পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ

অফিসিয়াল ব্যবস্থাপনায় একবার চীন দেশ ভ্রমনের সুযোগ হয়েছিল। চীনারা বিদেশি ছাত্র অফিসার বলে আমাদের অনেক যত্ন আত্তি করেছে। বিদেশি ৯ জন ছাত্রের জন্য প্রচুর প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রশংসনীয়। একজন স্যার দোভাষী, সিনিয়র প্রশিক্ষক, একটি এয়ারকন্ডিসন মাইক্রোবাস, উইন্ডশিল্ড এ ‘ফরেনার সাটানো’ ভিআইপি গাড়িটি সর্বদা পুলিশ প্রহরায় চলাচল করতো। খাবার দাবারের কমতি নেই।

আমাদের নিরাপত্তার প্রতি ওরা খুবই সতর্ক। কোথাও একা যেতে দিত না। নারীদের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখা ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এসব কড়াকড়ির মাঝেও ফাঁক বুঝে বাইরে যাওয়া যেতো। কিন্তু সমস্যা হলো ভাষার। চীনা ভাষা না জানলে এক চুলও নড়ার সাধ্য নেই। আমাদের অবসর কাটে টিভি দেখে (যত্তসব গাজাখুরি আজগুবি কল্প কাহিনী)। কলেজ ক্যাম্পাসে বিশাল এক লাইব্রেরি আছে। সময় কাটানোর একটা ভালো জায়গা। কিছু ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার বই ছাড়া বাকি চীনা বই।

একদিন একটা বই পেলাম আধুনিক চীনের সংস্কারবাদী নেতা দেং শিয়াও পিংয়ের জীবনীর উপর। চীনের রাজনীতি ও লং মার্চে তার বিশেষ ভূমিকা ছিল। তিনি চীনকে বহির্বিশ্বে পরিচিত করেছিলেন এই সংস্কারের মাধ্যমে। এক সন্তান নীতি, শিল্পায়ন, ব্যবসা বাণিজ্যে ব্যক্তি মালিকানার স্বীকৃতি, উৎপাদন ও পুঁজি সৃষ্টিতে সংস্কার সমূহ বিশেষ ভূমিকা রাখে।

আগ্রহ ভরে বইটা নিলাম। ধরে নিয়েছিলাম রাজনীতিবিদ ও কাস্তে হাতে বিপ্লব করা লোকটা এমন আর কিইবা জানে। আফসান চৌধুরীর ভাষার হাইলা হবে হয়তো। দেখলাম এই নেতা ধনী কৃষকের ছেলে যিনি ফ্রান্সে লেখা পড়া করেছেন। চীনা রাজনীতিতে সকল স্তরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বার বার গ্রেপ্তোর ও নির্যাতন তাকে নীতি থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। স্বয়ং মাওয়ের সাথে নীতিগত বিরোধিতা করে পদ হারিয়েছিলেন। জেলে বন্দী ছিলেন। সামরিক শক্তি বাড়িয়ে যুদ্ধ জয়ের পরিবর্তে তিনি অর্থনৈতিক বিনিয়োগে যুদ্ধ জয়ে বিশ্বাসী ছিলেন। তার ভাষায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এলে সামরিক উৎকর্ষতা নিশ্চিত বাড়বে ও যুদ্ধ জয় সহজ হবে।

দেংয়ের এই থিওরি ঠিক কিংবা বেঠিক সে বিতর্কে এ স্বল্প পরিসরে যেতে চাইনা। তাছাড়া তার মৃত্যুর পর তার অনুসারী চীনা কর্ণধারগণ সঠিক নির্দেশনায় আছেন কি না তাও দেখার বিষয়। চীন যে একটা অর্থনৈতিক শক্তি সন্দেহ নেই। তবে সামরিক বা রাজনৈতিক সক্ষমতায় চীন কি বিশ্ব শক্তি না রিজিওনাল শক্তি। চীনের একলা চলো নীতি আর নেই কিন্তু বন্ধুদের সংখ্যা লেনদেনের উপর নির্ভরশীল। তাই সাপের মাথার মনির লোভে কেউ কাছে এগোতে দ্বিধান্বিত। বর্তমান সময়ের চীনা রাজনৈতিক বিশ্লেষণ অনেক জটিল ও দীর্ঘ। কড়া নজদারি চলছে চীনা সম্ভাব্য বন্ধুদের প্রতি।

দেং শিয়াও পিংয়ের বইটিতে ইটালিয়ান মহিলা সাংবাদিকের নেয়া দেং এর ইন্টারিউয়ের উল্লেখ্য দুটি বিষয় আমার মনে দাগ কেটেছে। প্রশ্নোত্তরে দেং জানান যে কমিউনিস্ট হাইকমান্ডের এক যৌথ সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে তিয়েন আন মেন স্কোয়ারের কোন স্থাপনা ও সৌন্দর্য পরিবর্তন করা যাবেনা।

কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ নিজেদের নামে কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করবেন না। যদি কেউ করেন তা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, দুটিই ভঙ্গ করা হলো। এর কারণ কিছু বলবেন? মাওকে আপনি কতটুকু দায়ী করেন।

-আমাদের মহান নেতা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেননি। তার শেষ জীবন কেটেছে বন্দী অবস্থায়। Gang of Four যা বলেছে তাই মাওয়ের নির্দেশ বলে প্রচারিত হয়েছে। তার সমাধি নির্মিত হয়েছে তিয়েন আন মেন স্কোয়ারের অঙ্গ হানি করে। দুটোই অপরাধ। কুচক্রীরা এসব মাওয়ের সিদ্ধান্ত বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন।

– আপনি কি এখন মাও সমাধি ভেঙে ফেলে অন্য অবস্থানে নিয়ে যেতে চান যাতে তিয়েন আন মেন স্কোয়ার আগের অবস্থায় ফেরত আসে।

– না। এক ভুল সংশোধন করতে গিয়ে আরও ভুল করতে চাই না।

– যেসব নেতারা এ ভুলের জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবেন?

– না।

– মাওয়ের হাতে আপনি নিগৃহীত হয়েছেন। তার প্রতি আপনার মূল্যায়ন কি?

– মাও আমাদের নেতা। আমাদের প্রতি অন্যায় অবিচার হলেও তিনি আমাদের পথিকৃৎ। তাকে কখনোই অপমানিত হতে দেয়া হবে না। তিনি সমালোচনার ঊর্ধ্বে।

২৭ বছর আগের পড়া বইয়ের গুরুত্ব তখন মনোযোগ সহকারে না নিলেও বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নেতাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের প্রয়োজনীয়তা ভীষণ অনুভব করি। খবর-ইউএনবি

আজকের বাজার/আখনূর রহমান