প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার এক বিবৃতিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি বিশ্ব আন্তর্জাতিক রেজিস্টার স্মারকে (মেমরি অব দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার) অন্তর্ভুক্ত করায় ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভাসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করায় আমি ইউনেস্কো এবং এর মহাসচিব ইরিনা বোকোভাসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’
প্যারিসে ইউনেস্কোর সদরদপ্তরে ৩০ অক্টোবর এই অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙালিদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ শুরু করে। অর্থনৈতিক শোষণ ছাড়াও তারা আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে।’
তিনি বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মাতৃভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নেয়। পাকিস্তানিদের এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম রুখে দাঁড়ান। তার নেতৃত্বে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সংগ্রাম। বাঙালিদের ওপর নেমে আসে অত্যাচার এবং নির্যাতন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬-দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান এবং ৭০’র সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ের পথ ধরে বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম এক যৌক্তিক পরিণতির দিকে ধাবিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফা ঘোষণার অপরাধে পাকিস্তান সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাকে প্রথমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং পরে কুর্মিটোলায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করে রাখে। শুরু হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কার্যক্রম। বাঙালিরা এসময় গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করে আনেন। সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের পতন হয়। আরেক সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেন।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানি শাসকদের নিপীড়ন এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াইড়ের পর ১৯৭০ সালে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জাতীয় নির্বাচনে সমগ্র পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকস্তানি শাসকগোষ্ঠী গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। তারা বাঙালিদের ওপর অত্যাচার নিপীড়ন শুরু করে।
শেখ হাসিনা বলেন, এ প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভার ডাক দেন। সেদিনের জনসমুদ্রে তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।’ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণই ছিল প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা।
সরকার প্রধান বলেন, এ ভাষণে বাঙালীদের প্রতি পাকিস্তানী শোষকগোষ্ঠীর হত্যা-নিপীড়ন-নির্যাতনের চিত্র মূর্ত হয়ে উঠে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যূদয়ের আবশ্যকতা ও আকাক্সক্ষা ছিল এ ভাষণের মূল লক্ষ্য। শত্রুর মোকাবিলায় তিনি বাঙালি জাতিকে নির্দেশ দেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক।’ স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্তপর্বে ৭ মার্চের এই ভাষণ গোটা জাতিকে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানী শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের পর থেকেই পূর্ব বাংলার নিয়ন্ত্রণভার বাংলার মানুষের হাতে চলে যায়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হতে থাকে দেশ। কিছু সেনানিবাস ছাড়া দেশের অন্য কোথাও পাকিস্তানী শাসনের কোনো নিদর্শন ছিল না। জাতির পিতার এই সম্মোহনী ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালি জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
তিনি বলেন, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চের কালরাতে অতর্কিতে নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ঢাকাসহ দেশের শহরগুলোয় হাজার হাজার মানুষ হত্যা করে।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। স্বাধীনতা ঘোষণার পর পরই বঙ্গবন্ধুকে ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। কারাগারে তিনি অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন। সামরিক আদালতের বিচারে তাকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়।
জাতির পিতার নির্দেশে পরিচালিত ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার এই ভাষণের দিক-নির্দেশনাই ছিল সে সময়ের বজ্রকঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যার পর সামরিক শাসকরা এবং পরবর্তীকালে বিএনপি-জামাত জোট জাতির পিতার এই ভাষণকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারি গণমাধ্যমে নিষিদ্ধ ছিল এই ভাষণের প্রচার। কিন্তু সাধারণ মানুষের হৃদয় থেকে কোনোদিনই মুছে যায়নি এই ভাষণ।
প্রধানমন্ত্রী এ উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মা বেগম ফজিলাতুন নেছাসহ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শাহাদতবরণকারী পরিবারের সকল সদস্য এবং মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান এবং তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন।
আজকের বাজার:এলকে/এলকে ১ নভেম্বর ২০১৭