পুর্নবাসনখাতে কোন সরকারি বরাদ্দ না আসায় তাকে কোন সহায়তা দেওয়া সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া বন্যার সময় যে বরাদ্দ পাওয়া গেছে, তা ক্ষুদ্র খামারিদের দেওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা ছিল বলে উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা। (বাসস)