‘বিপ্লব’ বাংলাদেশে পেঁয়াজ চাষে বিপ্লব আনবে

বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা বা কৃষি উৎপাদন এবং সরবরাহ সবক্ষেত্রেই গেল বছর অর্থাৎ ২০২১ সাল ছিল অনেক ভালো একটা বছর। এর কারণ হলো সরকারের পলিসি। প্রাইভেট সেক্টর অনেক অ্যাক্টিভ ছিল। আমাদের দেশের কৃষক এবং খামারিরা যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়েছে। যার ফলে সবক্ষেত্রেই উৎপাদনে সাফল্য এসেছে। সরবরাহের দিক থেকে আমরা বলব, যারা এই সমস্ত পণ্য সরবরাহ করে, মধ্যসত্বভূগী, তারা সবাই একসাথে চেষ্টা করেছে। যার ফলে সরবরাহটাও যথেষ্ট ভাল ছিল।

আর প্রাপ্তির কথা বলতে গেলে, বাজারঘাট যথেষ্ট চালু ছিল এবং এগুলোর যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। বাজারঘাটে অ্যাক্টিভলি আমাদের রিটেইলাররা বিক্রি করেছে।  যারা স্বপ্নের মতো  রিটেইল সেলার আছে, তারাও কিন্তু অ্যাক্টিভলি পণ্য সরবরাহ করেছে। ফলে সার্বিক কৃষির ভ্যালু চেইনে মোটামুটিভাবে একটা ভালো অবস্থান ছিল।

আমি মনে করি, এই অবস্থানটা জানুয়ারি মাসের এই কয়দিন থেকে আরও তীব্র হয়েছে এবং ২০২২ সাল আরো ভালো হবে। সর্বক্ষেত্রে ২০২২ সাল কৃষিতে ভালো কিছু করা যাবে।

কেন পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা: আসলে পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা নিয়ে বলতে গেলে, এর ব্যবস্থাপনায় কখনো পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাচ্ছে, আবার কমে যাচ্ছে। এর পিছনের কারন হচ্ছে, আমাদের দেশের পেঁয়াজের দরকার হচ্ছে ৩৫ লক্ষ মেট্রিক টন। আমরা শীতকালে একটা ফসল পাই। সেখানে উৎপাদন হয় মাত্র ২৫-২৬ লক্ষ মেট্রিক টন। আরো দশ লক্ষ মেট্রিক টন আমাদের ঘাটতি থেকে যায়। ঘাটতি হওয়ার পিছনে কারন হচ্ছে, আমাদের দেশে পেঁয়াজের স্টোরেজ করার মতো সেরকম কোনো সিস্টেম নাই বা আমাদের ক্যাপাসিটি নাই। আমাদের কোল্ড হাউজ আছে, কিন্তু কন্ডিশনিং হাউজ নাই। যার ফলে পেঁয়াজ বেশি দিন রাখা যায় না। ফলে দেখা যায়, উৎপাদন থেকে ছয় সাত মাসের মধ্যেই পেঁয়াজ পচা শুরু হয় এবং পেঁয়াজের একটা সংকট তৈরি হয়। যার ফলে আমদানি করে এই সংকটের মোকাবেলা করা হয়। এই আমদানির পরিমাণ ১০ লক্ষ মেট্রিক টন। আমদানি করেই আমাদের সংকট মোকাবেলা করতে হয়। আমরা যে দেশ থেকে আমদানি করছি, সে দেশের পেঁয়াজের চাহিদা আছে। তাদের নিয়মকানুন আছে আইন আছে। তারা যদি দিতে চায়, তাহলে আনা সম্ভব, না দিলে কিন্তু আনা যাবে না।

আমদানি সমাধান নয়: তাহলে আলটিমেটলি দেখা গেল যে, পেঁয়াজ বাহির থেকে আনাটা খুব একটা ভালো সমাধান নয়। তাই এই দশ লক্ষ মেট্রিক টন পেঁয়াজ, যেটার ঘাটতি হচ্ছে, এটার একটা সমাধান দরকার। কিভাবে সমাধান করা যায়? ইদানিং আমরা  ভালো পেঁয়াজের জাত উদ্ভাবন করেছি। এই পেঁয়াজের  বীজ আনা হয়েছে নেদারল্যান্ড থেকে। আমরা একসাথে গবেষণা করে দেখেছি যে, এই  পেঁয়াজের জাত বর্ষাকালে বা গৃষ্মকালে যথেষ্ট সহনশীল এবং উৎপাদন ভালো হয় । এই পেঁয়াজের সাদ আমাদের দেশের পেঁয়াজের মতই। এটাকে হারভেস্ট করার পরও দেড় মাস পর্যন্ত রাখা যায়।  এই পেঁয়াজটা যদি শীত এবং গ্রীষ্মকালে উৎপাদন করা যেতে পারে। তাহলে শীতকালে যেটা উৎপাদন করা হবে, সেই ২৫ লক্ষ মেট্রিক টন পেঁয়াজ দিয়ে ৮-৯ মাস চলে যাবে। আর গৃষ্মকালে যে পেঁয়াজ উৎপাদন করা হবে, সেটা দিয়ে বাকি তিন মাস চলে যাবে। তাহলে শীতকালে পেলাম ২৫ লক্ষ টন, গ্রীষ্মকালে পেলাম ১০লক্ষ টন, মোট ৩৫ লক্ষ টন। তখন আমাদের আর পেঁয়াজ আমদানি করা লাগবে না।

নতুন জাতের পেয়াজ ‘বিপ্লব’: আমাদের দেশে এই নতুন জাতের পেঁয়াজের পরিচিতি করা হয়েছে। এটা পরীক্ষা করা হচ্ছে গত দু’বছর থেকে। গত বছরই আমরা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করেছি এবং এটা হারভেস্ট ও হয়েছে। আমাদের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সিনিয়র কর্মকর্তারা মাঠে হার্ভেস্টের সময় সরেজমিন ছিলেন এবং তাদের ধারণা এটা খুব ভালো পেঁয়াজ। এই পেঁয়াজের ইল্ড ৩০ থেকে ৩২ টন। এই পেঁয়াজ দেশের বিভিন্ন জায়গায় উৎপাদিত হয়েছে। তার মানে, আমাদের দেশে সাধারণত পেঁয়াজ উৎপাদনে ইল্ড হয় ১০ থেকে ১৫ টন। আর এটা যদি ৩০ থেকে ৩২ টন হয় তাহলে বুঝতেই পারছেন, একদিকে ইল্ড বেশি, আরেকদিকে অসময়ে পাওয়া যাচ্ছে। তাহলে লাভ হবে কৃষকের। অসময়ে যখন পেঁয়াজ উঠবে, ভালো দাম পাবে এবং একই জমিতে দুই থেকে আড়াই গুণ বেশি পেঁয়াজ পাচ্ছে। তাহলে একদিকে দেশের লাভ হল। পেঁয়াজের অভাব থাকবে না। আর ভোক্তার বেশি দামে কিনতে হবে না।  কৃষকও যথেষ্ট ভাল মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারবে।

এই টেকনোলজি যথেষ্ট সহনশীল। আমি মনে করি এই  টেকনোলজি পেঁয়াজের বিপ্লব আনবে। এই জন্য আমরা এই পেঁয়াজের নাম দিয়েছি ‘বিপ্লব’। এই বিপ্লব পেঁয়াজ দেশের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম সব জাগাতেই উৎপাদন করা সম্ভব।

সংরক্ষনের উপায়: পেঁয়াজ স্টোরেজের ব্যাপারে বলবো, আমরা পেঁয়াজ হারভেস্ট করার পর যেটা হয়, অনেকে এটাকে শুকিয়ে সুন্দর করে বস্তাতে বা মেঝেতে রেখে দেয়। অনেকে কোল্ডস্টোরেজে রাখে। কিন্তু কোল্ডস্টোরেজগুলো পেঁয়াজ রাখার জন্য উপযোগী নয়। ঠাণ্ডা ঘরে রাখলে পেঁয়াজ তাড়াতাড়ি পচে যাবে। অর্থাৎ আমাদের দেশে পেঁয়াজ সংরক্ষণের মতো ক্যাপাসিটি নাই। এই ক্যাপাসিটি তৈরি করতে হবে। এটা কঠিন কিছু নয়। এখন নতুন টেকনোলজি বেরিয়েছে। এখানে টেম্পারেচার ১-২ ডিগ্রি সেলসিয়া এবং হিউমিডিটি থাকবে ৯৮ শতাংশ। তাহলে পেঁয়াজ কিন্তু এই তাপমাত্রায়  পচে যাবে না। রং নষ্ট হবে না। যার ফলে পেঁয়াজ ফেলে দিতে হবে না। এই টেকনোলজি নেদারল্যান্ডে পর্যাপ্ত আছে।

আমরা মাননীয় কৃষিমন্ত্রী সাথে নেদারল্যান্ড গিয়েছিলাম। এই টেকনোলজি আমরা সেখানে দেখে এসেছি। আমাদের দেশে এই টেকনোলজি প্রয়োগ করলে, শীতকালেও পেঁয়াজ  উৎপাদন হবে।  এই পেঁয়াজ হিউমিডিটি ওয়্যারহাউজে ৮-৯ মাস সংরক্ষণ করা যাবে। তাহলে দেখা যাবে পেঁয়াজের তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। একদিকে উন্নতমানের বীজ পাওয়া যাবে, যেটা গৃষ্ম এবং বর্ষাকালে ব্যবহার করা যাবে। অন্যদিকে স্টোরেজের ক্যাপাসিটি বাড়ানো হলো। এই দুই মিলে পেঁয়াজের সমস্যা সমাধান করা যাবে।

সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে: আমরা পেঁয়াজের টেকনোলজি পেলাম। পরীক্ষা করে দেখলাম এটা উৎপাদন হয়। হারভেস্ট করে দেখলাম, ইল্ড ভালো হচ্ছে এবং কৃষকের আগ্রহ আছে। কিন্তু এটাকে  সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। কারণ পেঁয়াজের ক্রাইসিস হঠাৎ করেই হয়। সেজন্য যত দ্রুত ছড়িয়ে দেয়া যাবে, ক্রাইসিস ততো অল্প সময়ে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। এজন্য কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগকে সম্পৃক্ত হতে হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের মোটিভেট করে, পেঁয়াজের উৎপাদন সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। এর সাথে সরকার যদি বীজে ভর্তুকি দেয়, তাহলে কৃষক বীজগুলো পাবে। তারা অল্প জমিতে চাষ করে দেখবে। সেখানে উৎপাদন ভালো হলে পরের বছর ব্যাপকভাবে চাষ করবে। তাহলে ওভারঅল দ্রুত এই পেঁয়াজ সারাদেশে ছড়িয়ে যাবে।

ঘাটতি মেটাতে হবে: এখন, এই দশ লক্ষ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদনে জমির পরিমাণ কতটুকু লাগবে? যেখানে ইল্ড দেখেছি ৩০ থেকে ৩২ মেট্রিক টন, সেখানে ৩০ হাজার হেক্টর জমি হলেই কিন্তু গোটা দেশেই এই পেঁয়াজ উৎপাদন করা সম্ভব। আর এই ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ উৎপাদন হবে প্রায় ১০-১২ লক্ষ টন। সেটা দিয়েই দেশের পেঁয়াজের ঘাটতি পূরণ করা যাবে।

পেঁয়াজ রপ্তানির ক্ষেত্রে বলা যায়। আমাদের দেশে যেমন পেঁয়াজের দরকার আছে, নেপালেও দরকার আছে। ভুটানেও দরকার আছে। পার্শ্ববর্তী অনেক দেশে পেঁয়াজের প্রয়োজন থাকে। আমি মনে করি, প্রথমে আমাদের দেশের চাহিদা পূরণ করে যদি বেশি উৎপাদন করা যায়, তাহলেই রপ্তানি করা যাবে।

আমাদের বিপ্লব: আমরা ‘বিপ্লব’ নিয়ে যেটা করেছি সেটা হচ্ছে, নেদারল্যান্ডের ইস্ট-ওয়েস্ট শিপ কোম্পানির আমরা বাংলাদেশে এক্সক্লুসিভ ডিস্ট্রিবিউটর হয়েছি। এই কোম্পানি থেকে পেঁয়াজের বীজ আমরা  নিয়ে আসছি। তারপর পরীক্ষামূলক বিভিন্ন জায়গাতে টেস্ট করেছি এবং সেটার ভালো রেজাল্ট পাচ্ছি। যার ফলে এখন বাণিজ্যিক উৎপাদন করছি। আমরা যখন ক্রপ কাটিং করলাম, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সিনিয়র কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমাদের সাথে ডিলাররাও ছিলেন। আমরা দেখেছি, এটা আমাদের দেশে আবহাওয়ায় সহনশীল এবং উৎপাদন করা সম্ভব। এই পেঁয়াজ চাষে ভালো  ইল্ড পাওয়া যাবে। আমরা এভাবেই কাজ করছি। আমরা এই বীজ আমদানি করব এবং ছোট ছোট প্যাকেট করে কৃষকের কাছে সরবরাহ করব। এভাবেই আমাদের দেশে পিয়াজের বিপ্লব ঘটে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।

ড এফ এইচ আনসারী

প্রেসিডেন্ট, এসিআই এগ্রিবিজনেস লিমিটেড