বাংলাদেশের শিশু-কিশোর

 

শিক্ষা পর্যালোচনা

হায়দার আহমদ খান এফসিএ
একটি দেশের উন্নয়নের মাত্রা মূল্যায়ন করা হয় তার সমাজের সভ্যতার মাপকাঠিতে। সভ্য সমাজের মূল্যায়ন করা হয় সমাজের মানুষ কতটুকু সুশাসন উপভোগ করে, আইন কতটুকু প্রভাবমুক্ত ও সুন্দরভাবে চলে, আইনের দৃষ্টিতে সব মানুষ সমান- এমন ইস্যুতে। আরো বিবেচনায় নেওয়া হয় আইন তার নিজস্ব গতিতে কতটুকু চলে এবং আইন অমান্যকারির সংখ্যা কত। বর্তমান বিশে^র সকল দেশে সময় অসময়ে দেশের প্রচলিত আইন-কানুন না মানার চেষ্টা দেখা যায় কিছু মানুষের মধ্যে। দেশ ভেদে তার সংখ্যা ভিন্ন। উন্নত বিশে^ একরকম, উন্নয়নশীল জগতে অন্যরকম এবং অনুন্নত দেশে অবশ্যই অমান্যকারীর সংখ্যা একটু বেশি। উন্নয়শীল বা অনুন্নত দেশে আইন প্রয়োগের গুরুত্ব বেশি সমাজ উন্নয়নের জন্য। সমাজ উন্নয়নের প্রথম ধাপ শুরু হয় শিশু-কিশোরদের শিক্ষিত করার মধ্য দিয়ে। একটি দেশের প্রচলিত আইন-কানুন যদি সরকার প্রশাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে- তাহলেই দেশের মানুষের আর্থিক অবস্থা উন্নত হয়, সভ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ন হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে।
সম্প্রতি এক সংবাদে প্রকাশ, চুরির অভিযোগে খুঁটিতে বেঁধে পিটিয়ে ১৬ বছরের এক কিশোরকে হত্যা করা হয়েছে। ১৬ বছরের কিশোর সাগরের হত্যার দ্রুত বিচার শেষ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সমাজ দেখতে চায়। কারণ এ ক্ষেত্রে অপরাধি শুধু আইন হাতে তুলে নেয় নাই, একই সাথে এক মানবসন্তানকে হত্যা করেছে। মানবসন্তান হত্যা এক গুরুতর অমার্জনীয় অপরাধ।

১৬ কোটির উপরে জনসংখ্যা বিশিষ্ট বর্তমান বাংলাদেশের প্রায় ৭ কোটি মানুষ সংগ্রাম করছে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সমাজের উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা দরিদ্রতা। এই দরিদ্রতার বেড়াজালে প্রায় ৮ কোটি মানুষের আনাগোনা। এক ডলার (পিপিপি) এর নীচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ২০১৫ সালে শতকরা ৪৩.৩ ভাগ (সূত্র: বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৬) অর্থাৎ প্রায় ৭ কোটি। তাদের একটি অংশের দৈনিক আয় ১.২৫ মার্কিন ডলারেরও নিচে। বাংলা টাকায় যা দাঁড়ায় ১০০ টাকার মত। বাংলাদেশের এমন একটি পরিবারের এক সদস্যের নাম হাসিনা খাতুন, যাঁর ছেলের নাম ছিল সাগর- যাকে চুরির অভিযোগে হত্যা করা হয় এবং নিহত হওয়ার সময় বয়স ছিল ১৬ বছর। এই দরিদ্রতা সমাধানের জন্য জাতিসংঘের সাথে বাংলাদেশ সরকারও গ্রহণ করেছে দ্বিতীয় পর্বের কর্মসূচী ”ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষং”- যার ১৭টি উদ্দেশ্য ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ সালের মধ্যে। পরিকল্পনা আছে দীর্ঘদিন যাবত। কিন্তু সাগরের মত কিশোরের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে স্বাধীনতার ৪৬ বছরেরও শিক্ষায় সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে যা টেকসই দরিদ্রতা বিমোচনের প্রধান হাতিয়ার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ছিল ৭.৫০ কোটি আর এখন দৈনিক ১ শত টাকার কম আয় করা মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭ কোটি।

চিন্তা করা যায়, ১৬ বছরের কিশোর সোমবার ভোরে নিজ বাসস্থান থেকে অনেক দূরে অন্য উপজেলায় কেন গেল! চিন্তা করা যেতে পারে, হাসিনা খাতুনের এই সন্তান যদি ছেলে না হয়ে মেয়ে হতো- তাহলে এই ১৬ বছর বয়সে তাকে কি অবস্থায় থাকতে হত! হাসিনা খাতুন কি তার মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে শহরের বস্তিতে রাখতে পারতেন? যা বাল্য বিবাহের আওতায়। সবই আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার ফসল। সংবাদে দেখা যায়, চুরির সন্দেহের অভিযোগে সেই ১৬ বছরের কিশোর ধরা পরে তার বসত ঠিকানা ময়মনসিংহ থেকে বেশ অনেক দূর গৌরীপুরে, তাও আবার ভোরে। যে সময় এমন বয়সের কিশোরের থাকার কথা পরিবারের সাথে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার আগের কাজ সম্পন্ন করার কাজে ব্যস্ত থাকার কথা। সংবাদে প্রকাশ, ছেলেটি পরিত্যক্ত সামগ্রী কুড়িয়ে বিক্রি করত। তিন জনের সংসারে তার বাবা প্রসাধন সামগ্রী ফেরি করে বিক্রি করেন। এই হল সাগরের পরিবারের আর্থিক অবস্থার চিত্র।

বিশ^ব্যাংকের শিক্ষার মান বিষয়ক এক প্রতিবেদনের সূত্রে ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ তারিখের দৈনিক ইত্তেফাকের এক সংবাদে দেখা যায়- নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে প্রতি একশ জনের ৯০ জন প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করছে। তাদের মধ্যে ৬১ জন নিম্ন মাধ্যমিক পার হতে পারছে। মাত্র ৩৫ জন উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পার হতে পারছে। তাদের শিক্ষার মান এমন যে, ৪৬ থেকে ১৭ বিয়োগ করলে কত হবে এমনটির সমাধান করতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষার মান এবং হার নিয়ে বেশি আলোচনার দরকার নেই। ১৬ কোটি মানুষের দেশে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ১২ লাখের মত অংশ নিয়ে ৮ লাখের মত ছেলেমেয়ে সরকারের ফরমুলায় সার্টিফিকেট ধারি হয়ে চাকুরীর জগতে যোগ্য বিবেচিত হচ্ছে। হিসাব অনুযায়ী ৪০ লাখের মত অংশ নেওয়ার কথা। কর্মজগতে ঠিকই প্রবেশ করছে এমন সংখ্যক তবে শিক্ষাজাতীয় কর্মক্ষেত্রের বাইরের জগতের প্রতিনিধি হয়ে একটি বড় অংশ। যুব সম্প্রদায়ের যে অংশ শিক্ষার আলো পেয়েছে তাদের মধ্যে আবার অনেকেই মানসম্মত শিক্ষার যোগ্যতা দেখাতে অনেক সময় ব্যর্থ হন। ফলে অল্প বেতনে বা যোগ্যতার বিবেচনায় নিম্নতম পদে কাজ করতে হচ্ছে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নতি নির্ভর করছে বর্তমান শিশু-কিশোরদের উপর। এদের মাঝেই আছে পরবর্তি প্রজন্মের সকল স্তরের সকল নেতা। বর্তমান প্রজন্মের কাজ তাদেরকে যোগ্য নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলা। তাদের মধ্যে যেন সাগরের মত ১৬ বছরের কিশোর পরিত্যক্ত সামগ্রী কুড়িয়ে বিক্রির কাজ না করে বরং শিক্ষায় সম্পৃক্ত থাকে। আমাদের সমাজের নেতৃস্থানীয়রা চিন্তা করবেন এমন সমাজ ব্যবস্থার যে ব্যবস্থায় তাদেরকে চুরির অভিযোগে প্রাণ দিতে হবে না। কেউ নিজ হাতে আইন তুলে নিবে না। সাগরের মৃত্যু সংবাদ শুনে বলতে হবে না ”ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। লজ্জায়-ঘৃণায় কুঁকড়ে উঠতে হয়”। অন্যদের আর যাই হোক না কেন, বাংলাদেশের সকল শিশু-কিশোর তার শাসনতান্ত্রিক অধিকার-শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের নিশ্চয়তার ব্যবস্থা পাক। সাগরের মত শিশু-কিশোরদের একটি অংশ দিয়ে আর যাই হোক- জাতীয় গড় আয় বাড়লেও সাগরের মত অনেকের অকালে প্রাণ দেওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। মনে রাখতে হবে ২ এবং ১০০ এর গড় ৫১ হতে পারে, তাই বলে দুজনের আলাদা মান ৫১ নয় বরং ২ এবং ১০০, একজনের প্রভাব অন্যজনের ক্ষেত্রে শুণ্য।

হায়দার আহমদ খান এফসিএ
চেয়ারম্যান, এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট এসোসিয়েশন-ইডিএ।