পিটিএল’র শেয়ার’র মূল্য বৃদ্ধির পেছনে পরিচালকদের কারসাজি

আইপিও’র অর্থ ব্যবহার সংক্রান্ত অনিয়মের পর এবার শেয়ারমূল্য কারসাজির অভিযোগ উঠেছে প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল লিমিটেডের (পিটিএল) বিরুদ্ধে। কথিত পাওয়ার প্ল্যান্টকে ইস্যু বানিয়ে শেয়ারের মূল্য বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। গত দুই মাসে এই কোম্পানির শেয়ারের মূল্য প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে।

খোদ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ পরিচালকরা এই ঘৃণ্য তৎপরতায় জড়িত বলে অভিযোগে জানা গেছে। বেনামে এরা শেয়ার কেনা-বেচায় জড়িত আছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে পিটিএল কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের কারসাজিতে যুক্ত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।

উল্লেখ, প্রায় বছর খানেক ধরে পুঁজিবাজারে ‘পাওয়ার প্ল্যান্ট’ ক্রেজ শুরু হয়েছে। পাওয়ার প্ল্যান্ট পাওয়ার বিষয়টিকে ইস্যু বানিয়ে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হচ্ছে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী নামধারী কিছু জুয়াড়ি এভাবে কারসাজি করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে খোদ কোম্পানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এরা যোগসাজশ করেই এ ঘটনা ঘটনাচ্ছেন। আবার অনেক কোম্পানি এদেরকে খুঁজে বের করে তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ‘গেম প্ল্যান’ সাজাচ্ছেন। এরপর সুবিধামতো সময়ে মূল্যসংবেনশীল তথ্য প্রকাশ করছেন। কখনো কখনো এমন তথ্যের জন্ম দিচ্ছেন।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ডোরিন পাওয়ারের পাওয়ার প্ল্যান্ট পাওয়ার খবরকে সামনে রেখে শেয়ারমূল্য কারসাজির খেলা শুরু হয়। পরে শাশা ডেনিমস নামের টেক্সটাইল কোম্পানির শেয়ারের মূল্যকারসাজিতেও ‘পাওয়ার প্ল্যান্ট’ ফ্যাক্টর টনিকের মতো কাজ করে। দুটি ঘটনায় সফল হওয়ার পর কারসাজিকারী ও কিছু অসাধু উদ্যোক্তার উৎসাহ কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

পাওয়ার প্ল্যান্ট ইস্যুকে সামনে রেখে কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির ঘটনায় পিটিএলের উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হয়ে থাকতে পারেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দীর্ঘদিন ইস্যুমূল্যের নিচে পরে থাকা শেয়ারটির মূল্য বাড়াতে ব্যস্ত হয়ে উঠেন কর্তৃপক্ষ।

অভিযোগে জানা গেছে, গত এপ্রিল মাস থেকে বাজারে গুজব ছিল পিটিএল একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র পেতে যাচ্ছে। কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের একাধিক সদস্য এই গুজবের নেপথ্যে ছিলেন। পর্ষদের জনৈক সদস্য একটি ‘প্রজেক্ট প্রোফাইল’ সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন ব্রোকারহাউজে গিয়ে দেখিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র পাওয়ার সম্ভাবনার প্রচারণা চালিয়েছেন। বিভিন্ন ব্রোকারহাউজ ও বিনিয়োগকারীর সঙ্গে আলোচনা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। তবে কেউই আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

আইপিওর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ ব্যবহারে অনিয়মের কারণে পিটিএলের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ছিল তলানীতে। এছাড়া তালিকাভুক্তির পর থেকে কোম্পানিটির পারফরম্যান্সও প্রতি বছর খারাপ হয়েছে। আইপিওতে বিনিয়োগকারীদের কাছে ১৮ টাকা প্রিমিয়ামসহ ২৮ টাকা দরে শেয়ার বিক্রি করা হলেও কিছুদিনের মধ্যেই তা অফার মূল্যের নিচে নেমে আসে। গত জানুয়ারি মাসেও বাজারে শেয়ারের দাম ছিল ২০ টাকা। কিন্তু পাওয়ার প্ল্যান্টের গুজব ছড়ানোর পর থেকে শেয়ারটির দাম তর তর করে বাড়তে থাকে।

গুজব শুরু হওয়ার প্রায় দুই মাস পর ৩০ মে পিটিএল কর্তৃপক্ষ স্টক এক্সচেঞ্জ জানায়, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য তারা ‘প্যারামাউন্ট-এগ্রিটেক এনার্জি কনসোর্টিয়াম’ নামে একটি কনসোর্টিয়াম গঠন করেছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিপি) অনুমতি পেলে তারা বাঘাবাড়িতে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে।

আলোচিত কনসোর্টিয়ামের অন্য তিন সদস্য হচ্ছে- প্যারামাউন্ট স্পিনিং, প্যারামাউন্ট হোল্ডিংস লিমিটেড ও এগ্রিটেক এজি। ঘোষণা অনুসারে, কনসোর্টিয়ামে পিটিএলের অংশ থাকবে ৫৫ শতাংশ।

গত ২ জুলাই ডিএসইর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, পিটিএলের পরিচালনা পর্ষদ বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের অগ্রাধিকার প্রকল্পের (First Track Project) আওতায় ২শ মেগাওয়াট ক্ষমতার আইপিপি/রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য আবেদন করবে। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা ও ঠাকুরগাঁও এর শান্তাহারে তারা এ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে আগ্রহী। তবে দেশের অন্য কোনো এলাকায় হলেও আপত্তি থাকবে না।

এদিকে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী এক বছরের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে ২ থেকে ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করার লক্ষ্যে জরুরী ভিত্তিতে দরপত্র ছাড়াই কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে ২১টি প্রতিষ্ঠান তাদের প্রস্তাব জমা দিয়েছে।

জানা গেছে, দুটি কারণে এ দফায় পিটিএলের বিদ্যুৎকেন্দ্র পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। প্রথমত: এ দফায় আবেদন করার সময় গত ২৯ জুন শেষ হয়ে গেছে। আবেদনকারীদের তালিকায় প্যারামাউন্ট-এগ্রিটেকের নাম নেই। দ্বিতীয়ত: সরকার নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানকে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। আগের অভিজ্ঞতা আছে ও পারফরম্যান্সের রেকর্ড ভালো এমন কোম্পানিকে অনুমতি দেওয়ার জন্য বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়কে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

পিটিএল কিংবা তার পার্টনার এগ্রিটেক এজির কারোরই বাংলাদেশে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই।

এদিকে ওয়েবসাইট ঘেঁটে জানা গেছে, এগ্রিটেক এজি বিদ্যুৎ উৎপাদন সংক্রান্ত একটি বড় প্রতিষ্ঠান হলেও এটি সম্পূর্ণ পারিবারিক মালিকানাধীন কোম্পানি। বিশ্বে বড় বড় প্রায় সব কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলেও এগ্রিটেক রয়েছে পুঁজিবাজারের বাইরে। তাই এ কোম্পানির স্বচ্ছতার বিষয়টিও পরীক্ষিত নয়। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করার ক্ষেত্রে খুব বেশি যাচাই-বাছাই করে না। তালিকাভুক্ত নয় বলে এরা ব্র্যান্ড ইমেজ নিয়ে খুব বেশি সচেতন থাকে না।

দেশের বাইরে থাকায় বিষয়টি নিয়ে পিটিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাখওয়াত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

পিটিএলের কোম্পানি সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কোনো মন্ত্য করতে রাজি হননি।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোম্পানিটির উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা অর্থসূচককে বলেন, শেয়ারের দর বাড়ার পেছনে কোম্পানির কোনো হাত নেই। আপন শক্তিতে শেয়ারের দর বাড়ছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, বাজারে কখন থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের খবর ছিল তা আমরা জানি না। পর্ষদে অনুমোদনের পরই আমরা মূল্য সংবেদশীল তথ্য হিসাবে কনসোর্টিয়াম গঠন ও বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের আগ্রহের তথ্য করেছি। এর সঙ্গে দর বাড়া-কমার কোনো সম্পর্ক নেই।

অন্যদিকে বিদ্যুতের সমস্যা সমাধান করতে আরও কিছু প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিতে যাচ্ছে সরকার। এখানে ২২টি প্রস্তাব জমা পড়েছে। এদের প্রস্তাবিত উৎপাদন ক্ষমতা ৩৬৫৫ মেগাওয়াট। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বেশিরভাগই ফার্নেস অয়েল চালিত, কয়েকটি আছে ডিজেলভিত্তিক। সেখানেও এই কনসোর্টিয়ামের নাম নেই।

এদিকে শেয়ারমূল্য কারসাজির বিষয়কে কেন্দ্র করে পিটিএলের পুরনো অনিয়মের ঘটনা নতুনভাবে উঠে এসেছে। চলতি মূলধনের চাহিদা পূরণ ও ব্যাংকঋণ পরিশোধের কথা বলে ২০১৩ সালে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে চড়া দামে শেয়ার বিক্রি করেছিল পিটিএল। তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিল প্রায় ৮৪ কোটি টাকা। কিন্তু টাকা হাতে আসার পরপরই কোম্পানির পরিচালকারা অন্য মতলবে মেতে উঠেন। ব্যাংকঋণ পরিশোধ না করে, ব্যবসা সম্প্রসারণে না যেয়ে তারা ‘সোনার চেয়েও অধিক মূল্যে’ গুলশানের মাদানি সড়কে প্রায় ৪২ কোটি টাকায় ৭ হাজার ২৪৮ বর্গফুট জায়গা কেনেন। প্রতি বর্গফুট জায়গার দাম পড়ে প্রায় ৫৮ হাজার টাকা। ওই সময়ে আলোচিত এলাকায় কোনো ভবনেই প্রতি বর্গফুট স্পেসের দাম ৪০ হাজার টাকার বেশী ছিল না।

এদিকে তালিকাভুক্তির পর থেকেই পিটিএলের পারফরম্যান্স ধারাবাহিকভাবে খারাপ হয়েছে। আইপিওতে আসার আগের বছরে তথা ২০১২ সালে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) ছিল ৩ টাকা ৪৭ পয়সা। ২০১৩ সালে তা কমে হয় ৩ টাকা ২৭ পয়সা। পরের দুই বছরে তা আরও কমে যথাক্রমে ২ টাকা ২৩ ও ১ টাকা ৭৭ পয়সা দাঁড়ায়। ২০১৬ সালে সালে ইপিএস সামান্য বেড়ে ১ টাকা ৮৪ পয়সা হলেও এর পেছনে পাওয়ার প্ল্যান্ট ইস্যু ও শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধির ঘটনার যোগসূত্র থাকতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংবাদ সূত্র:অর্থসূচক

আজকের বাজার:এলকে/ এলকে/ ০৯ জুলাই ২০১৭