দু মুঠো খাবার আর নিরাপত্তার আশায় ভিন্নপথে হাটতে বাধ্য হচ্ছে বাংলাদেশের আশ্রিত রোহিঙ্গা নারীরা। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ফাঁদে ফেলে জোর করে যৌন নির্যাতন চালাচ্ছে স্থানীয় নারী পাচারকারী দল।
৫ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা নারীরা যৌন নির্যাতনের ঝুঁকিতে রয়েছে এমন সম্ভাবনা আগেই বলেছিল জাতিসংঘ। আজ সোমবার মার্কিন গণমাধ্যম বিবিসিতে প্রকাশিত হয়েছে যৌন নির্যাতনের শিকার এক রোহিঙ্গা নারীর বক্তব্য।
ওই নারী বাংলাদেশে আসার পর কিভাবে তাকে পতিতাবৃত্তি করতে বাধ্য করা হয়, তারই মর্মান্তিক বিবরণ উঠে এসেছে ওই প্রতিবেদনে।
২১ বছর বয়সী হালিমা এ ব্যাপারে বিবিসির সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়। গোলাপি ওড়নায় মুখ ঢেকে হালিমা বলেন, যখন আমরা বাংলাদেশে আসি,আমাদের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে এক স্থানীয় বাংলাদেশি ব্যক্তি আমাদের খাবার খেতে দেয়।
ওই ব্যক্তি হালিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তার সঙ্গে কক্সবাজার চলে যান হালিমা। তবে কক্সবাজারে যাওয়ার পর বিশ্বাস ভেঙে যায় তার।
কক্সবাজারে ওই ব্যক্তির বাড়িতে আরো ৭-৮জন মেয়েকে দেখতে পান হালিমা। সেই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি ভয় পেয়ে যাই। আমাকে একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে বাধ্য করা হয়।
হালিমা তিন মাস আগে উত্তর রাখাইন রাজ্য থেকে নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। তিনি জানেন না কোথায় তার পরিবার ও প্রতিবেশিরা। মিয়ানমার থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে আরো দুবির্ষহ অবস্থায় পড়েন তিনি।
হালিমা জানান তিনি দুই মাস ওই বাসায় ছিলেন। বাসাটি ছিল একজন বাংলাদেশি নারীর। হালিমা বলেন, আমাকে সবসময় সাজ সজ্জা করে থাকতে হতো। এক রাতে একসাথে ২-৩ জন মানুষও আসতেন বাসায়। আমার অনেক কষ্ট হতো ও অনেকদিন ধরে রক্তপাত হতো।
এত দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যেও কোনো আয় হতো না হালিমার। শুধু তিন বেলা খাবার পেতেন তিনি।
হালিমার কাহিনী মোড় ঘুরে একজন বাংলাদেশি পুলিশের মাধ্যমে। ওই পুলিশ কর্মকর্তা একদিন পতিতালয়ে যায়। হালিমা সব খুলে বলেন তাকে।
হালিমার ভাষ্যে, আমার কথা শোনার পর সে আমাকে ‘বোন’ ডাকে। সারারাত সে আমার সঙ্গে ছিল। কিন্তু আমার সঙ্গে সে কিছুই করেনি। বরং আমাকে তার ফোন নম্বর দেন।
একদিন হালিমাকে ওই বাসায় অনেক নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনে ১৫ দিন যাবত অসুস্থ ছিলেন তিনি। তখন সে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
এ অবস্থায় অপর এক খদ্দের তার কাছে আসলে তিনি ওই পুলিশকে ফোন করেন। মাঝরাতে ছয় জন পুলিশ নিয়ে ওই পুলিশ কর্মকর্তা সেখানে অভিযান চালান। হালিমাসহ সাত জন মেয়েকে উদ্ধার করা হয় অভিযানে।
কিন্তু মুক্ত হয়েও কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না হালিমার। নি:স্ব অবস্থায় হালিমা কক্সবাজারেই থেকে যান। পতিতাবৃত্তির রাস্তায়ই আবার হাঁটতে হয় তাকে।
হালিমা এখন অন্য এক নারীর সঙ্গে থাকেন যে পতিতাবৃত্তিতে লিপ্ত। এখানেও আগের মতো তিন বেলা খাবার দেওয়া হয়।
তরুণী হালিমার মতে যে নিরাপত্তার আশায় তিনি সীমান্ত পারি দিয়েছিলেন,স্পষ্টভাবেই এটা সেই জীবন নয়।
হালিমা বলেন, আমি আমার পরিবারের সঙ্গে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে চাই। একসঙ্গে খাবার খেতে চাই। মিয়ানমারে আমার পরিবারের সঙ্গে আগের জীবনে ফিরে যেতে চাই আমি।
জাতিসংঘের শরনার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার ফিলিপো গ্রানডি বলেন, রোহিঙ্গারা যৌন নির্যাতনের ঝুঁকিতে রয়েছে। একেবারেই নি:স্ব অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে তারা। জাতিসংঘ রোহিঙ্গা শরনার্থীদের ক্যাম্পে মাইক্রোফোন লাগানোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। যাতে কেউ হারিয়ে গেলে তারা মাইক্রোফোনের সাহায্যে ঘোষণা দিতে পারে।
প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গাদের পুর্নবাসনে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশিদের বিয়ে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। রোহিঙ্গাদের চলাচলও সীমিত করা হয়েছে।
কিন্তু তবু এ ব্যাপক পরিমাণ রোহিঙ্গা শরনার্থীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছে স্থানীয় দুষ্কৃতিকারী ও নারী পাচারকারীরা। বিশেষ করে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে পতিতাবৃত্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে তারা। নিরাপত্তা ও উন্নত জীবনের আশায় প্রলোভনে ফাঁদে পা দিচ্ছে রোহিঙ্গা নারীরা।
আজকের বাজার:এলকে/এলকে ১৩ নভেম্বর ২০১৭