বাসযোগ্য ঢাকা গড়তে প্রয়োজন কার্যকরী পরিকল্পনা

রাজধানী ঢাকার উন্নয়নে নেয়া হয়েছে অনেক পরিকল্পনা। তবে এসব পরিকল্পনার বেশির ভাগই ভুল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এজন্য জনসংখ্যাবহুল এই নগরীকে বাসযোগ্য করে তুলতে হলে কার্যকরী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে না এগোলে ঢাকা তার বাসযোগ্যতা হারাবে বলেও সতর্ক করে দিয়েছেন তারা।

২৮ অক্টোবর শনিবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে মেয়রদের অংশগ্রহণে এক আলোচনা সভায় বিশেষজ্ঞরা এই মত দেন।

‘বিল্ডিং নলেজ নেটওয়ার্ক অ্যান্ড পার্টনারশিপ ফর সাসটেইনেবল আরবান ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ বিষয়ক আলোচনা সভায় বাংলাদেশের প্রায় ৩২২ জন পৌরমেয়র অংশ নেন। অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বিশ্বব্যাংক। সহযোগিতায় ছিল মিউনিসিপল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি), বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট, ইনস্টিটিউট অব সুইস এজেন্সি।

এতে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন, বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর কিমাও ফান, সুইডারল্যান্ডের অ্যাম্বাসেডর রেন হলিন্সট্রিন মিউনিসিপল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আব্দুল বাতেন সভার বিভিন্ন সেশনে সভাপতিত্ব করেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্পিকার বলেন, ‘যেসব মেয়র এখানে এসেছেন তারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। তারা তাদের নিজস্ব এলাকায় নিরন্তনভাবে পরিশ্রম করছে। তারা বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। জনসেবা দিতে তারা কাজ করে যাচ্ছেন।’ দুই দিনের আলোচনায় সমস্যার একটি সমাধান বেরিয়ে আসবে বলে মনে করেন স্পিকার।

স্পিকার বলেন, ‘আজকে দেশি-বিদেশি পারস্পরিক মতবিনিময়ের মধ্যে থেকে অনেক সমস্যার সমাধান উঠে আসবে। একটি পদ্ধতিতেই যে সমস্যার সমাধান করা যাবে তা নয়। সবার নিজস্ব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার ক্ষেত্রে পরিকল্পনাগুলো প্রয়োগ করতে হবে। এতে নতুন পথ উদ্ভাবন হবে বলে আশা করি।’

শিরীন শারমিন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্থনীতি ভালো পর্যায়ে রয়েছে। দ্রুত নগরায়নের যে সমস্যা ও চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তা মোকাবেলা করতে এই সরকার সক্ষম বলে আমি মনে করি।’

স্পিকার বলেন, ‘সমগ্র বাংলাদেশ থেকে আগত ৩২২ জন মেয়রকে নিয়ে যে আলোচনা, এটা একটা বড় প্লাটফর্ম। আশা রাখি এখানে বিভিন্ন সমস্যার কথা উঠে আসবে এবং তাতে সমাধানের পথ বের হবে।’

বিশ্বব্যাংকের লিড আরবান স্পেশালিস্ট বালাকৃষ্ণ মেনন বলেন, ‘আমি ২০ বছর আগে ঢাকায় এসেছিলাম। সে সময় ঢাকার সমস্যা নিয়ে এক সেমিনারে কথা বলেছি। সে সময় ঢাকার জনসখ্যার সমস্যা ছিল, আজও এসে শুনি একই সমস্যা। গত পাঁচ বছরে ঢাকায় দুই মিলিয়ন লোক এসেছে কর্মসংস্থানের জন্য। ঢাকার এ চাপ কমাতে হলে অন্যান্য জেলা শহরগুলোতে কর্মসংস্থানে ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকার জন্য একটি কার্যকর পরিকল্পনা করতে হবে।’

বিশ্বব্যাংকের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘দেখা যায় অনেক সময় ভুল পলিসি গ্রহণ করা হয়েছে ঢাকা শহরের জন্য। আমার চেয়ে আপনারা ভালো জানেন, ঢাকায় কী পরিমাণ ট্রাফিক সমস্যা, ড্রেনেজ ব্যবস্থার কী সমস্যা। এখানে অপরিকল্পিতভাবে শহর গড়ে উঠেছে। তাই খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে এর জন্য একটি কার্যকরী পরিকল্পনা করতে হবে। অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন লিডারশিপ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য লক্ষ্য স্থির করা।’

বালাকৃষ্ণ মেনন ঢাকার বিভিন্ন উন্নয়নের প্রশংসা করে বলেন, ‘আমি গুলশানে গিয়েছি সেখানে খুব সিমসাম রোড দেখতে পেলাম। আমি এখানে নিউ থিংস দেখেছি। আশা রাখি আগামী ২০ বছর পর ঢাকার আজকের সমস্যা থাকবে না।’

বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর কিমাও ফান বলেন, ‘শহরের খুব দ্রুত উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রতিরোধ করতে হবে। বাংলাদেশের দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের জন্য আমরা এক সঙ্গে কাজ করতে চাই। ৫০তম স্বাধীনতা দিবসে অবশ্যই বাংলাদেশকে নিশ্চিত করতে হবে টেকসই শহরায়ন।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘আমরা ঢাকা সিটির জন্য বিশ্বমানের পরিকল্পনা করছি। উন্নত বিশ্বের সিটিগুলোর অভিজ্ঞতা আমরা নিচ্ছি। গত জুলাইয়ে আমরা বিশ্বব্যাংককে নিয়ে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম সেখানে ঢাকার বিভিন্ন সমস্যা উঠে এসেছিল। আমরা সেগুলো সমাধানে কাজ করছি। যেখানে বিভিন্ন দাতা সংস্থা আমাদের সহায়তা করছে। বিশ্ব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, আমরাও বিশেষভাবে ঢাকাকে পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর নগরী গড়তে কাজ করছি।’

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় সেশনে সিটি লিডারশিপ অ্যান্ড গুড গভরনেন্স বিষয়ক আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন ক্লেমশন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসন জেমস এইচ স্পেনসার।

এই অধিবেশনে নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভি বলেন, ঢাকা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে নারায়াণগঞ্জ। ঢাকার কাছে হলেও উন্নয়ন তেমন হয়নি। এটা আলোর নিচেই অন্ধকার। উন্নয়ন কিছুই হয়নি তা নয়, কিছু কিছু উন্নয়ন হয়েছে, পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের এখানে স্থানীয় সরকারকে কীভাবে দুর্বল করে রাখা যায় এর চিন্তা করা হয়। কিন্তু উন্নত রাষ্ট্রে স্থানীয় সরকারকে কীভাবে শক্তিশালী করা তা ভাবা হয়।

আইভী বলেন, দেশের প্রত্যেক পৌরসভা ও সিটিতে সমস্যার ধরণ ও চিত্র ভিন্ন। বাংলাদেশের সব মেয়র প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

স্থানীয় সরকারের অর্থ বরাদ্দ নিয়ে তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশন বিভিন্ন প্রকল্প জমা দিয়ে টাকা পাচ্ছে। সে তুলনায় পৌরসভা খুব কম টাকা পায়। তবে আগের চেয়ে অনেকটাই টাকা বাড়ানো হয়েছে।’

আইভী বলেন, ‘আমরা স্বাবলম্বী হতে চাই। সড়ক, জনপদ, রেলসহ অন্যান্য খাস জমি আমাদের ব্যবহারের জন্য দেয়া হোক। আমরা এ জমিগুলো ভাড়া দিতে দিয়ে অর্থ পেতে পারি।’ এসময় পৌরসভাগুলোতে সরকারের বাজেট বাড়ানোর অনুরোধ করেন আইভী।

বক্তব্য শেষে উপস্থিত মেয়ররা আইভীকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। জবাবে আইভী বলেন, আজকের অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী থাকলে আপনাদের এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতেন। আমি এ বিষয় কিছু বলতে চাই না। আপনারা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করতে পারেন।

দ্বিতীয় সেশনে ফিলিপাইনের মেয়র মেল সেনেন এস সারমিনতো বলেন, ‘মেয়রদের উচিত সুশাশন নিশ্চিত করা এবং উন্নয়ন ত্বরান্নিত করতে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা।’ এসময় তিনি ফিলিপাইনের অবস্থা তুলে ধরে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার পক্ষে মত দেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের সল্টলেক সিটির মেয়র রালফ বেকার বলেন, ‘বাংলাদেশের শাসনের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শাসন আলাদা। আমরা বিকেন্দ্রীকরণ ক্ষমতার চর্চা করি। প্রতিনিয়ত আমাদের কাছে অনেক লোক আসে অসংখ্য সমস্যা নিয়ে আসে। আমাদের কাজ হলো কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে এর প্রতিকার করা। আমার শহর কীভাবে গতিশীল করবো আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করি। আমি মনে করি এটা বাংলাদেশেও প্রযোজ্য। আমাদের শহরে সর্বত্রই যোগাযোগের আওতায় এনেছি। আমাদের শহরে যখন অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল, কর আদায় হচ্ছিল না তখন ব্যবসায়ীদের আহ্বান জানালে তারা এগিয়ে আসে উন্নয়নের জন্য।’

এই সেশনে আরও বক্তব্য দেন ঝিনাইদহ পৌরসভার মেয়র সাইদুল করিম মিন্টু। তিনি তার পৌরসভার বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি তুরে ধরে বলেন, আমার ৩০ হাজার টাকা বিলবোর্ড আয়কে কয়েক লাখে নিয়ে গিয়েছি। আগে এ টাকাটা এককভাবে নিত বাড়িওয়ালারা, এখন সেটা পৌরসভাও পাচ্ছে।

দিনের তৃতীয় সেশনে শহর পরিকল্পনা ও টেকসই অবকাঠামো বিষয়ে আলোচনা হয়। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশে নগর পরিকল্পনা নেই। পৌরসভার নিজস্ব আয় কম। পৌরসভার মোট ব্যয়ের ৩২ থেকে ৩৫ শতাংশ তারা বহন করতে পারে। বাকি অর্থের জন্য সরকার ও দাতা সংস্থার দিকে চেয়ে থাকতে হয়।

এ সেশনের সভাপতিত্ব করেন বিশ্বব্যাংকের ইভারজেলিন কিম কুইনসো। বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ইনিস্টিটিউট অব প্লানার্স এর প্রফেসর ড. আখতার মাহমুদ, ক্যালিফোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রবার্ট কারবেরো।

অনুষ্ঠানে আগত মেয়রদের পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার আবেদন জানানো হয়। তারা বলেন, স্থানীয় সরকারের বাজেট বাড়াতে হবে। পৌরসভাগুলোয় নিজস্ব আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি পৌরসভাকে ২০০ একর জমি বরাদ্দ দেয়ার দাবি জানান তারা। এ জমি ব্যবহার করে পৌরসভাগুলো সেখানে বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন করবে। শিল্পকারখানা গড়ে তুলবে। পৌরসভার আয়ের একটা পথ বের করবে।

দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠান সকাল ১০টায় শুরু হয়। আগামীকাল শেষ হবে দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলন।

আজকের বাজার:এলকে/এলকে ২৮ অক্টোবর ২০১৭