পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ

গত কয়েকদিন পুঁজিবাজারে দর পতনের পর মার্কেট ঘুরে দাঁড়াবার জন্য রেগুলেটরি সংস্থা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। রেগুলেটরি সংস্থার এই প্রচেষ্টাকে আমি সাধুবাদ জানাই। ক্যাপিটাল মার্কেট নিয়ে তাদের চিন্তা অনেক বেশি। আমি মনে করি ক্যাপিটাল মার্কেট হচ্ছে, বøাড সার্কুলেশন এর মত। ক্যাপিটাল মার্কেটে মানি ফ্লো থাকলে সব দিক থেকে প্রবৃদ্ধি হবে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জায়গাটা হচ্ছে ক্যাপিটাল মার্কেট। তাই সূচক যখন ডাউনের দিকে যায়, তখন সবার চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সা¤প্রতিক কিছু উদ্যোগ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন থেকে নেয়া হয়েছে। আইসিবিকে শেয়ার ক্রয় করার জন্য ভালো ফান্ড দেয়া হবে। যেসকল কোম্পানিগুলো কমপ্লায়েন্স মানতে চাচ্ছে না, তাদের বিষয়ে সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন পদক্ষেপ নিয়েছে। সিকিউরিটি হাউসগুলোর আনইউজুয়াল ট্রানজেকশন তদারকি শুরু করেছে। যার ইম্প্যাক্ট মার্কেটে আসা শুরু করবে বলে আমি মনে করি।

পুঁজিবাজার তো প্রতিদিন আপনাকে প্রফিট দেবে না। কখনো প্রফিট দিবে, আবার কখনো ডাউনের দিকে নিয়ে যাবে। আমি বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে বলবো, যখন আমাদের মার্কেটের সূচক নিচের দিকে থাকে, শেয়ার ক্রয় করার তখনই সঠিক সময়। এটা আমরা অনেকেই বুঝি না। মার্কেট যখন ঊর্ধ্বগতি থাকে আমরা তখনই শেয়ার ক্রয় করি। মার্কেট অনবরত পতনের দিকে যাওয়ার অবস্থা এখন নেই। আজ হোক বা কাল হোক মার্কেট ভালো হবেই। সাউথ এশিয়ার রিজনে, যে দেশগুলো আছে তাদের তুলনায় আমাদের ডিভিডেন্ড, পিই রেশিও, গ্রোথ অনেক ভালো। আমরা একটি জায়গায় পিছিয়ে সেটা হচ্ছে, মার্কেট ক্যাপটু জিডিপি। সর্বোপরি আমি বলব হতাশ হবার কিছু নেই। রেগুলেটরি সংস্থার কার্যকরী পদক্ষেপে মার্কেট ঘুরে দাঁড়াবে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সময় ভালোভাবে বুঝে আপনার বিনিয়োগ করুন।

প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ভূমিকা:
আপনারা জানেন পুঁজিবাজারে শেয়ারের যে ট্রেড হয়, এর মেজর ভলিউম প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা যখন শেয়ার ক্রয় বিক্রয় করে, তখন মার্কেটে এর ইম্প্যাক্ট হয়। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বড় ভূমিকা রয়েছে পুঁজিবাজারে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ারের ভলিউম বাড়ানো হলে সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই পুঁজিবাজার চাঙ্গা হয়ে যাবে। আইসিবি হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠান। পুঁজিবাজারে উন্নয়নের জন্য তাদের ভূমিকা অনেক। রেগুলেটরি সংস্থা আইসিবির মাধ্যমে মার্কেটকে চাঙ্গা করার জন্য তাদের ফান্ড দিয়ে, এক্সপোজার লিমিট বাড়িয়ে মার্কেটকে স্থিতিশীল করার উদ্যোগ নিয়েছে। আমি আশা করি, বাংলাদেশ ব্যাংকও কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজারের উন্নয়নের স্বার্থে সুনজর দিবেন।

বাজেটে পুঁজিবাজারের প্রত্যাশা:
আপনারা জানেন এবছর কয়েকটা মেগা প্রজেক্ট উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে। এই মেগা প্রজেক্টগুলো উদ্বোধন হলে জিডিপিতে তার ইম্প্যাক্ট পড়বে। এই দিক চিন্তা করে এবার বাজেটে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। কিন্তু বৈশ্বিক অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা, আমাদের এক্সপোর্ট এর তুলনায় ইমপোর্ট কষ্ট বেড়ে যাচ্ছে। ইমপোর্ট কষ্ট বেড়ে যাওয়ার ফলে আমাদের ব্যালেন্স অফ পেমেন্টে এফেক্ট করছে। ইতিমধ্যে প্রস্তাবনা এসেছে সরকারের কাছে যার একটি হচ্ছে কর হার নিয়ে। কর্পোরেট ট্যাক্স নিয়ে সরকারের চিন্তা করার সময় এসেছে। শেয়ারবাজারে যারা বিনিয়োগ করছেন তাদের কর রেয়াতের সুবিধা সরকার আগে থেকেই দিয়ে যাচ্ছে। নতুন কোম্পানি যাতে ক্যাপিটাল মার্কেটে আসতে পারে, তাদের কর্পোরেট ট্যাক্সসহ অন্যান্য সুবিধাগুলো দেয়া দরকার। এবারের বাজেটে বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে এটাই প্রত্যাশা করি।

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী। দীর্ঘমেয়াদী পুঁজিবাজারের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে আস্থা। আমরা মাঝে মাঝে আস্থা হারিয়ে ফেলি। দীর্ঘমেয়াদী পুঁজিবাজারের জন্য সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের একটি প্রোগ্রাম চালু আছে, ফিনান্সিয়াল লিটারেসি প্রোগ্রাম। আপনারা নিয়মিত এই সকল কর্মশালাগুলোতে অংশগ্রহণ করুন। আরেকটি বিষয় হচ্ছে আমাদের জাংক শেয়ারের প্রতি আগ্রহ বেশি। ফান্ডামেন্টাল শেয়ারের প্রতি আমরা বেশি ঝুঁকি না। মিউচুয়াল ফান্ডের উপর আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। আমাদের মার্কেটে অন্যান্য দেশের তুলনায় ডেরিভেটিভ কম। দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা করতে গেলে আপনাকে এ সকল বিষয়গুলো জানতে হবে। যে সকল কোম্পানির ফাইনান্সিয়াল গ্রোথ ভালো, বিগত পাঁচ বছরের এনালাইসিস করে যদি দেখা যায় যে, কোম্পানিগুলোর আর্নিং ভালো, ডিভিডেন্ড, পিইরেশিও ভালো ফাইন্যান্সিয়াল গ্রোথ স্টেডি লাইনে আছে, হঠাৎ করে প্রাইস আপ-ডাউন করেনি, এই ফান্ডামেন্টাল কোম্পানিগুলো আপনাকে কখনো হতাশাগ্রস্ত করবে না। আমার উপদেশ থাকবে বিনিয়োগকারীদের প্রতি, উল্লেখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করে ফান্ডামেন্টাল শেয়ারে আগ্রহী হন। গুজব থেকে সরে আসেন।

বাজেটে প্রণোদনা:
বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রভাব আমাদের পুঁজিবাজারেও পড়েছে। গত সপ্তাহে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম ১০১টাকা চলে গিয়েছিল। বর্তমানে ব্যাংকে এখন ৯৭-৯৮ টাকায় কেনা হচ্ছে। খোলাবাজারে ৮৭-৮৮ চলছে। এজন্য আমাদের ব্যালেন্স অফ পেমেন্টে ইম্প্যাক্ট পড়ছে। আমাদের ইমপোর্টেড কস্ট অনেক বেড়ে গেছে। সার, তেল, চিনি এইসব পণ্য আমাদের হাই ইমপোর্ট কষ্ট দিয়ে নিয়ে আসতে হচ্ছে। এক্সপোর্ট আমরা সেই পরিমাণে করতে পারছি না। আমাদের ফরেন রেমিটেন্স দিয়েও কাভার হচ্ছে না। রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাজেটে কিছু প্রণোদনা দিয়ে আমাদের এক্সপোর্ট এর পরিমাণ বাড়ানো যায়। অনাদায়ী ঋণ আদায় করা গেলে এর সুফল বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে শুরু করে ব্যালেন্স অফ পেমেন্টেও পড়বে। এই সকল বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করা উচিৎ বলে আমি মনে করি। এই বিষয়গুলো যদি গ্রাজুয়েলী ডেভলপ হয়, এর এফেক্ট আমাদের ক্যাপিটাল মার্কেটে পড়বে। আমরা অল্পতেই প্যানিক হয়ে যাই। যখন দেখেছি ডলারের দাম বেড়ে গেছে, আমরা ভেবেছি আমাদের দেশ শ্রীলংকা হয়ে যাবে। সেজন্য শেয়ার সেল করে আমরা বেরিয়ে যাচ্ছি। যার ফলে ক্যাপিটাল মার্কেটে সেলের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। ইনশাল্লাহ আমাদের দেশের ইকনোমিক গ্রোথ অনেক ভালো। প্যানিক হওয়ার মতো কোনো অবস্থা তৈরি হয়নি।

বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে বলবো, আপনারা ক্যাপিটাল মার্কেটে আসুন। একটি কোম্পানির ফাইন্যান্সিয়াল এনালাইসিস করুন। জেনে বুঝে বিনিয়োগ করুন। গুজবে কান দেবেন না। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে গুজব ছড়িয়ে যায়। যার ফলে অনেক সাধারণ বিনিয়োগকারী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা যারা কাজ করি, আমাদের অনেকদিনের একটি দাবি ছিল রেগুলেটরি কমিশনের কাছে, আপনারা এই জায়গাগুলোতে মনিটরিং এর ব্যবস্থা করেন। যারা এই সকল চক্রের সাথে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে রেগুলেটরি ব্যবস্থা নিন।

বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ:
সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন পাবলিক ইস্যু রুলস এ্যামেন্ডমেন্ট করার চিন্তা করেছ। এটা খুব ভাল উদ্যোগ। কর্পোরেট গভর্নেন্স এনসিওর করতে হবে। এই আইনের অনেক জায়গায় অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছে। আপনারা জানেন ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট হয়েছে। অডিটরদের একাউন্টিবিলিটির জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে। তাদের জবাবদিহিতা বেড়েছে। কোম্পানিগুলো সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য কোম্পানির ভিতরের কর্পোরেট স্ট্রাকচার ঠিক করার দায়িত্ব অডিটর করতে পারছে না। প্রতিবছর কমপ্লায়েন্সের যে অডিট হয়, সেখানে এসইসি’র গাইডলাইন অনুযায়ী কর্পোরেট গভর্নেন্স এনসিওর করা দরকার। সেই সকল জিনিসগুলো অডিটে আসছে না। কোম্পানির কর্পোরেট গভর্নেন্স যদি ঠিক না থাকে, সেই কোম্পানিগুলো আজ হোক কাল হোক একটি সময় মার্কেটে বিনিয়োগকারীদের হতাশার কারণ হবে। একটি বিষয় আমি বলতে চাই, কোম্পানিগুলো যেটা করে, পুঁজিবাজারে লিস্টিং হওয়ার আগে প্রসপেক্টাস পাবলিশ করে। এই প্রসপেক্টাসে ইউজার প্রসিড ফান্ড ইউটিলাইজেশন-এ যেসব খাতের কথা উল্লেখ করা হয়, বেসিক্যালি কোম্পানিগুলো উল্লেখিত খাতগুলোতে ফান্ড ইউটিলাইজেশন করে না। এসইসির প্রভিশন আছে আপনি শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে এজিএম এ্যাপ্রুভাল নিয়ে পরিবর্তন করতে পারবেন। এই ফাঁক দিয়ে কোম্পানিগুলো বেরিয়ে যায়। কোম্পানি আইপিও থেকে যে টাকাটা পেল, সেটা এক্সপ্লানেশনে যেভাবে বলা আছে, সেভাবে না করে ৩-৪ বছরের সময় নিয়ে এফডিআর করে টাকা বের করে নিয়ে চলে যাচ্ছে। এই বিষয়ে এসএসির উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ। এটা পাবলিকের ফান্ড। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য আইপিওর ফান্ড কোথাও কিছু করতে পারবেন না। এই সকল বিষয়গুলো যদি বিবেচনা করি, তাহলে মার্কেটে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।

মো. মনিরুল ইসলাম এফসিএস
ডিরেক্টর একাউন্টস এ্যান্ড ফাইন্যান্স
শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি