পোল্ট্রিতে এন্টিবায়োটিকের প্রয়োজন নেই-ড. এফ. এইচ আনসারী

ব্রয়লার মাংসের অতীত ও বর্তমান : আজ থেকে নয় বছর আগে ব্রয়লার মাংসের ব্যাপারে মানুষের ধারণা ছিল অন্যরকম। যেহেতু এ মাংসে ভালো টেস্ট নেই, হালকা, খেলে ফাইবার পাওয়া যায় না, এমন একটা ধারণা সবার মধ্যে ছিল। প্রায় অনেকেই কিন্ত একসময় ব্রয়লারের মাংস খেতো না। কিন্ত বর্তমানে আমরা কী দেখছি? সারা দেশে এখন ব্রয়লারের মাংস অনেক জনপ্রিয়। শুধু দেশে না সারা বিশে^ এখন ব্রয়লারের মাংসের প্রচুর চাহিদা। দেশে বিদেশে সবাই এখন ব্রয়রারের মাংস খায়। পোল্ট্রি মানেই কিন্ত আমরা ব্রয়লারের মাংস আর ডিম মনে করি। এই ব্রয়লার মাংসের সুবিধা কী? এই মাংস পুষ্টি সম্পন্ন কারণ এ জাতের মুরগি-মুরোগ স্বল্প সময়ে বৃদ্ধি পায়। আর বড় করতে অল্প সময়ে তাকে পুষ্টিকর খাবারের সাথে ভিটামিন, প্রোটিন, ফ্যাট খাওয়ানো হয়। যার কারণে এর মাংস দ্রুত বাড়ছে, পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হচ্ছে, সুস্বাদু হচ্ছে এবং দিন দিন সবার কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই খাদ্যকে যদি মডিফাই করে অন্য কোন খাদ্যে কনভার্ট করা যায় তাহলে আরো ভালো হয়। এটা করা সহজ এবং এ প্রক্রিয়ায় ভিন্ন ধরনের টেস্ট দেয়া সম্ভব।

অপর দিকে দেশি মুরোগে যেহেতু হাড্ডি থাকে, ফাইবার শক্ত থাকে, মাংস কালো হয় তাই এর মাংস দিয়ে অন্য কিছু করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া দেশি মুরগি বড় হতেও এক দেড় বছর লেগে যায়। কিন্ত সেদিকে ব্রয়লার এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে দেড় কেজি ওজনের মাপে বড় হয়ে যায়। এটা একটা সুবিধা। ব্রয়লালের মাংস আসলে অনেক সচ্ছ, পরিষ্কার ও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। আমরা জানি, দেশি মুরোগ-মুরগি মুক্ত অবস্থায় থাকে,বিভিন্ন ধরনের আজেবাজে খাবার, পোকামাকড়, ব্যাকটেরিয়া খায়, পঁচা-বাসি খাবার খায়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বড় হয়। অন্যদিকে ব্রয়লার পালন করা হয় নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে, হাই প্রোটিন জাতীয় খাবার দেয়া হয় তাদের। ফলে মাংসও মানসম্পন্ন হয়। তা দিয়ে আপনি চাইলে আরও নানা ধরনের চিকেন-পণ্য উৎপাদন করতে পারেন।

ব্রয়লার নিয়ে প্রশ্ন: বর্তমানে ব্রয়লারের মাংস নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এখন এটি একটা ইস্যু। এর মাংসে কি কেমিস্ট্রি না ক্যামিক্যাল না অন্য কিছু আছে এ ব্যাপারে রীতি মতো আলোচনা চলছে । আবার কেউ ভাবছে এতে এন্টিবায়োটিক মেশানো কি না। আসলে ব্যাপারটা কিন্ত ভাবার বিষয়। আমরা জানি, একটা ব্রয়লার ভালোমানের একটা ডিম থেকে উৎপন্ন হচ্ছে। তার পর নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় তাকে আবদ্ধভাবে লালন পালন করে বড় করা হচ্ছে। খাবারের মধ্যে তাকে দেয়া হচ্ছে, বিভিন্ন পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার। আর এর মাধ্যমেই একটা মুরোগ ৩৫ দিনে দেড় কেজি ওজনের হয়ে যায়। এ জন্য তাকে দুই কেজি খাবার খাওয়াতে হয়। এখানে আবার খামারির চাহিদায় সময়মতো বড় করতে হয় বিক্রির জন্য। না হলে তাকে লোকসানের মধ্যে পড়তে হয়। এর জন্য এ প্রক্রিয়ার সুবিধা আছে। একে বড় করতে রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ভ্যাকসিন দেয়া হয়। এই ভ্যাকসিন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয় । এর মাধ্যমে একটা মোরগের কোন রোগ আসে না।

বর্তমানে দেখা যায় যে পোল্ট্রি খাবারের মধ্যে কেউ কেউ এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করছেন। এখানে এন্টিবায়োটিক ফ্রি ও এন্টিবায়োটিক যুক্ত একটা কনসেপ্ট কাজ করে। এন্টিবায়োটিক ফ্রি কি? তা জানতে হবে আগে। এটা হলো, যে এন্টিবায়োটিক মানুষ ব্যবহার করে না বা খায় না কিন্ত মুরোগের খাবারের সাথে মিশিয়ে তাদের খাওয়ানো হয়, তাকে বলা হয় এন্টিবায়োটিক ফ্রি। এন্টিবায়োটিক আপনি যত বেশি খাবেন এটা আপনার শরীরে রেজিস্ট্যান্ট তৈরি করবে, যা পরে আর কাজে আসবে না, এর বাইরে তো কোন সমস্যা নাই।এখন কথা হলো, যে এন্টিবায়োটিক মিশ্রিত খাবার মোরগকে খাওয়ানো হয়, যা মানুষ খায় না। তা যদি মোরগ খায় তাহলে হবে কী? ওই মাংস প্রতিদিন বা সপ্তাহে একবার করে খেলে, খাবারের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করবে এবং শরীরে রেজিস্ট্যান্ট গ্রো করবে। এই কারণে মানুষ যেসব এন্টিবায়োটিক খায় না এটা যদি পোল্ট্রিকে খাওয়ানো হয় তাহলে কোন সমস্যা নেই। সেটাকে এন্টিবায়োটিক ফ্রি হিসেবে গ্লোবালি গ্রহণ করা হয়েছে।

আসলে এই কনফিউশনটাই আমাদের দূর করতে হবে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, আমাদের দেশের মানুষ প্রচুর পরিমাণে এন্টিবায়োটিক খায়। যে সমস্ত এন্টিবায়োটিক পোল্ট্রিকে খাওয়ানো হয় সেসব এন্টিবায়োটিক কিন্ত মানুষ খায় না। সেখানে যে এই সমস্যা প্রকট তা কিন্ত নয়। তার বাইরেও একটা সমস্যা আছে, সবাই ভাবে কেন আমরা এন্টিবায়োটিক ফ্রি মাংস পাবো না? এটা পাওয়া যাবে এবং তা সম্ভব। বর্তমানে যে ধরনের টেকনোলজি বের হয়েছে তা ঠিকভাবে অ্যাপ্লাই হলে, এন্টিবায়োটিক ফ্রি চিকেন পাওয়া সম্ভব। এখানে তিনটি জিনিস লাগবে। একটা হলো প্রপারলি ভ্যাক্সিনেট করা। আর অন্যটা হলো, যেখানে পোল্ট্রি বা মুরোগ পালন করা হয় সে জায়গাটা পরিষ্কার পরিচছন্ন করে রাখা। যাতে কোনোরকম রোগের বিস্তার না ঘটে। তৃতীয়ত, টেম্পারেচার ঠিক রাখার জন্য যে ফ্যান বা শীতে হিটারের ব্যবহার করা হয় তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা। এটা করলে মুরোগ-মুরগির স্বাস্থ্য ভালো থাকবে ও রোগ কম হবে। আর হারভেস্ট করার ১০ দিন আগে যদি পোল্ট্রির খাবারের সঙ্গে এন্টিবায়োটিক খাওয়ানো বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে কোনও সমস্যা হবার কথা নয়।

তার পরও আরো কিছু সল্যুশান রয়েছে, আমরা বাংলাদেশের মানুষ, সমস্ত নারকেল তেল মাথায় দিয়ে শেষ করে ফেলছি। মাথায় নারকেল তেল দিলে যে খুব একটা ভালো হয় তা কিন্ত না। সেখানে ধুলোবালি লেগে আরো ময়লার সৃষ্টি হয়। তখন শ্যাম্পু দিয়ে সে ময়লা পরিষ্কার করতে হয়। এই নারিকেল তেল দিয়ে আমরা নতুন একটা প্রোডাক্ট তৈরি করেছি। সেটাকে এসিটিক ফ্যাট বলা হচ্ছে। এই এসিটিক ফ্যাট খাবারের সঙ্গে পোল্ট্রিকে খাওয়ালে হার্মফুল ব্যাকটেরিয়া থাকবে না। এতে করে দুটো উপকার হলো, এক. এই খাবার খাওয়ানোর ফলে এন্টিবায়োটিকের কোনো প্রভাব থাকলো না। আর দুই. এই অর্ডিনারি পণ্যের ভালো একটা ব্যবহার আমরা করতে পারবো। তো এভাবেই কিন্ত আমরা এন্টিবায়োটিক ফ্রি ব্রয়লার মাংস পেতে পারি। এর ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে পুষ্টিকর মাংস পাবো, এন্টিবায়োটিক ফ্রি মাংসের চাহিদা দিন দিন বাড়বে। এবং সবার কাছে এর মাংস আরো গ্রহণযোগ্য হবে। সার্বিকভাবে বলতে পারি, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা এন্টিবায়োটিক ফ্রি ব্রয়লার মাংস পেতে পারি।

পোল্ট্রি শিল্প ও এসিআই কোম্পানি: এসিআই কোম্পানি পোল্ট্রি শিল্পের সঙ্গে দু’ভাবে ইনভলভ। প্রথমত, আমরা এই সেক্টরের জন্য হেলথ প্রোডাক্ট দিই, নিউট্রিশন দিই, হাইজিন দিই, পোল্ট্রির ফার্মাসিউটিক্যালস দিই এবং পোল্ট্রির ভ্যাকসিন দিই। আমরা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন সাúøাই কোম্পানি। আপনারা জানেন, ২০১২ সালে সারা দেশে পুরো পোল্ট্রি সেক্টর বার্ড ফ্লুর জন্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আমরাই পৃথিবীতে একমাত্র কোম্পানি যারা সে সময় সারা দেশে সার্থকভাবে ভ্যাকসিনের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। যার ফলে যেখানে এ সেক্টরে ড্রপ করেছিল ৩.৮ মিলিয়নে, সেখানে আজ ১২ মিলিয়ন পোল্ট্রি উৎপাদন হচ্ছে। এদেশের মোট ব্রিডিং পোল্ট্রি পপুলেশনের শতকরা ৯০ ভাগ আমরা বার্ড ফ্লু ভ্যাকসিন দিয়ে থাকি। যার ফলে বর্তমানে কিন্ত পোল্ট্রি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, আমাদের খামারিরা বেঁচে উঠেছেন। পুরো পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি বেঁচে গিয়েছে এবং টিকে আছে।

পোল্ট্রিতে আমাদের সহায়তা: আমরা যেটা সাপোর্ট করি সেটা হলো, পোল্ট্রিকে ভ্যাক্সিনেটেট করতে হবে, সঠিকভাবে হাইজিন মেনটেইন করতে হবে, ভালো ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। এবং যে সমস্ত এন্টিবায়োটিক মানুষ ব্যাবহার করে না, প্রয়োজনে সেইসব এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যে, পোল্ট্রি যখন হারভেস্ট করবে এর ১০ দিন আগ থেকে এন্টিবায়োটিক বন্ধ করে দিতে হবে। আর যদি তারা এসিটিক ফ্যাট ব্যবহার করতে পারে তাহলে তো এন্টিবায়োটিক লাগবেই না। এতো কিছু আমরা চিন্তা করছি কেবলমাত্র পোল্ট্রি শিল্পের উন্নয়নের জন্য। এছাড়াও পোল্ট্রির এমন কিছু রোগ আছে যেখানে মোরগকে এন্টিবায়োটিক দিতেই হবে, সেখানে ভ্যাক্সিনে খুব একটা কাজ হবে না।

হরমোনের মিথ: ব্রয়লার হলো একটা নিজস্ব জাত। তাকে নির্দিষ্ট পরিমাণে খাবার দিলে সময়মতো তার গ্রোথ আসবে। সেখানে প্রয়োজনে ভ্যাকসিন, এন্টিবায়োটিক দিয়ে তাকে রোগ প্রতিরোধক করে তুলতে হবে। যেহেতু ব্রয়লার নিজেই একটি জাত সেখানে হরমোন প্রয়োগের প্রয়োজনই নেই। আর অনেকে বলেন যে দ্রুত মাংস বাড়াতে হরমোন দেয়া হয়। আসলে ব্যাপারটা একেবারেই ভুল। আমাদের দেশে কেউই হরমোন ব্যবহার করে না। কারণ পোল্ট্রিতে হরমোন দেয়ার কোনো বিজ্ঞান নেই, সাপোর্ট নেই, আর হরমোন এভেইলেবলও নয়। সুতরাং হরমোন দেয়ার প্রশ্ন আসে না।

ড. এফ এইচ আনসারী
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও
এসিআই এগ্রি বিজনেস লিমিটেড