মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ

প্রযুক্তি দক্ষ জনশক্তি বাড়াতে হবে

সৈয়দ আলমাস কবীর: সফটওয়্যার এবং সফটওয়্যার সম্পৃক্ত সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি বর্তমানে প্রস্তুতিমূলক অবস্থায় রয়েছে। ধারাবাহিকভাবে অনেক কাজ হচ্ছে। সরকার উৎসাহ ও বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে। বেসিস, ২০১৮ সালের মধ্যে সফটওয়্যার এবং আইটি খাতে ১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির ঘোষনা করেছিল। এখন পর্যন্ত এই লক্ষ্য অর্জনে সঠিক পথে এগুচ্ছে বেসিস। বেসিস বিশ্বাস করে এই বছরের মধ্যে এক বিলিয়ন ডলারের বেশিই রপ্তানি করা সম্ভব হবে। এই ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ২০২১ সালের মধ্যে এক বিলিয়ন রপ্তানি লক্ষ্যকে পাঁচ বিলিয়নে নিয়ে যাওয়া যায়, সেই চেষ্টা করতে। বেসিস এখানেও দৃড় বিশ^াস করে ২০২১ এর আগেই লক্ষ্যে পৌছানো সম্ভব হবে। এছাড়া রফতানির বাইরে দেশের বাজারে বিশাল এক সম্ভাবনা রয়েছে। এই মহুর্তে লোকাল মার্কেটেও প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি চাহিদা রয়েছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে এটা কয়েকগুন বেড়ে আরো উন্নত হবে।

এখানে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো- দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান এখনও বিদেশী সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। দেশী সফটওয়্যারের উপর আস্থা না করে, তাদের মধ্যে এক ধরনের বিদেশ প্রীতি কাজ করছে। তাই সচেতনতার বিষয়টি অনেক জুরুরী। অনেকে হয়তো জানেন না, দেশেই এখন বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার পাওয়া যাচ্ছে, এবং সেগুলো অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের। অর্ধেকের বেশি ব্যাংক বিদেশী সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। লোকাল সফটওয়্যারের তুলনায় এসব সফটওয়্যারের দাম ৬ থেকে ৮ গুন বা কখনও কখনও ১০ গুনও বেশি। গুনগত দিক দিয়ে এগুলো দেশীয় সফটওয়্যারের মতই। এটা দূর্ভাগ্যজনক। সেজন্য বেসিস বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন প্রত্যেক বছর একটা সফটওয়্যার এক্সপো হচ্ছে। এবারের এক্সপো অনুষ্টিত হবে ফেব্রুয়ারির ২২ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো, দেশীয় সফটওয়্যারকে স্থানীয় ও বিদেশী ব্যবহারকারীদের কাছে তুলে ধরা। পাশাপাশি সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে-যারা দেশী সফটওয়্যার ব্যবহার করবে, তাদের যেন বিভিন্ন ধরনের প্রনোদনা দেওয়া হয়। এছাড়া সচেতনা বৃদ্ধির জন্য আরও বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

এই অগ্রযাত্রার আরেকটি বাধা হলো দক্ষ জনশক্তি। সরকারী বেসরকারী উৎসাহে এই শিল্প যত বড় হয়েছে, ঠিক তার বিপরীতে ততটা দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠেনি। তবে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচী এবং বেসিসের উদ্যোগে নানারকম প্রশিক্ষণ দেওয়ার কারণে দক্ষ জনশক্তি তৈরী হচ্ছে, কিন্তু এটা আরও বেশি দরকার।


এডুকেশন এন্ড ট্রেনিং, নলেজ এন্ড স্কিল-এর মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়া হয়, জ্ঞান সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু তাকে দেয়া হচ্ছে না ট্রেনিং, স্কিলড করা হচ্ছে না। সুতরাং এই যে বড় ধরনের শূন্যতা, তা পূরনের জন্য বেসিস অনেকদিন ধরে বিভিন্ন ফোরামে কথা বলে আসছে। এই মহুর্তে জরুরী ভাবে ইন্ডাস্ট্রি এবং বিশ^বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটা কো-অপারেশন করা দরকার। বিশ^বিদ্যালয়গুলোর সিলেবাসে সামান্য কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। তাহলে কাজের উপযুক্ত হয়েই পাশ করে বের হবে শিক্ষার্থীরা। এখন যেটা হচ্ছে শিক্ষার্থীরা পাশ করছে, অনেকেই ভাল রেজাল্টও করছে, কিন্তু শিক্ষাজীবন শেষে তারা চাকরির জন্য যোগ্য হয়ে উঠছে না। তাদের জ্ঞান আছে কিন্তু দক্ষ নয়। এসব শিক্ষার্থীদের বেসিস এবং সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। উদ্দেশ্য হলো-তারা যাতে বিশ^বিদ্যালয় থেকেই চাকরির উপয়োগী হয়ে বের হতে পারে। শিগগিরই বিষয়টি নিয়ে বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সাথে বৈঠকও করতে যাচ্ছে বেসিস। আর এ কারণে কেস স্টাডি করার জন্য একটি বিশ^বিদ্যালয়কে বেছে নেয়া হয়েছে। মাত্র দুটো বিষয় পরিবর্তন করা হলোই মোটামুটি একটা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হবে। ইউজিসিও এ বিষয়ে আন্তরিক। বৈঠকের পর ভাল একটা ভাল ফলাফল আশা করা যাচ্ছে।
দেশের ব্রেইন ড্রেন সমস্যা বেশ পুরনো হলোও এখন কমেছে। বরং উল্টো ব্রেইন গেইনও হচ্ছে। চাকরি কিংবা পড়ালেখার সুবাদে যারা দেশের বাইরে গেছেন, তাদের অনেকেই দেশে ফিরে নিজ উদ্যোগে কিছু করার চেষ্টা করছেন।

বেসিসে অনেকে রয়েছেন যারা বিভিন্ন দেশে অনেক বছর থাকার পর, দেশে ফিরে কোম্পানি খুলেছে। ভাল সুযোগ পেলে দেশের বাইরে যে কেউ যেতেই পারেন। কিন্তু একটা সময় পর দেশে ফিরে আসা উচিত। যদি ফিজিক্যালি কেউ ফিরতে না পারেন, অন্তত তাদের মেধা ও অর্থ দেশেই ইনভেস্ট করা উচিত। তাদেরকে উৎসাহিত করতে সেমিনারসহ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চালাচ্ছে বেসিস। নানারকম সহযোগিতাও করা হচ্ছে।

নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থের সংস্থান করা আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। ব্যাংক, লিজিং কোম্পানি বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে ঋন নিতে বেশ কষ্ট হয়। ব্যাংক বা অন্য প্রতিষ্ঠান ভাবে-তাদের ফিজিক্যাল কোন ইক্যুইটি নেই। জমি নেই, বাড়ি নেই, কারখানা নেই- ডিফল্ট হলে, সে ওই সম্পত্তি বিক্রি করে ঋনের টাকা শোধ করবে। আরেকটা সমস্যা হলো- বাংলাদেশে ‘ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস’ ভালভাবে ইমল্পিমেন্ট নয়। ফলে আমরা যখন একটা প্রোগ্রাম লিখব, তখন তার সোর্স কোড কিন্তু খুব ভালভাবে প্রটেক্টে হচ্ছে না। এটাকে যদি ভালভাবে প্রটেক্ট করা যায়, তাহলে ব্যাংকের কাছে অন্যান্য সম্পদের মত এটাকে ইক্যুইটি হিসেবে দেখানো যেত। এজন্য বেসিস অনেক ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানির সাথে সমঝোতা চুক্তি করছে। তাদের বলা হচ্ছে, বেসিসের সদস্যদের একটা নূন্যতম ধাপ পর্যন্ত কোন রকম গ্যারান্টি বা ইক্যুইটি ছাড়া যেন ঋন দেয়া হয়। এছাড়া ভেঞ্চার ক্যাপিটালগুলোর সাথে বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে বৈঠক করা হচ্ছে। সফটওয়্যার এক্সপোতেও তাদের নিয়ে আসা হচ্ছে, যাতে করে উদ্যোক্তারা, এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে বিনিয়োগের বিষয়ে কথা বলতে পারে।

সমস্যা হলো-অনেকেই খুব ভাল প্রজেক্ট তৈরি করছে কিন্তু সেটা তারা ভালভাবে উপস্থাপন করতে পারে না। এবারের এক্সপোতে উদ্যোক্তারা এই বিষয়গুলো শেখার সুযোগ পাবেন। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ইইএফ নামে যে ফান্ড আছে সেটাও এখন বন্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গেও মতবিনিময় করা হবে। তাকে এই ফান্ড দ্রুত চালুর জন্য অনুরোধ জানানো হবে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রীও এ ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিক।

নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দিতে বেসিসে আলাদা ফোরাম রয়েছে। কারণ আমরা মনে করি মেয়েদের চিন্তা অনেক বেশি যুক্তিসংগত এবং গঠনমূলক। পাশাপাশি স্টুডেন্ট ফোরামের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যাতে দক্ষ হয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারে, সেজন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিশ^বিদ্যালয়ের পাশাপাশি স্কুল পর্যায়ে শিশু প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে বেসিস। বাংলাদেশকে যদি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করতে হয়, তাহলে টেকনোলজিতে অনেক বেশি বিনিয়োগ করতে হবে, দেশের মানুষকে টেকনোলজি ওরিয়েন্টড করতে হবে। সেই কারণে ছাত্রছাত্রীদের সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ম্যাথ (এসটিইএম) এই চারটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কিন্তু অনেকেরই ঝোক বিবিএ এমবিএ’র দিকে। এ খাতে এগুতে হলে ঝোকটা এসটিইএম এর উপর বেশি থাকতে হবে। শুরুতে যদি শিক্ষার্থীরা এই চারটি বিষয়ের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়, তাহলে পরবর্তীতে সে যে বিষয়েই পড়ালেখা করুক না কেন, উন্নতি করতে পারবে, টেকনোলজি ওরিয়েন্টড হবে।

যারা তথ্য প্রযুক্তি নিয়ে ব্যবসা করতে চান বা চাকরি করতে চান, তাদের প্রথম দরকার স্কিল অর্জন করা। এই স্কিলড, শুধুমাত্র টেকনিক্যাল স্কিলড নয়। ব্যবসা বা প্রতিষ্টান পরিচালনার স্কিলড, একাউন্টিং স্কিলড, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট স্কিলড। একজন প্রোগ্রামিং করতে জানেন, খুবই ভাল কথা। কিন্তু তিনি যদি প্রতিষ্টান ঠিকমত পরিচালনা করতে না পারেন, হিসাব-নিকাশ বুঝতে না পারেন, তাহলে প্রোগ্রামিং করতে পারবেন,কিন্তু ব্যবসা করতে পারবেন না। চাকরি ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।

সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে এর আগে অ্যাওয়ারনেস প্রোগাম করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতেও এ ধরনের প্রোগ্রাম করা হবে। সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে মূল বিষয় হলো সচেতনতা। বিশেষ করে, যারা কম বয়সী এবং ফিমেল ইউজার, তাদেরকে সচেতন করার চেষ্ট করা হচ্ছে বেশি। ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় কিভাবে সতর্ক হবেন, সেই বিষয়গুলো বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে, এখনও বলা হচ্ছে। সরকারের কাছেও অনুরোধ রয়েছে, সিকিউরিটি ডিভাইসের উপর উচ্চহারের শুল্ক কমানোর জন্য। এই শুল্ক কমানো খুবই জরুরী। উদাহরণস্বরুপ-একজন বাসায় গার্ড বা নিরাপত্তারক্ষী রাখবেন কী রাখবেন না, সেটা নির্ভর করবে, তার বেতনের উপর। এখন একজন নিরাপত্তারক্ষীর বেতন যদি ৫০ হাজার টাকা হয়, তাহলে তিনি হয়তো কোন গার্ডই রাখবেন না। বেতন যদি সহনীয় পর্যায় হয়, তাহলে হয়তো একজন গার্ড বা নিরাপত্তারক্ষী রাখবেন। আর বেতন যদি আরও কম হয়, তাহলে একজনের জায়গায় ২ বা ৫ জনও রাখতে পারেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার এখন একটা স্টেজ, বিভিন্ন ধরনের নেটওয়ার্ক তৈরি হচ্ছে।

সুতরাং নেটওয়ার্ক তৈরি এবং নিরাপত্তার বিষয়ের উপর সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। ফায়ারওয়ালের ডিউটি যদি কম হয় বা একেবারেই না থাকে, তাহলে মানুষ বেশি বেশি ফায়ারওয়াল ব্যবহার করবে। এতে তার নেটওয়ার্কটাও নিরাপদ থাকবে। কিন্ত ফায়ারওয়ালের দাম যদি বেশি হয়,তাহলে তো প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে। সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে ফায়ারওয়ালের ডিউটি হয় মওকুফ করা হোক, না হয় একেবারেই কমিয়ে দেয়া হোক।

ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে বেসিস সব সদস্য প্রতিষ্টান নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। দক্ষ জনশক্তি গড়তে সরকারের সাথে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলছে। ইতোমধ্যে বেসিস ১৬ হাজারেরও বেশি প্রশিক্ষণ শেষ করেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে, ই গভার্নেন্স দরকার। ই গভার্নেন্স করতে কী কী করা দরকার এবং সেখানে বেসিস কিভাবে সহায়তা করতে পারবে, সে বিষয় নিয়েও সরকারের সাথে আলোচনা চলছে।

সৈয়দ আলমাস কবীর
প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)