বিশ্ব অর্থনীতি ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট:
বিশ্বের অর্থনীতি সম্পর্কে আমাদের দেশের সকল মানুষ এবং সরকার অবহিত আছে। এ পরিস্থিতির প্রভাব প্রতিটা খাতে বিদ্যমান আছে। আমরা যাই কিছু করি না কেন, পরিবহন, যাতায়াত ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ উৎপাদন, কল-কারখানা, কৃষি কাজসহ সবকিছুতেই বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রভাব বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে পড়েছে। যার ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, স¤প্রতি সরকার ডিজেল ও সারের দাম বাড়িয়েছে। আমরা দেখছি, যেহেতু ডিজেলের দাম বেড়ে গেছে, সাথে সাথে বাংলাদেশের কৃষিতে এর প্রভাব পড়েছে।
প্রথমত কৃষি পণ্য পরিবহন করার জন্য ট্রাক ও ছোট ছোট পরিবহন ব্যবস্থা প্রয়োজন। ইরিগেশন করার জন্য ডিজেল পাম্প, চাষ করার জন্য ট্রাক্টর, ধান কাটার জন্য যে যন্ত্র, তাতে ডিজেল লাগে। অন্যান্য ফসল কাটার জন্যও ডিজেল প্রয়োজন। অতএব ডিজেলের একটি ভালো ইম্প্যাক্ট রয়েছে কৃষি খাতে। সারের ক্ষেত্রেও একইরকম। ধান চাষের জন্য এবং অন্যান্য ফসল চাষের জন্য ইউরিয়া সার হলো অন্যতম। সারের দাম বাড়াতে এখানেও একটি প্রভাব পড়েছে কৃষি খাতে। আমরা একটি হিসাব করে দেখেছি, মাঠ ফসল থেকে শুরু করে সবজি, ডিম, মাছ-মাংস, দুধ সর্বক্ষেত্রে ডিজেল ও সারের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে। একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, ডিজেলের দাম বাড়ার কারনে প্রতি কেজি ধান উৎপাদন করতে খরচ বেড়েছে ১ টাকা ৭৫ পয়সা আর ইউরিয়া সারের দাম বাড়াতে প্রতি কেজিতে খরচ বেড়েছে ৩০ পয়সা। অর্থাৎ এক মনে প্রায় ৮০-৯০ টাকা বেড়ে গেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে গত ২ বছরে ধানের দামও অনেক বেড়েছে। ধান হারভেস্ট করার পর কৃষক ভালো দাম পেলে তার ক্ষতি কম হবে। অন্যান্য বছরের মত যদি হারভেস্ট করার পর ধানের দাম কমে যায় তখন অর্থনৈতিকভাবে কৃষক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
ভুট্টা একটি অর্থকারী ফসল আমাদের দেশে। আমরা লক্ষ্য করেছি, সারের দাম বৃদ্ধিতে ৪০ পয়সা প্রতি কেজি ও ডিজেলের দাম বাড়াতে ৯৩ পয়সা প্রতি কেজি অর্থাৎ ভুট্টা উৎপাদনে প্রতি কেজিতে ১ টাকা ৩৩ পয়সা বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ এক মন ভুট্টা উৎপাদন করতে প্রায় ৫০ টাকার মত খরচ বেড়ে গেছে।
আলু একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল আমাদের দেশে। আমরা লক্ষ্য করেছি সার ও ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধিতে আলু উৎপাদন করতে মন প্রতি ২০ টাকা বেড়ে গেছে।
সব ফসলের ক্ষেত্রেই হিসাব করলে এ ধরনেরই চিত্র দেখা যাবে। এর প্রভাব কৃষি খাতের উপর পড়বে। কৃষক যদি ভালো দাম পায় তাহলে এটা তাদের জন্য তেমন ক্ষতি হবে না।
যেহেতু হঠাৎ করে দাম বেশি বেড়ে গেছে তাই এই মুহূর্তে অনেক কৃষক আতঙ্কগ্রস্ত। এবছর অনাবৃষ্টির কারণে চাষের খরচ অনেক বেড়েছে। অনাবৃষ্টির কারণে ইরিগেশন করতে হচ্ছে। ইরিগেশন করতে গিয়ে লোডশেডিংয়ের কারণে কৃষককে ডিজেল পাম্প চালিয়ে ইরিগেশন করতে হচ্ছে। এটা হচ্ছে সার্বিকভাবে কৃষি খাতের বর্তমান অবস্থা।
কৃষি পণ্য উৎপাদন ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি:
আমরা গত ৫০ বছর ধরে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ব্যস্ত ছিলাম। আমাদের এগ্রিকালচার এক্সটেনশন, গবেষণা সর্বক্ষেত্রেই প্রাইভেট ও পাবলিক সেক্টরে উৎপাদন বাড়ানোর প্রতি অগ্রাধিকার ছিল। আমরা কখনোই ভেবে দেখিনি, আমরা যে খাদ্য খাই এটা একটা কমপ্লিট এগ্রিকালচার ভ্যালু চেইনের মাধ্যমে আসে। এই ভ্যালু চেইনে সর্বক্ষেত্রে তেমন কোন অগ্রগতি এত বছর হয়নি। এর ফলে হঠাৎ করে ডিম, মাংস, ভোজ্য তেল, চাল, গমের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা চলতেই থাকবে যতদিন না এই কমপ্লিট ফুড ভ্যালু চেইন বা এগ্রিকালচার ভ্যালু চেইন নিয়ে কাজ না হবে। এগ্রিকালচার ভ্যালু চেইনটা কি? এগ্রিকালচার ভ্যালু চেইন এমন এক প্রক্রিয়া যাতে টেকনোলজি থাকবে, উৎপাদন হবে, অনুশীলনী হতে হবে, পোস্ট হারভেস্ট ফ্যাসিলিটি ও ক্যাপাসিটি থাকতে হবে, এবং পণ্য মার্কেটপ্লেসে বিক্রি হবে। আমাদের দেশে উৎপাদন ছাড়া বাকিগুলোর ভ্যালু চেন তেমনভাবে ফরমালাইজড হয়নি প্রাইভেট ও পাবলিক সেক্টরে। এখন এটার উপর অগ্রাধিকার দিতে হবে। পোস্ট হারভেস্টে সরকারকে বিনিয়োগ করতে হবে। সরকার অতীতে ট্রাক্টরে ইনভেস্ট করেছে। সাবসিডি দিয়েছে ইলেকট্রিসিটি, পাওয়ার টিলার, পাম্প ডিজেল, ইউরিয়া সারে। একইভাবে পোস্ট হারভেস্ট ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে। পাবলিক পোস্ট হারভেস্ট ক্যাপাসিটি বিল্ড করবে, প্রাইভেট সেক্টরে রান করবে এবং কৃষকদের সেবা দিবে মিনিমাম চার্জে। মার্কেট গ্রো করবে। তখন অনেকে প্রাইভেট সেক্টরে একই কাজ শুরু করবে। এরপর প্রসেসিংয়ে জোর দিতে হবে। আমরা এই সিজনে যা উৎপাদন করি, সেটা পরের সিজনে খাই। এই কারণে এক সিজনে যদি আমাদের উৎপাদন বন্ধ হয়। তাহলে ফুড ভ্যালু চেইনে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এটাকে মাথায় রেখে আমরা প্রসেস করে যদি রেখে দিতে পারি, তাহলে সেল্ফ লাইফ পাবে। আরেকদিকে ওয়েস্টেজও কমে যাবে, ভ্যালু এডিশন হবে। সর্বোপরি মার্কেটপ্লেস মডার্ন ট্রেড ডেভেলপ করতে হবে।
আমাদের দেশে মডার্ন ট্রেড আছে স্বপ্ন-তে। এ ধরণের মর্ডান ট্রেডগুলো টোটাল ট্রেডিংয়ের রিটেল চেইনের মাত্র ২ শতাংশ। এটা যদি ব্যাপকভাবে বাড়ানো যায় তাহলে সুবিধা হবে। এই মডার্ন ট্রেডগুলির ক্যাপাসিটি স্মল চেইন থেকে একটু আলাদা। স্মল চেইনগুলো সকালবেলা প্রোডাক্ট নিয়ে আসে, সারাদিন বিক্রি করে। আর মডার্ন ট্রেডগুলো দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা ভাবনা করে পণ্য সরবরাহ করে ও সংগ্রহ করে তাদের দোকানে রেখে বিক্রি করে। এটাই হচ্ছে আমাদের ফুড এগ্রিকালচার ভ্যালু চেনের গুরুত্ব।
ডিমের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে অনেক হৈচৈ হল, দামও কমলো। এটা কিন্তু কেউ কমায়নি বা বাড়ায়নি। আমার রিসার্চ হচ্ছে, ডিম একটি কাঁচামাল। ভ্যালু চেইনের কোথাও হয়তো একটু ব্রেক হয়েছে। অন্যান্য আতঙ্কের সাথে এর দাম বেড়ে গিয়েছিল। আবার যখন সরবরাহ ব্যাপক হয়েছে দাম কমে গেছে। আমরা প্রায়ই দেখতে পাচ্ছি, দুই তিনটা কোম্পানিকে দায়ী করা হচ্ছে। সারা দেশেই মুরগি পালে এবং সমগ্র দেশেই ডিম উৎপাদন হয়। এই দু-তিনটা কোম্পানি সারা দেশের ডিমের কন্ট্রোল করে না। ডিমের দাম সারা দেশেই বেড়েছিল। এভাবে দায়ী করে লাভ হবে না। আমাদের ফোকাস করা উচিৎ এগ্রিকালচার ভ্যালু চেইন-এর দিকে। ফুড ভ্যালু চেইনে মনোযোগ দিতে হবে এবং এর ক্যাপাসিটি বিল্ড করতে হবে।
মডার্ন ট্রেডিং: আমাদের দেশে মডার্ন ট্রেডের টেন্ডেন্সি এখন বেড়েছে। স্বপ্নসহ আরো কয়েকটি চ্যানেল বেশ ভালো করছে। ব্যক্তি পর্যায়ে কিছু মডার্ন ট্রেড আমরা বিভিন্ন ছোট ছোট শহরেও দেখতে পাচ্ছি। মডার্ন ট্রেডিংয়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, এসব দোকান থেকে যদি কেউ পণ্য কেনে, তাকে ভ্যাট দিতে হচ্ছে। বাইরের দোকান থেকে পণ্য ক্রয় করলে ভ্যাট দিতে হচ্ছে না। এই চার-পাঁচ পার্সেন্ট ডিফারেন্স প্রতিযোগিতামূলক হচ্ছে না। যার ফলে এই মডার্ন ট্রেডগুলো অনেক সাফার করছে। প্রসার লাভ করতে পারছে না। এখানে ৩-৪ বছরের জন্য যদি ভ্যাট পুরোপুরি মাফ করে দেয়া যেত তখন এই মডার্ন ট্রেড গ্রো করবে এবং এই ডিফারেন্সটা খুব ইম্প্যাক্ট করত না।
ড. এফ এইচ আনসারী
প্রেসিডেন্ট, এসিআই এগ্রি বিজনেসেস