পাগল বেশে ঘোরাফেরা করতেন তিনি

তিন বছর ধরে পথিক হিসেবে চলাফেরা করেছেন। করুণা করে যে যা খাবার দিছেন তা খেয়েই জীবীকা নির্বাহ করতেন। অবহেলা আর অযত্নে তিনি মারা যান। মারা যাওয়ার পর থেকেই প্রকাশ হতে থাকে তার পরিচয়।

সরেজমিনে ঝালকাঠি সদর উপজেলার শেখেরহাট বাজার সংলগ্ন মোহাম্মদ আঞ্জির শাহ’র মাজার পরিদর্শনে গিয়ে জানা গেছে বিভিন্ন তথ্য। তথ্য প্রদানে সহায়তা করেছেন মাজারের প্রধান খাদেম ও মসজিদের মুয়াজ্জিন ওমর ফারুক।

জনশ্রুতি অনুযায়ী তিনি জানান, প্রায় শত বছর আগে পাগল বেশে শেখেরহাট বাজার এলাকায় ঘোরাফেরা করতেন মোহাম্মদ আঞ্জির শাহ। পাশের একটি স্কুলে রাত্রি যাপন করতেন। দিনের বেলায় যে যা দিতেন তা খেয়েই তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন।

একদিন ঘুমের মধ্যে তিনি মল ত্যাগ করলেন ওই বিদ্যায়লয়ের কক্ষেই। প্রধান শিক্ষক সকালে বিদ্যালয়ে প্রবেশ করতেই মলের দুর্গন্ধ টের পান। তখন পাগল হিসেবে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে প্রচণ্ড মারধর করেন। নদীতে নামিয়ে গোসলও করান। তখন প্রধান শিক্ষকের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ৩ বার কড়া দৃষ্টিতে তাকালেও মুখে কোনো কথা বলেননি। পরের দিন আবার ওই স্থানেই তিনি ঘুমান। প্রতিদিনের ন্যায় ওই প্রধান শিক্ষকের শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করতেই তিনি টের পান প্রচণ্ড ময়লার দুর্গন্ধ। ঢুকে দেখলেন শ’ খানেক লোকে মল ত্যাগ করছে এমন অবস্থা।

শিক্ষক রাগান্বিত হয়ে আবার ঘুমন্ত মানসিক বিকারগ্রস্ত পথিককে নাড়া দেন। গতদিনের ন্যায় কোনো সাড়া শব্দ আসেনি। পা ধরে নাড়া দিলে তার সমস্ত শরীর নড়ে ওঠে। সময়টা ছিলো পৌষ মাস। মলযুক্ত দেহ, আসবাবপত্র প্রতিবেশীদের সহায়তায় বাহিরে রেখে মানুষকে মৃত্যুর খবর দিতে যান তিনি। এসে দেখেন একপশলা বৃষ্টি পড়ে সব কিছু ধুয়ে নিয়ে গেছে। হয়েছে পরিষ্কা পরিচ্ছন্ন। এরপর স্থানীয়ভাবে তাকে দাফনের চেষ্টা। পুরাতন পারিবারিক গোরস্থানে দাফনের সিদ্ধান্ত নিয়ে কবর খুঁড়তে গেলে খুন্তির প্রতিটি কোপে পানি উঠে আসে।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন কবর খোঁড়া লোকজন এবং স্থানীয়রা। সেদিন শেখেরহাটের সাপ্তাহিক বাজারের দিন। তখন শেখেরহাট বাজার থেকে অপরিচিত দুজন ব্যক্তি উপস্থিত হয়ে ওই পুরাতন কবর সংলগ্ন গাবখান নদীর তীরে সঠি (হঠি) বনের মধ্যে তার দাফনের জন্য অনুরোধ করেন। সেখানে স্বাভাবিকভাবেই কবর খুঁড়ে জানাজা শেষে দাফন করা হয়।

দাফনের ১৭ দিন পর স্বপ্নে দেখে তার খোঁজে ভারত থেকে এক লোক আসেন। তিনি নিজেকে মোহাম্মদ আঞ্জির শাহ’র ভাই পরিচয় দেন।

খাদেম ওমর ফারুক জানান, ভারতের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওবন্দ দাওরায়ে হাদীস উত্তীর্ণ মোহাম্মদ আঞ্জির শাহ ছিলেন খোদাভীরু ও নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন। তারা দুই ভাই একই রুমে থাকতেন। একদিন তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে কুরআন তিলাওয়াত করা অবস্থায় মাথা ব্যথার কথা বলে চিৎকার করে বাসা থেকে বের হন। এরপর স্বজনরা তাকে খোঁজাখুঁজির করেও আর কোনো সন্ধান মিলাতে পারেননি।

মারা যাওবার পরে স্বপ্নে ঝালকাঠিতে তার দাফন হয়েছে বলে দেখতে পান। সে অনুযায়ী খুঁজতে খুঁজতে খুলনা হয়ে ঝালকাঠি শহরের আড়দ্দারপট্টিস্থ একটি আবাসিক হোটেলে রাত্রি যাপন করেন। আবারো স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেন, তুমি আমাকে পেছনে ফেলে গেছো, গাবখান নদীর তীর ধরে খুঁজতে থাকো তাহলেই আমাকে পাবে। খুঁজতে খুঁজতে শেখেরহাট বাজার এলাকায় তার কবরের সন্ধান পান। তখন তিনি এলাকাবাসীকে পরিচয়টি জানান।

পরিচয় জানার পরে স্থানীয় সিদ্দিক নামের একজনকে স্বপ্নে দেখান, তার কবরটা ঢেকে দেয়ার জন্য। তিনি ৩ বার স্বপ্নে দেখে মোকামিয়া পীর সাহেব (হাসনা পাগলা) এর কাছে গেলে তিনি বলেন, আমি তোমাকে স্মরণ করছিলাম, চিঠিও লিখতে চাইছিলাম। তুমি আসছো বেশ ভালোই করছো।

তখন সিদ্দিক তার স্বপ্নের কথা বললে পীরসাহেব হুজুরও স্বপ্নে দেখেছেন বলে স্মরণ করছিলেন। তার কবর ঢাকতে নির্দেশনা দিলে সে অনুযায়ী ৪টি ঢেউ টিন দিয়ে কবরটি ঢেকে দেন। বিষয়টি শরীয়ত পরিপন্থি বলে স্থানীয় এক আলেম টিন খুলে নিয়ে তার প্রতিষ্ঠিত জুনিয়র মাদরাসায় ব্যবহারের জন্য রাখেন। রাতে হঠাৎ ঝড়ে তার মাদরাসা এবং বাড়িঘর সব ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। সকালে ওই আলেমের ৩ ছেলেরই ডায়রিয়া হয়। দুজন সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান। পরের রাতে তাকে স্বপ্নে দেখানো হয় আমার কবরের টিন যেভাবে ছিলো সেভাবেই রাখতে হবে, নয়তো কেউ বাঁচবে না। সকালে আবার সেই টিন দিয়ে ঢেকে দিলে তিনি বিপদ মুক্ত হন। এরপর থেকেই তার কারামাত প্রকাশ হতে থাকে।

গাবখান নদীটি আন্তর্জাতিক নৌ-রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। একদিন একটি বিদেশি জাহাজ ওই মাজারের পাশ দিয়ে জোরে চালিয়ে যাওয়ায় পানিতে ডুবে যায়। এরপর থেকেই মাজারের পাশ দিয়ে নৌযান চলাচলের সময়ে গতি কমিয়ে ধীরে ধীরে যাবার প্রবণতা সৃষ্টি হয়।

খাদেম ওমর ফারুক আরো জানান, মাজারের পাশে জামে মসজিদ নির্মাণ, মাজারের ভবন নির্মাণ ও আধুনিকায়ন করা হয়েছে। স্থাপন করা হয়েছে দুটি বিশ্রামাগার। নদীর সঙ্গে ৩টি সিঁড়ি দিয়ে অজুর ব্যবস্থা রয়েছে। তিনি (আঞ্জির শাহ) জীবিত থাকতে কেউই বুঝতে পারেনি আল্লাহর ওলি ছিলেন। মারা যাওবার পর ধীরে ধীরে তার পরিচয় প্রকাশ হতে থাকে। খবর-ডেইলি বাংলাদেশ

আজকের বাজার/আখনূর রহমান