বাড়ছে অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবার জনপ্রিয়তা

নাজমুল লিখন: গণপরিবহন সংকট, অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা আর সিএনজি চালকদের দৌরাত্মে ঢাকায় যাত্রীদের নাকাল হওয়ার চিত্র প্রায় রোজকার। এই দর্দশা থেকে রেহায় পেতে যাত্রীদের অনেকেই এখন নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন মোবাইল ফোনে অ্যাপভিত্তিক গাড়ির শেয়ার নেটওয়ার্ক উবারের ওপর। অ্যাপভিত্তিক মোটরবাইক সেবাও শুরু হয়েছে এখন। পরিবহন সেবার পাশাপাশি বহু মানুষের কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হচ্ছে। তাই বিকল্প এই পরিবহন সেবার জনপ্রিয়তা বাড়ছে দিনে দিনে।

উবার সেবা চালুর ৬ মাসের মাথায় এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের বিভিন্ন নগরীর তুলনায় শীর্ষ তালিকায় স্থান পায় ঢাকা। বাংলাদেশে প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গত ৩ ডিসেম্বর ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে উবার। সেখানে বলা হয়, শুধু নভেম্বরেই ১৫ লক্ষ মানুষ উবার অ্যাপ গাড়ির অনুরোধ পাঠিয়েছেন। তার মধ্যে ২ লাখের বেশি মানুষ উবার ব্যবহার করেছেন। প্রতি মাসে ১০ হাজারেরও বেশি চালক এবং প্রতিদিন শত শত চালক উবারে যোগ দিচ্ছেন।

অন্যদিকে মোটরবাইক সেবা দেওয়ার অ্যাপগুলোও জনপ্রিয় হচ্ছে। ফলে স্থানীয় সিএনজি অটোরিকশার ব্যবসা ব্যাপক মার খাচ্ছে। এসব অ্যাপ বন্ধের দাবিতে লাঘাতার ধর্মঘটের হুমকি দিয়েছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে উবারের দক্ষিণ এশিয়া অপারেশন্স হেড প্রদীপ পরমেশ্বর বলেছেন, ‘কারোর ব্যবসা দখল করার উদ্দেশ্য আমাদের নয়। উদ্দেশ্য হচ্ছে যতো মানুষের সাথে সম্ভব একত্রে কাজ করা। লক্ষ লক্ষ মানুষ আমাদের সেবায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। বিশে^র বহু দেশে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি আমরা।’

গেল বছরের নভেম্বরে ঢাকায় উবারের সেবা চালুর পর বিআরটিএ সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এই সেবাকে অবৈধ ঘোষণা করেছিল। কিন্তু দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এই পরিবহন সেবা বন্ধ না করে নীতিমালা করার কাজে হাত দেয় সরকার। এ্যাপভিত্তিক এই পরিবহন সেবার অনুমোদন দিতে পর্যালোচনা করছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর।

যাত্রী সেবার জন্য উবারের নিজস্ব কোনো গাড়ি নেই। ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকরা গুগল প্লে স্টোরে গিয়ে নির্দিষ্ট অ্যাপ ডাউনলোড করে নিবন্ধনের মাধ্যমে উবারের চালক হয়ে যেতে পারছেন। মালিকদের মতো একই অ্যাপ ব্যবহার করে সেবা পাচ্ছে যাত্রীরা। চালক ও যাত্রী, উভয় পক্ষকেই অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধিত হতে হচ্ছে আগে। গ্রাহকের কলে সাড়া দেওয়া মাত্রই উবার চালকের নাম, ছবি, রেটিং, গাড়ির লাইসেন্স নম্বর যাত্রীর স্মার্টফোনে ভেসে ওঠে। চালকও যাত্রীর নাম ও রেটিং দেখতে পান। যাত্রা শুরুর আগে গন্তব্য ঠিক করে সম্ভাব্য ভাড়া জানতে পারেন যাত্রী। নগদ বা কার্ডে ভাড়া পরিশোধ করা যাচ্ছে।

ঢাকার পর চট্টগ্রাম ও সিলেটেও সেবা চালুর পরিকল্পনা রয়েছে উবারের। পাশাপাশি ‘উবারপুল’ নামের একটি সেবাও চালুর চিন্তাভাবনা চলছে। এটি চালু হলে একজন গ্রাহক উবারের গাড়ি নিলে তার সাথে আরো কয়েকজনও ওই গাড়িতে ভ্রমণ করতে পারবেন। এতে খরচ ভাগাভাগির সুবিধা পাওয়া যাবে।

তবে আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় ঢাকায় উবারের ভাড়া বেশি নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রথম দিকে গত নভেম্বরে কিলোমিটার প্রতি উবারের ভাড়া ছিল ১৮ টাকা, জানুয়ারিতে তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ২১ টাকা। ওয়েটিং চার্জ মিনিটে দুই টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে তিন টাকা। এর সঙ্গে আগের ভিত্তিভাড়ার হার ৫০ টাকা যোগ করা হয়েছে। অন্যদিকে ভারতে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া প্রায় ১২ টাকা, ওয়েটিং চার্জ এক টাকা ৯৬ পয়সা। পাকিস্থান, মিয়ানমারেও উবারের ভাড়া ঢাকার চেয়ে কম।

অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে ভাড়া বেশি হওয়ার বিষয়টি স্বীকারও করেছে উবারের কর্মকর্তারা। এজন্য গাড়ির দাম বেশি হওয়াকে দায়ী করেছেন তারা।

উবারের জনপ্রিয়তার ধারায় স্থানীয় কিছু প্রতিষ্ঠানও অ্যাপভিত্তিক মোটরবাইক সেবা শুরু করেছে। এগুলোর মধ্যে পাঠাও’র অবস্থান শীর্ষে। এর ভিত্তি ভাড়া ২০ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া দশ টাকা। গত মাসে কার সেবাও চালু করেছে প্রতিষ্টানটি। নাম দেওয়া হয়েছে ‘পাঠাও কার’। এর আগে তারা চট্টগ্রামে কার সেবা শুরু করে। পাঠাও কার-এর ভিত্তি ভাড়া ধরা হয়েছে ৫০ টাকা, প্রতি কিলোমিটার ২০ টাকা এবং প্রতি মিনিট আড়াই টাকা।

এছাড়া অন্যান্য মোটরবাইক সেবার মধ্যে রয়েছে স্যাম, চলো, আমার বাইক, আমার রাইড, ময়ুর, ওয়েজ। যাদের নিজস্ব বাইক আছে তারা অ্যাপে নিবন্ধন করে চালক হিসেবে আয় করতে পারেন।

কয়েক মাস আগেও ঢাকায় সিনএনজি অটোরিকশা চালকদের তোষামদি করে চলতে হতো যাত্রীদের। ইচ্ছেমত ভাড়া আদায়ের পাশাপাশি নানারকম টালবাহানা করতেন চালকরা। কিন্তু এখন সে পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়েছে। অটোরিকশা চালকদের রোজগার আর আগের মতো নেই।

সম্প্রতি ফার্মগেটে যাত্রীর জন্য অপেক্ষামান একজন চালক আসাদুল হক বলছিলেন, ‘উবার, পাঠাও আইসা আমগো কপাল পুড়ছে। আগের মতো খ্যাপও মারতে পারিনা, ভাড়াও ঠিকমত হয়না। মালিকের জমার টাকা তুলতেই হিমশিম খাওন লাগে।’

অন্যদিকে যাত্রীরা রয়েছেন অনেকখানি স্বস্তিতে। কল্যাণপুরের বাসিন্দা কান্তা ইসলাম বলছিলেন, ‘ভিড়ের কারণে বাসে উঠা যায় না। সিএনজিতে যাওয়ার জন্য চালকদের হাতে পায়ে ধরা লাগতো আগে। অনেক সময় নির্দিষ্ট গন্তব্যেও যেতে চাইত না চালকরা। ভাড়াও নিত ইচ্ছেমত। কিন্তু ৫/৬ মাস ধরে উবারের মাধ্যমে যাতায়াত করছি, কোন ঝামেলা নেই। ঘরে বসেই ফোনে উবারের গাড়ি ডাকতে পারছি।’

মিরপুরের শ্যাওড়াপাড়ার বাসিন্দা আল-আরাফাত মোটরবাইক সেবা পাঠাও ব্যবহার করে নিয়মিত অফিস যাওয়া করছেন প্রায় ৩ মাস ধরে। তিনি বলছিলেন, অফিসে যাওয়া-আসার সময় বাসে উঠতে তো রীতিমত যুদ্ধ করা লাগে। সিএনজি চালকদেরও নানা টালবাহানা। এসব দেখতে দেখতে অতিষ্ট ছিলাম। এখন পাঠাও ব্যবহার করে বেশ স্বস্তিতে আছি। ঝামেলা কম, সময়ও বাচে।

কর্মসংস্থানে নতুন মাত্রা : পরিবহন সেবার পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে অ্যাপভিত্তিক এই সেবা। অসংখ্যা বেকার যুবকের পাশাপাশি খন্ডকালিন পেশা হিসেবে অনেকেই এই সেবা বেছে নিয়েছেন। স্বাধীন ভাবে অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকায় প্রতিনিয়ত অনেকেই যুক্ত হচ্ছেন এই সেবায়। যে কেউ চাইলে অ্যাপ ভিত্তিক পরিহন সেবার সাথে নিজেকে যুক্ত করতে পারেন।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামসুল হক বলেন, যাত্রীরা সঠিক সেবা পেতে চায়। কিন্তু নানা কারণে কাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত নগরবাসী। সেই জায়গায় স্থান করে নিচ্ছে এসব সেবা। তাদের প্রয়োজনেই এরকম সেবার জনপ্রিয়তা বাড়ছে। সেবার পাশাপাশি গাড়ির মালিক না হয়েও গাড়িতে চড়ার সখও পূরণ হচ্ছে অনেকের। বহু মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। তবে এই সেবাকেও সরকারকে একটা নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। যাতে করে সেই আগের মত যাত্রী হয়রানি না হয়।