প্রতিবন্ধী শিশুর প্রয়োজন সহমর্মিতা

ছোট্ট অনিলের আজ খাওয়া হয়নি। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। কিন্তু তার মা তাকে খেতে দেয়নি। সম্ভবত তার মনেই নেই। তার ছোট ভাই সুনিলকে নিয়েই ব্যস্ত তিনি। প্রায় প্রতিদিনই এমনটি হয়। অনিলের যে খিদে পায়, মায়ের সঙ্গে.. ছোট ভাইটির সঙ্গে যে সে মিশতে চায় তা কেউ বুঝতেও চায় না। খেয়ালও করে না। আর বাবাকে তো বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই সে মহা বিরক্ত থাকতে দেখেছে। কারণ একটাই.. সে যে আর দশটি সাধারণ শিশুর মতো নয়। সে প্রতিবন্ধী শিশু!

কিন্তু প্রতিটি শিশুই তার নিজের ও সমাজ জীবনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করার অধিকার নিয়ে জন্মায়। শিশু সময়ের সাথে সাথে তার বুদ্ধিমত্তার বিকাশের কারণে সমাজ জীবনে কোন না কোন ভুমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্যি যে, একজন সুস্থ স্বাভাবিক শিশুর জন্য ব্যাপারটি সহজ হলেও প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য ব্যাপারটি মোটেই সহজ নয়। সহজ নয় এই কারণে যে, এসব শিশুরা স্বাভাবিক আচরণ ও সুযোগ-সুবিধা সেভাবে পায় না।

এমনিতেই প্রাপ্তবয়স্করা যেসব মৌলিক মানবাধিকার ভোগ করে থাকে সেগুলো সম্পর্কে অধিকাংশ লোকের কিছু জ্ঞান বা ধারণা থাকলেও এমন অনেক লোক রয়েছে যাদের কাছে শিশু অধিকার ব্যাপারটি একেবারেই নতুন। আর এই রকম পরিস্থিতিতে প্রতিবন্ধী শিশুদের ব্যাপারটা তো আরও করুন। অধিকাংশ মানুষের কাছে এরা সমাজ সংসারের বোঝা এবং চরম অবহেলার পাত্র হয়ে থাকে।

কিন্তু বাস্তবে এ ধারণা একদম ভুল। তাদের প্রতি সমাজের সকল মানুষের উচিৎ সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া এবং তাদের সাথে অন্য দশটি শিশুর মতোই সহজ স্বাভাবিক আচরণ করা। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের ২৩ ধারায় এই নীতি পরিস্কারভাবে বলা আছে যে, প্রতিবন্ধী শিশুদের এমন পরিপূর্ণ জীবনযাপন করতে দিতে হবে যা তাদের মর্যাদা রক্ষা করবে এবং আত্মনির্ভরশীল ও সমাজে সক্রিয় অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করবে।

সনদ অনুমোদনকারী দেশগুলো এই অঙ্গিকার করেছে যে তাদের সম্পদ অনুযায়ী এ ধরনের শিশু ও তাদের মা বাবাকে চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সেবা, বিশেষ শিক্ষা, চাকরীর প্রশিক্ষণ বা কারিগরী শিক্ষা এবং বিনোদন ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণের সুযোগসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে। সম্ভব হলে বিনামূল্যে সাহায্য-সহযোগিতা করবে। এটার উদ্দেশ্য হল সমাজের সঙ্গে শিশুদের যতোটা সম্ভব পরিপূর্ণভাবে অঙ্গীভূত হওয়ার ও ব্যক্তিগত বিকাশ অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করা।

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে প্রতিবন্ধী শিশুদের অধিকার রক্ষায় বর্তমান সরকারও ২০১৩ সালে শিশু অধিকার আইনে বেশ কয়েকটি সুনির্দিস্ট ধারা যুক্ত করেছে। বিশেষ করে শিশুর মানসিক বিকাশঘটিত সমস্যা বা অটিজমে আক্রান্ত শিশুর সুরক্ষায় বাংলাদেশ সরকার বরাবরই ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে আসছে। এছাড়াও জন্মগত, দুর্ঘটনা ও অসুস্থতাজনিত শারীরিক এবং মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের অধিকার সুরক্ষায় রয়েছে বিশেষ ধারা।

সাধারণত আমাদের সমাজে শারীরিক ও মানসিক এই দু’ধরনের প্রতিবন্ধী শিশু আমরা দেখতে পাই। প্রতিবন্ধী শিশুরা সাধারণত স্বাভাবিক শিশুদের থেকে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে থাকে। তবে পূর্ণমাত্রায় সহমর্মিতা ও সহযোগিতা পেলে তারাও একটি স্বাভাবিক শিশুর মতো সমাজে বেড়ে উঠতে পারে এবং সমাজে অংশগ্রহণ করতে পারে। এমন নজির সমাজে অনেক রয়েছে।

এমন একটি উদাহরণ হল প্রতিবন্ধী সাফ গেমস্’এ অংশগ্রহন করে আমাদের দেশের প্রতিবন্ধী সোনার শিশুদের বিভিন্ন গেমস্’এ স্বর্ণ পদকসহ বিভিন্ন পদক অর্জন। আন্তরিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতার মাধ্যমে প্রতিবন্ধী শিশুদের সহজভাবে শিক্ষাদান করলে এসব শিশুরা স্বাভাবিক শিশুর মতোই সবক্ষেত্রে তাদের মেধার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম।

প্রতিবন্ধী শিশুদের সমাজে সক্রিয় অংশগ্রহনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো শিক্ষার পাশাপাশি তাদের কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। যাতে তাদের অন্যের মুখাপেক্ষী হতে না হয়। অবশ্য প্রতিবন্ধী শিশুদের কর্মমূখী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার দিকে লক্ষ্য রেখে দেশে সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায় থেকেই বিভিন্ন কারিগরী শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এসব সংস্থা শিশুদের প্রতিবন্ধীত্বের ধরন বুঝে তাদের সেই ধরনের কারিগরী শিক্ষাদান করে থাকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের শিক্ষক ড. ফারাহ দীবা’র মতে, শিশুদের বিকাশের ব্যাপারে অনেক অভিভাবকই তেমন একটা গুরুত্ব দেন না। কিন্তু প্রতিটি মানুষেরই মানসিক বিকাশের নানা রকম ক্ষেত্র রয়েছে। তাই জন্মের পর থেকেই শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের দিকে নজর দেয়া উচিৎ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ মনে করেন, শিশুর মানসিক বিকাশের প্রধান অন্তরায়গুলোর মধ্যে শিক্ষার অভাব ও দারিদ্র্যতা অন্যতম। এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শিশুদের সুষ্ঠ মানসিক বিকাশ ও অধিকার অর্জনের বিষয়টি আরও জটিল।

একটি শিশু বিভিন্ন কারনে প্রতিবন্ধী হতে পারে! তাই বলে এই নয় যে সে সমাজ ও দেশ থেকে শুধু করুনা ও সাহায্য নিয়ে যাবে। একজন সুস্থ্য ও স্বাভাবিক শিশুর মতো সেও বেড়ে উঠতে পারে। দেশ ও জাতীর জন্য রাখতে পারে অবদান। এজন্য শুধু দরকার আমাদের সকলের সুদৃষ্টি এবং সহমর্মীতা। দরকার তাদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। খবর-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান