পুঁজিবাজারে নতুন বিনিয়োগকারী টানতে, বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষের অংশগ্রহণ বাড়াতে মাঠে নেমেছে মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানগুলো। এ লক্ষ্যে নতুন ও নমনীয় বেশ কিছূ প্রোডাক্ট নিয়ে এসেছে তারা।
বেশীরভাগ প্রোডাক্টে মাসিক ভিত্তিতে অর্থ জমা দিয়ে বিনিয়োগ প্রকল্প চালানো যাবে, যা অনেকটা ব্যাংকের মাসিক সঞ্চয় স্কিমের (ডিপিএস) এর মতো। পার্থক্য হচ্ছে, ডিপিএসে শুধু আসলের সঙ্গে সুদ পাওয়া যায়; কিন্তু মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারহাউজগুলোর এসব প্রোডাক্টে লভ্যাংশের পাশাপাশি মূলধনী মুনাফারও অনেক সম্ভাবনা থাকছে।
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য নিরাপদ বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে পণ্য বৈচিত্র নিয়ে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের পণ্য উদ্বোধন করেছে। আবার অনেক পাইলট প্রজেক্ট হিসাবে পরিচালনা করছে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, পুঁজিবাজারে নতুন বিনিয়োগকারী সৃষ্টি ও বিনিয়োগে অভ্যস্ত করা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিনিয়োগ এক জায়গায় করা, বিনিয়োগকারীদের নিরাপদ বিনিয়োগের নিশ্চয়তা নিয়ে মাঠে নামছেন তারা।
তাদের মতে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পেশাদার ফান্ড ম্যানেজমেন্ট সেবা প্রদান, একটি যৌক্তিক পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্টের ছোঁয়া থাকবে প্রোডাক্টগুলোতে। যেগুলো সময়ের সাথে বিনিয়োগকারীর পোর্টফোলিওকে শক্তিশালী করবে। বিনিয়োগকারীর ফান্ডকে নিরাপদে বিনিয়োগের জন্য ভালো মৌল ভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারকে প্রধান্য দেবে।
ব্র্যাক ইপিএলের সেভ প্লাস
দেশের অন্যতম শীর্ষ ব্রোকারহাউজ ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ লিমিটেড সেভ প্লাস (Save Plus) নামে একটি প্রোডাক্ট চালু করেছে। বিনিয়োগবান্ধব ও নমনীয় এ প্রোডাক্টে ১৮ বছরের বেশি বয়সি এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী যে কেউ সেবা নিতে পারবেন। আগ্রহী বিনিয়োগকারীকে প্রথম পর্যায়ে দুই লাখ টাকা দিয়ে একাউন্ট খুলতে হবে। এর পর থেকে প্রতিমাসে ন্যুনতম পাঁচ হাজার টাকা করে জমা করতে হবে। গ্রাহকের নির্দেশনা অনুসারে ব্রোকারহাউজ ওই তহবিল থেকে শেয়ার কিনবে। এভাবে ধীরে ধীরে তার পোর্টফোলিও বড় হবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় পরিণত হবে বড় বিনিয়োগে।
নতুন প্রোডাক্ট সম্পর্কে ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেরিফ এম এ রহমান অর্থসূচককে বলেন, তারা দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে এই প্রোডাক্ট চালু করেছেন। বড় মূলধন নেই ভেবে অনেকে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার আগ্রহ বা সাহস পান না। সেভ প্লাস প্রোডাক্টের নমনীয়তা তাদেরকে এই বাজারে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেবে। এর মাধ্যমে বাজারে নতুন নতুন মুখ যুক্ত হবে।
ইবিএলের সঞ্চয়
বিনিয়োগের নতুন দিগন্ত- এই স্লোগান নিয়ে বিনিয়োগকারীদের জন্য ইবিএল ইনভেস্টমেন্টস্ লিমিটেড নিয়ে এলো মাসিক বিনিয়োগ স্কিম ‘সঞ্চয়’। পুঁজিবাজারে নতুন বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করতে প্রতিষ্ঠানটির এই উদ্যোগ।
কী আছে সঞ্চয়ে, এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির প্রাইমারি মার্কেটের প্রধান পংকজ কুমার মুৎসুদ্দী অর্থসূচককে বলেন, এটি মাসিক ডিপিএসের মতো একটি আর্থিক পণ্য/সেবা। বিনিয়োগকারীরা মাত্র ৪০০ টাকা ফি দিয়ে হিসাব খুলতে পারবেন। একজন বিনিয়োগকারী সর্বনিম্ম ১ হাজার টাকা থেকে শুরু করে যেকোনো গুণিতক পরিমাণে প্রতিমাসে বিনিয়োগ করে তার সঞ্চয়কে সমৃদ্ধ করতে পারবেন।
তিনি বলেন, এই বিনিয়োগের মেয়াদ হবে ৩, ৫ ও ৭ বছর। বিনিয়োগকারীরা চাইলে বিনা খরচে মেয়াদ বৃদ্ধি করতে পারবেন অথবা অন্য প্রকল্পে পুঁজি পরিবর্তন করতে পারবেন। বিনিয়োগকারীরা চাইলে বছরে সর্বনিম্ম ৩৩ হাজার টাকা থেকে সর্ব্বোচ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিমা কাভারেজ নিতে পারবেন। এই কাভারেজ স্বাভাবিক ও দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, স্থায়ী শারীরিক অক্ষমতার জন্য হতে পারে; যা ভবিষ্যতে পরিবারের আর্থিক নিশ্চয়তা ও সঞ্চয়ের নতুন মাত্রা সৃষ্টি করবে। আর বিনিয়োগকারীদের সুবিধার কথা চিন্তা করে টাকা জমা দেওয়ার জন্য রাখা হয়েছে অটো ডেবিট/ ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের সুবিধা। এতে করে বিনিয়োগকারীকে প্রতিষ্ঠানের কাছে স্বশরীরে না আসলেও হবে।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মইনুল হোসেন আসিফ অর্থসূচককে বলেন, সুপরিকল্পিত ও সহজভাবে তহবিল ব্যবস্থাপনার সুযোগ না থাকায় অনেকের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ থেকে দূরে থাকছেন। আগ্রহী নতুন ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কথা চিন্তা করে আমরা সঞ্চয় নামে মাসিক বিনিয়োগ স্কিম চালু করতে যাচ্ছি। আমরা মনে করি এই পণ্যের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করবে।
লংকাবাংলার নিশ্চিন্ত
আমার সঞ্চয় হোক নিশ্চিন্ত- এই শ্লোগানকে ধারণ করে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছে লংকাবাংলা ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেডের বিশেষ বিনিয়োগ প্রকল্প ‘লংকাবাংলা নিশ্চিন্ত’।
পণ্যটির বৈশিষ্ট্য হলো- প্রতি মাসে ৩ হাজার, ৫ হাজার অথবা এর গুণিতক অর্থ জমা করে বিনিয়োগ করা যায়, ৩, ৫ ও ১০ বছর মেয়াদী বিনিয়োগ হিসাব খোলা যায়, মেয়াদ পূর্তির আগেও বিনিয়োগ প্রত্যাহারের সুযোগ আছে, ন্যুনতম ১২ শতাংশ মুনাফার সম্ভাবনা, মুনাফা ১২ শতাংশের বেশী হলে বাড়তি মুনাফা সমহারে গ্রাহক ও লংকাবাংলার মধ্যে ভাগ করা হয়, এবং বিইএফটিএনের মাধ্যমে প্রতি মাসের কিস্তি জমা দেওয়ার সুযোগ আছে, ফলে গ্রাহককে লংকাবাংলায় না এলেও চলবে।
লংকাবাংলা ইনভেস্টমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার কায়েস হাসান বলেন, পুঁজিবাজার গতিশীল করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে লংকাবাংলা পরিবার। এরই অংশ হিসাবে আমাদের এই পণ্য। এর মাধ্যমে কিছু নতুন বিনিয়োগকারী বাজারে নিয়ে আসতে চাই।
আইডিএলসির ইজি ইনভেস্ট
নতুন ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় প্রোডাক্ট এনেছে আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি চালু করেছে ‘ইজি ইনভেস্ট’ প্যাকেজ। এই প্যাকেজের মাধ্যমে খুব সহজে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা যাবে।
এ বিষয়ে আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টস- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান অর্থসূচককে বলেন, ৩, ৫ ও ১০ বছর মেয়াদে বিনিয়োগ করতে হবে। তবে শুরু করার পর মেয়াদ শেষের আগে কেউ এক বছর পর টাকা তুলে নিতে চাইলে তার কাছে পুরো পোর্টফোলিওর ওপর ১ শতাংশ টাকা কেটে নেওয়া হবে। কেউ এক বছরের আগে বিনিয়োগ তুলে নিতে চাইলে তার কাছ থেকে কেটে নেওয়া হবে ৫ শতাংশ টাকা।
তিনি বলেন, এটি মাসিক ডিপিএসের মতো। এখানে একজন বিনিয়োগকারী প্রতিমাসে ৩ হাজার টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে তার পোর্টফোলিওকে সমৃদ্ধ করতে পারেন।
এফএএসের এলআরএইচআর
দেশের অন্যতম মার্চেন্ট ব্যাংক এলআরএইচআর সিকিউর ও এলআরএইচআর কনফিডেন্ট নামে দুটি পণ্য চালু করেছে। পণ্য দুটির বৈশিষ্ট প্রায় কাছাকাছি। এর মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্টগুলো হলো মাসিক ডিপিএসের, মেয়াদ হবে ৩,৫ ও ৭ বছর, কমপক্ষ্যে ১ হাজার টাকা বা গুণতিক যে কোনো পরিমাণ, এককালীন ডুকোমেন্টেশন ফি ৫০০ টাকা, ব্রোকারেজ ফি দশমিক ৪০ পয়সা, নির্ধারিত সময়ের আগে টাকা তুলতে চাইলে রয়েছে দুটি পণ্যেই ফি, এলআরএইচআর সিকিউর লভ্যাংশ শেয়ার করতে হবে না। কিন্তু এলআরএইচআর কনফিডেন্টে ১২ শতাংশের উপরে লভ্যাংশ শেয়ার করা হবে।
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম অর্থসূচককে বলেন, ক্ষুদ্র বিনয়োগকে এক জায়গায় আনতে আমাদের এই উদ্যোগ। আমরা ইতোমধ্যে এই পণ্যগুলোতে ব্যাপক সাড়া পেয়েছে। আশা করছি এটি পুঁজিবাজারে তারল্য বাড়াতে সহায়তা করবে।