বিনিয়োগ সম্প্রসারণে কর্পোরেট কর হার কমানোর সুপারিশ বিশেষজ্ঞদের

বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশের উন্নয়নে করপোরেট কর হার আরও কিছুটা কমিয়ে এনে করের আওতা বাড়িয়ে কর আহরণ বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাতের বিশেজ্ঞরা।
কর আহরণের জন্য নতুন নতুন খাত বাছাই করা,স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে কর আহরণসহ কর আদায় ব্যবস্থা আরও বেশী করদাতা বান্ধব করার মাধ্যমে দেশের রাজস্ব আয় বাড়ানোর পরামর্শ দেন তারা।
বুধবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় রাজস্ব ভবন সভাকক্ষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট আলোচনায় তারা এসব সুপারিশ তুলে ধরেন।
এনবিআর সদস্য (কাস্টমস নীতি) মো. মাসুদ সাদিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআই ও সিপিডি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, যুক্তরাজ্য ভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান পিডব্লিউসি, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), অডিট ফার্ম স্নেহাশিষ এন্ড মাহমুদ কোম্পানি সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা আলোচনায় অংশ নেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে পিআরআই নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘শিগগির বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হতে যাচ্ছে। কিন্তু এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর রপ্তানিতে অনেক সুযোগ সুবিধা আমরা হারাবো। ওই সময়ে আমাদের ব্যবসায়ীদের কর সুবিধা দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হবে। ওই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমাদের করপোরেট কর হার প্রতিযোগি দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। তাই কর্পোরেট কর হার কমিয়ে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
উল্লেখ্য, গত দুই বাজেটে ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে কর কমানোর ফলে বর্তমানে দেশের কর্পোরেট কর হার ৩০ শতাংশ। আর শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ। চীন, ভারত ভিয়েতনামসহ প্রতিযোগি দেশগুলোর করপোরেট কর হার ক্ষেত্র বিশেষে ১৫ শতাংশেরও নীচে।
বাংলাদেশের জিডিপি’র অনুপাতে রাজস্ব হার ১০ শতাংশের নীচে উল্লেখ করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘কর জিডিপি‘র হার বজায় রাখার ক্ষেত্রে অন্যদেশের তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে। তাই আওতা বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে কর হার কমানো যেতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি আমরা কর হার কমিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। কিন্তু আমাদের রাজস্ব আদায় কমেনি বরং বেড়েছে।
কর আহরণ ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয় করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, করদাতা এবং সংগ্রহকারীর মধ্যে দূরত্ব ঘোচাতে হবে। কারণ করদাতা যদি মনে করেন যে, কর দিতে তাকে দূরে যেতে হবে, তাহলে তিনি কর দিতে উৎসাহ পাবেন না।
তিনি মনে করেন যে, করাদাতা যেখানে থাকেন সেখানেই যদি কর পরিশোধ করার পদ্ধতি থাকে, তাহলে করাদাতা কর দিতে উৎসাহিত হবেন।
প্রবীণ অর্থনীতিবিদ রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনায় যথাযথ স্থানে লোকবল নিয়োগের উপর গুরুত্বারোপ করেন।
অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন আহমেদ উল্লেখ করেন, দেশের ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর লাইসেন্স নবায়ন ফি নেওয়া হয় না। তিনি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর উপর টার্ণওভার কর বসানোর পরামর্শ দেন।

আলোচনায় পিডব্লিউসির ম্যানেজিং পার্টনার মামুন রশিদ বলেন, আন্তর্জাতিক পরামর্শক সংস্থার কাছ থেকে ৪৩ দশমিক ৭ শতাংশ হারে কর নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে আসার উৎসাহ পান না। তাই এই কর কমানোর প্রস্তাব করেন তিনি।
স্নেহাশিষ মাহমুদ কোম্পানির ম্যানেজিং পার্টনার  স্নেহাশিষ বড়ুয়া দেশের সিটি কোর্পোরেশনগুলোতে হোল্ডিং ট্যাক্সের সাথে টিআইএন বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, হোল্ডিং ট্যাক্সের সাথে টিআইএন বাধ্যতামূলক করলে তারা অবশ্যই কর দিতে বাধ্য হবে। এছাড়া তিনি জমির খাজনা দেওয়ার ব্যবস্থায় ই-টিআইএন ব্যবস্থা চালু করার পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি মৌজা রেট যৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি করার সুপারিশ করেন।
স্নেহাশিষ বলেন, ১৯৯৮ সালের এক আইন অনুসারে কোনও বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশে লিয়াজোঁ অফিস করলে সেই কোম্পানি যদি মনে করে যে তার কর্মচারিদের কর তার নিজের দেশে দিবে তাহলে দিতে পারে। এই আইন বাতিলের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে ব্যবসা করে তার দেশে কর দিলে আমি রাজস্ব কোথায় পাব।’
বৈঠকে সিপিডি প্রতিনিধি সৈয়দ ইউসুফ সাদাত নতুন বাজেটে তামাকের ওপর কর স্ল্যাব না করে শলাকা হিসাবে কর বসানোর প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, বর্তমানে চারটি স্ল্যাব করে কর বসানো হচ্ছে। কিন্তু প্রতিবছর তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে, কোম্পানির লাভ বেশি হচ্ছে, কিন্তু তামাক ব্যবহার কমানোর যে প্রধান উদ্দেশ্য সেটা পূরণ হচ্ছে না। তাই শলাকা ভিত্তিক কর বসানোর প্রস্তাব দিয়ে তিনি প্রতি শলাকায় ১০ টাকা হারে কর বসানোর পরামর্শ দেন।
আলোচনায় বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. আইনুল ইসলাম, এনবিআরের সদস্য জাকিয়া সুলতানা ও ড. শামসুদ্দীন আহমেদ প্রমুখ অংশ নেন।