বাল্যবিবাহ এবং অধিক সন্তান জন্ম দান নারীর জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়

ঊনচল্লিশ বছর বয়সী রুনিয়া সরকার (ছদ্মনাম) তিন সন্তানের মা। থাকেন নরসিংদী সদর উপজেলায়। আর্থিক অসচ্ছলতা আর সচেতনতার অভাবে মাত্র দশম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়েই বিয়ে দিয়ে দেয় বাবা-মা। বিয়ে হয় একই এলাকার পংকজ সরকারের সাথে। বিয়ের মাত্র দুই মাসের মাথায় অন্ত:সত্তা হয়ে পড়েন রুনিয়া। আর তাই পরে আর মেট্রিক পরীক্ষা দেয়া হয়নি তার। কিন্তু স্বামী তাকে আশ্বস্ত করেন বাচ্চা হওয়ার পরে সে আবার পড়ালেখা করতে পারবে। এভাবেই এক সময় বিএ পাশ করে। বিএ পাশের পর চাকরী হয় এক সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

স্বামীও একটি এনজিওতে চাকরী করেন। তিন সন্তান নিয়ে সুখেই চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে শরীরটা বিগড়ে আছে। প্রায় সময়ই তল পেটে যন্ত্রণা আর প্রশ্রাবের জ্বালা-পোড়া। শেষ পর্যন্ত এক গাইনী ডাক্তারের সাথে কথা বলেন রুনিয়া। অনেক পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর জানা যায় রুনিয়া জরায়ুমূখ ক্যান্সারে আক্রান্ত। যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থা।

ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসারের (আইএআরসি) সূত্র মতে বাংলাদেশের নারীরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন স্তন ক্যানসারে, এর পরেই জরায়ুমুখের ক্যানসারের স্থান। প্রতি বছর জরায়ুমুখের ক্যানসারে বাংলাদেশে ৮,০৬৮ জন আক্রান্ত হয় আর মৃত্যু বরণ করেন প্রায় ৫০০০ জন। এছাড়াও বিশ্বে প্রতিবছর এই রোগে আক্রান্ত হয় প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ নারী। আর মৃত্যু হয় প্রায় ৩ লাখ।

গাইনী বিশেষজ্ঞ ডা. মনোয়ারা হক বলেন, মূলত জরায়ুমুখ ক্যান্সারের অন্যতম কারন হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) নামের এক ভাইরাস। আর এই এইচপিভি বিভিন্ন ধরনের আছে, যার মধ্যে এইচপিভি ১৬ ও ১৮ জরায়ুমুখ ক্যান্সারের জন্য সবচেয়ে বেশী মারাত্মক।

তিনি বলেন, মূলত যেসব মেয়েদের বাল্যবিবাহ হয় এবং যেসব নারী অধিক সন্তান জন্ম দেন তারাই এই জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ঝুঁকিতে বেশী থাকে। এছাড়াও নারীর ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছনতার বিষয়টিও রয়েছে। যেসব অল্পবয়সী নারী পিরিয়ডের সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে না পারে তাদের বিভিন্ন ধরনের জীবানু আক্রমন করতে পারে। আর তাই পিরিয়ডের সময় অবশ্যই পরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করতে হবে এবং নিজেকে পরিষ্কার রাখতে হবে।

ডা. মনোয়রা বলেন, অল্প বয়সী মেয়ে বিশেষ করে ৯ থেকে ১৫ বছর বয়সী মেয়েদের জন্য রয়েছে এইচপিভি টিকা। একটু দামী হলেও এই টিকা দিয়ে দেওয়াই উত্তম। এছাড়াও বেশী বয়সী নারীদের জন্য রয়েছে ক্যান্সার স্ক্রিনিং। ক্যান্সার স্ক্রিনিং এর মাধ্যমে সহজে এই রোগ নির্ণয় করা যায় এবং পরবর্তী চিকিৎসা দ্রুত শুরু করা যায়।

আরেক গাইনী রোগ বিশেজ্ঞ ডা. শাহানা আক্তার বলেন, আমাদের দেশে বিশেষ করে এখনো গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের বয়:সন্ধির সময় নোংরা কাপড় ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। এসময় তাদের স্কুল পর্যন্ত বন্ধ করে দেয় কিছু কিছু অভিভাবক। অথচ তার কোন দরকারই হয়না। এখন বাজারে অল্প দামে দেশীয় তৈরী বিভিন্ন ধরনের প্যাড পাওয়া যায় এবং তারা এসব সহজেই ব্যবহার করতে পারে।

তিনি বলেন, এসব বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম আরো বেশী পরিমানে বাড়াতে হবে। যদিও বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার স্বাস্থ্য সেবা ঘরের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক অন্যতম। কিন্তু তারপরও কিছু কিছু মানুষ এখনো এসব সেবা নিতে আগ্রহী নয়। তাদেরকে এসব সেবার আওতায় আনার জন্য আরো বেশী পদক্ষেপ নিতে হবে।

ডা. শাহানা বলেন, প্রাথমিকভাবে এই ক্যান্সার ধরা পড়লে খুব সহজেই এ থেকে নিরাময় সম্ভব। নিয়মিত ঔষুধ সেবন করলে এ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তবে যদি দেরীতে ধরা পড়ে তবে তা অনেক সময় জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে। অনেক সময় চিকিৎসকেরও আর কিছু করার থাকে না। আর তাই এ বিষয়ে পরিবারের সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরী করতে হবে।

তিনি বলেন, এখনো পর্যন্ত আমাদের দেশের নারীরা এসব মেয়েলী শারীরিক সমস্যা কারো সাথে আলোচনা করতে লজ্জা পায়। একেবারে চরম পর্যায়ে না গেলে তারা তা কাউকে জানায় না পর্যন্ত। এমনকি অনেক বিবাহিত নারীরাও তাদের স্বামীর সাথে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন না। এরফলে অনেক নারীই এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু বরন করেন। যা কখনোই কাম্য নয়।

তিনি সরকার এবং বিভিন্ন এনজিও যেসব সংস্থা এসব বিষয়ে কাজ করেন তাদেরকে এ বিষয়ে আরো বেশী জোরালো ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। খবর-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান