দেশের বিচার বিভাগকে প্রশাসনের প্রভাবমুক্ত করা নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বলেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে আমরা প্রচুর আন্দোলন করেছি। এ নিয়ে আইন পাস হয়েছে। কিন্তু সেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আবারও প্রশাসনের হাতে চলে গেল। কোনোভাবেই এটাকে মুক্ত করা গেল না।
মঙ্গলবার ১২ ডিসেম্বর সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে ২৫ জন রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েটস প্রতিনিধি নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী পরিষদের প্যানেল পরিচিতি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তিনি।
ফখরুল দাবি করেন, বিচার বিভাগকে মুক্ত করতে গিয়ে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রধান বিচারপতির পদ হারিয়েছেন এবং দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন।
গণতন্ত্র ও নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নিজেদের সব সত্যকে ফিরিয়ে আনতে হবে জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন,এখন এই একটি পথই আছে। কারণ আমরা প্রতিবাদ করতে গেলেই মামলা দিয়ে দাবিয়ে রাখা হয়। এই যে আমরা নির্বাচন (রংপুর সিটি করপোরেশন) করছি, এর ফল কী হবে? এর ফল শূন্য।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন,অত্যন্ত কঠিন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেটে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এই সময়টা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচাইতে কলঙ্কজনক একটি অধ্যায়। আজকে গণতন্ত্রের নামে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হচ্ছে। গণতন্ত্রের নামে আমাদের মৌলিক অধিকারগুলো কেড়ে নেয়া হচ্ছে। গণতন্ত্রের নামে আমাদের শিক্ষক সমাজের অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে। ছাত্রসমাজের অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে অথবা তাদেরকে একঘরে করে রাখা হচ্ছে। তাদেরকে কোনোরকম কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে অংশ নিতে দেয়া হচ্ছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি বিশেষ দলের প্রাধান্য বিস্তার করছে।
ফখরুল বলেন,১৯৭১ সালে যে চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম সেই চেতনাগুলো আজকে ধ্বংস হতে চলেছে। যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা মুক্তচিন্তার পাদপীঠ বলে মনে করি, এই দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার বলে মনে করি, গর্ববোধ করি, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন পুরোপুরিভাবে একটি একদলীয় চিন্তাভাবনার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকে দুর্ভাগ্য আমাদের যে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৬/৪৭ বছর পরে আমরা এধরনের পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছি। এধরনের কলঙ্কময় একটি পরিবেশের মধ্যে আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেটে নির্বাচন করতে হচ্ছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন,আমরা জানি না নির্বাচনের ফল কী হবে? তবে এটুকু জানি যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে বাংলাদেশের মুক্তিকামী ও গণতন্ত্র চিন্তার মানুষকে অনুপ্রেরণা জোগাবে। এখানে জয়-পরাজয় প্রধান লক্ষ্য হবে না। লক্ষ্য হবে আমাদের লড়াই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
দেশের চলমান সংকটময় পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকায় দুঃখ প্রকাশ করে মির্জা ফখরুল বলেন,যখন দেখি দেশের স্বার্থ, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয় কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো প্রতিবাদ আসে না। তখন খুবই দুঃখ হয়, কষ্ট লাগে যখন দেখি ছাত্র-ছাত্রীরা নির্মমভাবে নিহত হয়, অন্যায়ের কাছে পরাজিত হয়, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো প্রতিবাদ আসে না। অধিকার আদায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো সোচ্চার কণ্ঠ ভেসে আসে না।
ফখরুল বলেন, ‘আমরা ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন,৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ভূমিকা সেটা ফিরে চাই। বিশেষ করে গণআন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যে নেতৃত্ব দিয়েছিল সেটা ফিরে চাই। আমরা ফিরে চাই আবারো বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে দাঁড়াবে এবং পথিকৃৎ হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সামনে রেখে বাংলাদেশের মানুষ আবারো উজ্জীবিত হবে। আমরা ত্যাগ স্বীকার করে লক্ষ্যে অটুট থাকলে ইনশাল্লাহ গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবো।
মির্জা ফখরুল আরও বলেন,এ ধরনের নির্বাচনে বিএনপি আন্দোলন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবেই অংশ নেয়। কারণ গণতন্ত্রের মধ্যেই নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। আর এই গণতন্ত্রের আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বেরিয়ে আসতে হবে। মুক্তচিন্তা ও অধিকার রক্ষার আন্দোলন বের করতে হবে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে- যতক্ষণ না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো আন্দোলন শুরু হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত সেই আন্দোলন লক্ষ্যে পৌঁছায় না।’ সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট নির্বাচনকে শুধু সিনেট নির্বাচন হিসেবে না নিয়ে আমাদের গণতন্ত্রকে মুক্তচিন্তার অধিকারকে মুক্তকরার নির্বাচন হিসেবে নেয়ার আহবান জানান তিনি।
নির্বাচন পরিচালনা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও ঢাবি সাদা দলের আহবায়ক অধ্যাপক আকতার হোসেন খান লিখিত বক্তব্যে বলেন, আগামী ৬ ও ১৩ জানুয়ারি ২০১৮ ঢাকার বাইরের কেন্দ্রসমূহে এবং ২০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রসমূহে দেশের দ্বিতীয় পার্লামেন্ট হিসেবে পরিচিত ঢাবি সিনেটের ২৫ জন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটস প্রতিনিধি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব, ধর্মীয় মূল্যেবোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক জাতীয়তাবাদী পরিষদ মনোনীত প্রার্থীরা অংশগ্রহণ করছে।
প্যানেলের পক্ষে ৭টা এজেন্ডা তুলে ধরেন আকতার হোসেন খান। এজেন্ডাগুলো হলো- ঢাবির ভাবমূর্তি ও মান-মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা, একাডেমিক কার্যক্রমের দৃশ্যমান উন্নয়নসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে সিনেটকে সম্পৃক্ত, কেবলমাত্র বাজেট অনুমোদন ও উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করার মধ্যেই সিনেটকে সীমাবদ্ধ না করা, শিক্ষক নিয়োগ মেধার মূল্যায়নকেই একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যানজট সমস্যার সমাধান করা ও নিরাপত্তা জোরদার, দলমত নির্বিশেষে সব ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ক্যাম্পাসে সহাবস্থান নিশ্চিত এবং ছাত্র- ছাত্রীদের প্রাণের দাবি ডাকসু নির্বাচন নিয়মিত অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা।
জাতীয়তাবাদী পরিষদের প্রার্থী যারা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে ২৫ জন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটস প্রতিনিধি নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী পরিষদের প্রার্থীরা হলেন- অধ্যাপক ড. আ ফ ম ইউসুফ হায়দার, ড. উম্মে কুলসুম রওজাতুর রোম্মান, এ কে এম ফজলুল হক মিলন, এ টি এম আবদুল বারী ড্যানী, এ বি এম ফজলুর করিম, এ বি এম মোশাররফ হোসেন, ডা. এস এম রফিকুল ইসলাম বাচ্চু, কে এম আমিরুজ্জামান শিমুল, ড. চৌধুরী মাহমুদ হাসান, ড. জিন্নাতুন নেছা তাহমিদা বেগম, অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার, ডা. প্রভাত চন্দ্র বিশ্বাস, ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার, ড. মোহাম্মদ আবদুর রব, ড. মোহাম্মদ আলমোজাদ্দেদী আলফেছানী, ডা. মোহাম্মদ রফিকুল কবির লাবু, মো. আশরাফুল হক, অ্যাডভোকেট মো. মাসুদ আহমেদ তালুকদার, ডা. মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, ড. মো. শরীফুল ইসলাম দুলু, মো. সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, অধ্যক্ষ মো. সেলিম ভূঁইয়া, মো. সেলিমুজ্জামান মোল্যা সেলিম, শওকত মাহমুদ, ড. সদরুল আমিন।
আজকের বাজার:এলকে/এলকে ১২ ডিসেম্বর ২০১৭