অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত বলেছেন, বিশ্বের যে কয়টি অঞ্চলে ভালো মানের ইউরেনিয়াম রয়েছে তার মধ্যে মায়ানমারের রাখাইন একটি। ইউরেনিয়াম ছাড়াও প্রচুর প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ রয়েছে এখানে। ভূ-রাজনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান এই রাখাইন। বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এ সম্পদ আহরণে বহুমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করতে চায়। আর সেই কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ‘রহস্যজনক’ আচরণ করছে ভারত- চীনের মতো দেশগুলো।
তিনি বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর যে নির্যাতন করছে তা শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, গণহত্যা, জাতিগত নিধন ও সমাজ গোষ্ঠী হত্যা।
২৯ সেপ্টেম্বর শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘মায়ানমারে রোহিঙ্গা নিধনের প্রতিবাদ’ বিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি এ সম্মেলনের আয়োজন করে।
ড. বারকাত বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের সরকারকে বিশেষ অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা প্রসারিত ও জোরদার করতে হবে। কারণ রোহিঙ্গা সংকট কোনো সাধারণ সাময়িক আপদকালীন বিষয় নয়।
মায়ানমার সেনাদের সহিংসতা থেকে বাঁচতে গত ২৫ আগস্টের পর ৪ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এখনো এ স্রোত অব্যাহত আছে। এ সেনা অভিযানকে জাতিসংঘ মায়ানমার সরকারের জাতিগত নিধন বলে আখ্যায়িত করেছে। তবে তা বরাবরই অস্বীকার করছে দেশটি।
এদিকে এ ইস্যু বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশকে সহায়তা দিচ্ছে। ভারত-চীনও ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা পাঠিয়েছে। তবে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেওয়ার ইস্যুতে তারা প্রকাশ্যভাবে বাংলাদেশকে সহায়তা করার ব্যাপারে স্পষ্ট সহায়তা করেনি। এমনকি রোহিঙ্গা ইস্যুতে তারা মিয়ানমার না বাংলাদেশকে সমর্থন করছে তা ‘অস্পষ্ট’।
আবুল বারকাত বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা শঙ্কিত। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন-অত্যাচার বন্ধ না করলে বর্তমান ভয়াবহ পরিস্থিতি আস্তে আস্তে আরও ভয়ঙ্কর হবে।
জাতিসংঘের তথ্য মতে, হত্যা-নির্যাতন বন্ধ না হলে এ দফায় বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা অচিরেই ১০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বিগত কয়েক সপ্তাহে প্রায় ২ হাজার নারী, শিশু ও সাধারণ নিরস্ত্র বেসামরিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির নাগরিকদের মিয়ানমার সেনা-পুলিশ সদস্যরা হত্যা করেছে।
বারকাত বলেন, রোহিঙ্গা নিধনসহ মিয়ানমার যে বর্বরতম হত্যাচজ্ঞ চালাচ্ছে তা কেবল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিতে দেখা গেছে।
রোহিঙ্গা নিধন, নির্যাতন বন্ধে ভারত, চীন, রাশিয়া, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সকল বৃহৎ ও ক্ষমতাধর রাষ্ট্রকে মায়ানমারের ওপর কূটনৈতিক চাপ, প্রভাব বিস্তারের আহবান জানান তিনি। একইসঙ্গে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মায়ানমারকে চাপ প্রয়োগের আহবানও জানান তিনি।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমিতির পক্ষ থেকে ১২টি দাবি ও সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এরমধ্যে অন্যতম হলো- আশ্রয় শিবিরে সকল রোহিঙ্গাকে নিবন্ধিত করা। তাদের থাকা-খাওয়া-চিকিৎসা দেওয়া। সমন্বিতভাবে এ প্রয়াস অব্যাহত রাখা।
রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের উপর যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত চাপ সৃষ্টি করছে তা মোকাবেলায় ভারত, চীন, রাশিয়া, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্সসহ সকল রাষ্ট্র, সরকার ও জনগণের সহযোগিতা ও সমর্থন আদায়ের চেষ্টা জোরদার করা।
এছাড়া ৯ লাখ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে মায়ানমারের ওপর প্রভাব বিস্তার,মায়ানমার সেনা-পুলিশের বিচারে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলা, মায়ানমার সরকারের ওপর অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবিতে সোচ্চার হওয়া,মায়ানমারের স্বৈরশাসকের বিদেশি ব্যাংক হিসাব জব্দ, কপি আনান কমিশনের সুপারিশ ও প্রধানমন্ত্রীর ৫টি প্রস্তাব পুরোপুরি বাস্তবায়নে জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে আবুল বারকাত বলেন, ৫ লাখ রোহিঙ্গার ফলে দেশে কি পরিমাণ অর্থনৈতিক সমস্যা হতে পারে তা নির্ভর করছে তাদের থাকার ওপর। তবে শুধু অর্থনৈতিক নয়, পরিবেশগত অনেক ক্ষতি হবে। রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে আসিয়ানভুক্ত রাষ্ট্র ও প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক, যোগাযোগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন এ অর্থনীতিবিদ।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চীন মায়ানমারে যোগাযোগ, খনিজ, প্রাকৃতিক সম্পদসহ বিভিন্ন খাতে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ভূ-রাজনৈতিক সমস্যার কারণে চীন বাংলাদেশকে সমর্থন করবে না। আর মায়ানমারে ভারতের বেসরকারি খাতে বহু বিনিয়োগ রয়েছে। বিশেষ করে এসব দেশের নজর রাখাইনের খনিজ সম্পদের দিকে। সেজন্য তারা রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের পাশে সেভাবে নেই। তারপরও বাংলাদেশকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
আজকের বাজার : এলকে/এলকে ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭