ব্যাংকিং ক্যাশ ম্যানেজমেন্ট: আলাদা গান লাইসেন্স দরকার

যশোদা জীবন দেবনাথ

‘মানি প্লান্ট লিংক লিমিটেড’ আমাদের একটি কনসার্ন। এর রেসপনসিবিলিটি হলো বাংলাদেশের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা। ফাইন্যান্সিয়াল ইন্ডাস্ট্রি হলো ক্যাশ ম্যানেজম্যান্ট কোম্পানি। বাংলাদেশের ৬০ ভাগ এটিএম মেশিন আমরা হ্যান্ডেলিং করি। এটিএম সার্ভিসের একটা পার্ট ক্যাশ ম্যানেজম্যান্ট। আমরা এটিএম-এ অলমোস্ট ৩০-৪০ভাগ ক্যাশ ফিডিং করে থাকি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অথবা লিমিটেড ব্যাংকের ব্রাঞ্চ থেকে আমরা ক্যাশ টাকা এনে ক্যাশ সর্টিং করি। সর্ট করে আমরা ক্যাশ এটিএমএ লোড করি। এই রেসপোন্সিবিলিটি টোটালি মানিপ্লান্টের। এই কাজগুলো আসলে আমরা বিভিন্ন জোন আকারে করি। যেমন ঢাকার নর্দার্ন জোন, বগুড়া, ময়মনসিংহ, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম সহ অন্যান্য এলাকায় আমরা এই সার্ভিস দিয়ে থাকি। একই সঙ্গে আমাদের ক্যাশগুলো শতভাগ এনশিওর করি যাতে লাইফটাইম থাকে। এর সার্ভিসমান যদিও আন্তর্জাতিকভাবে উন্নয়শীল দেশগুলোর মতো পর্যায়ে এখনও যাওয়া যায়নি। এটিএমের ফিডিংয়ের ৩০ভাগ মানি রিজেক্টেড হয় এসপার টেন্ডার অব ফিডিং নোট। যা বাংলাদেশ ব্যাংক বা নোমিনেটেড ব্যাংকগুলোতে আবার ফিরত দিই। বাকিগুলো আমরা ক্যাশ লোডিং করি। এছাড়াও অনেক সমস্যা থাকতে পারে, অনেক সময় দেখা যায় টাকা উঠানোর সময় ক্যাশ জ্যাম হয়ে যায়। যাকে আমরা ফাস্ট লেভেল সার্ভিস বলি। মানি প্রভাইড লিঙ্ক সেই সার্ভিস প্রভাইড করে।

এটা রিসাইকেল হয়, প্রতিদিন আমাদের সেই টাকা প্রতিস্থাপন করতে হয় এটিএম বুথগুলোতে। এভাবে সপ্তাহের পাঁচ দিনই ক্যাশ লোড করতে হয়। আবার প্রতি মাসের শেষে যখন বেতনের সময় আসে তখন লোড বেশি পড়ে। সে সময় সপ্তাহে সাত দিনই সার্ভিস দিতে হয়। এটা কিন্ত সার্বিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বেশিরভাগ ব্যাংকই এখন আউট সোর্সিং করে দিচ্ছে। এর পাশাপাশি আরো দুয়েকটি কোম্পানি আছে যারা সারা দেশে এভাবে তাদের সার্ভিস প্রোভাইড করছে।

আমাদের এসব কাজে চ্যালেঞ্জ : কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ পুলিশ বা আর্মির রিটায়ার্ড পার্সন পাওয়া যেত যাদের সিকিউরিটির কাজে নিয়োগ করা যেত। সেভাবে আমরা ১০০ গানম্যান আউট সোর্সিং করেছি। যারা আমাদের প্রতিনিয়ত সেবা দিয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন হলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের থার্ড পার্টি সার্ভিসের জন্য আর পাচ্ছি না। এজন্য প্রতিটি এটিএম ক্যাশ আমাদের ইন্স্যুরেন্স করাতে হচ্ছে। পাঁচ কোটি টাকার বেশি আমরা ক্যারি করতে পারছি না। গানম্যান স্বল্পতা রয়েছে। আমি আপনাদের মাধ্যমে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতি রিকোয়েস্ট করব, যারা ক্যাশ ম্যানেজমেন্ট করছে, তাদের আলাদা করে গান লাইসেন্স দেয়া হোক। এটা সময়ের দাবি আর খুবই প্রয়োজন।

দেখুন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী আমরা এখন রাত ১০ টার পর ক্যাশ লোড দিতে পারছি না। তাছাড়া সপ্তাহে সাতদিন এই সার্ভিস দিতে গেলে, আমাদের এই ব্যাপরগুলো এনশিওর করতে হচ্ছে। অনেকসময় ব্রাঞ্চ থেকে টাকা দেয়া হয় দিনের একেবারে শেষে। আর এই টাকা সর্টিং করে এটিএম-এ লোড করতে অনেকটা সময় লেগে যায়। এজন্য আমাকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। কিন্ত সেটা করতে পারছি না। কারণ আমাদের গানম্যানের স্বল্পতা রয়েছে। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের নিষেধ থাকার কারণে নতুন করে নিয়োগও দিতে পারছি না। একব্রাঞ্চ থেকে অন্য ব্রাঞ্চে বা সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে বিভিন্ন বুথে বেশি পরিমাণ টাকা নিয়ে যাওয়াটাও তো আমাদের জন্য বড় একটা ঝুঁকি। কখন কি হয়ে যায় ? শুধু আমাদের জন্য না, অন্যান্য কোম্পানি ও ব্যাংক নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত গানম্যান পাচ্ছে না।

কিছুদিন আগে একটা ঘটনা ঘটেছে গাজিপুরে। আমাদের একটা বুথে টাকা লোড করার সময়, একদল টেরোরিস্ট এসে এক কোটি আশি লাখ টাকা নিয়ে যায়। যদিও ইন্স্যুরেন্স করা তারপরও আমাদের গানম্যানের মাথা ফাটিয়ে তাকে আহত করে। আশার কথা হলো, সরকারের সদিচ্ছা আর উদ্যোগের কারণে ওই সন্ত্রসীদের আমরা ধরতে পেরেছি। টাকা উদ্ধারে ইন্সুরেন্স কোম্পানি আমাদের সহযোগিতা করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতিক্রমে, অর্থ ও স্বরাস্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের কাছে আমার আবেদন থাকবে; এই যে সিকিউরিটির জন্য গানম্যান দরকার তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে দ্রুত একটা ব্যবস্থা করা হোক। আর যদি তাদের গানের জন্য সরকার লাইসেন্স দেয় তাহলে আরো ভালো হবে। অথবা যারা সামরিক বাহিনীতে আছেন তাদের দেয়া হোক কিংবা প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানির অন্তত ৫০ জনকে গানম্যানের লাইসেন্স দেয়া হয়। এটা ব্যাংকিং ক্যাশ ম্যানেজমেন্টের জন্য খুবই ডিফিকাল্ট পার্ট। সারা বিশে^ কিন্ত ব্যাংকিং ক্যাশ ম্যানেজমেন্ট থার্ড পার্টি দিয়েই করানো হয়। আমাদের দেশেও অনেক ব্যাংক এই প্রক্রিয়ায় সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। ক্যাশ ম্যানেজমেন্ট সিকিউরিটির এই দিকটায় সরকারের কনসার্ন হওয়া একান্ত জরুরি।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুরোধ:অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে আমি আরেকটা ব্যাপার তুলে ধরতে চাই। সারা বিশে^ কিন্ত প্রতি ১০ বছর পর পর কারেন্সির ডিনোমেশন পরিবর্তন করা হয়। আমাদেরও কিন্ত সেটা করা প্রয়োজন। ভারতে সম্প্রতি ৫০০ ও ১০০০ টাকার সব নোট পরিবর্তন করা হয়েছে। আমাদের কারেন্সির কোয়ালিটি উন্নত বিশে^র মানের দিক দিয়ে অনেক কম। এখানে স্ট্যাপল করা হয়, সেলাই করা হয়, এমনটা অন্য কোথাও করা হয় না। ফলে আমাদের মান কমে যায়। এটিএম ফিডিং কারেন্সি করতে হলে, আমাদের কোয়ালিটি কারেন্সি এনশিওর করতে হবে। এতে আমরা আরো সুন্দরভাবে সার্ভিসটা দিতে পারবো। এখনও দেশের ৬০ ভাগ মানুষ ব্যাংকিংয়ের আওতায় নেই। যদি তাদের ব্যাংকিংয়ে সম্পৃক্ত করা যায়, তাহলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিশন ২০-২১ সফলভাবে এগিয়ে যাবে। আমাদের এই সার্ভিসগুলা এনশিওর করা জরুরি। কৃষক, লোকাল পিপল আর আনব্যাংক পিপলদের ব্যাংকিংয়ের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। শুধুমাত্র শহরে মনোযোগ দিলে হবে না। পাশাপাশি সারা দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় এ সেবা ছড়িয়ে দিতে হবে। আমি ধন্যবাদ দিতে চাই, সজিব ওয়াজেদ জয় সাহেবকে, কারণ তার মাধ্যমে সারা দেশে এখন ইন্টারনেট সার্ভিস পৌঁছে গিয়েছে। গ্রামে এটিএম বুথ বসালে, সেখানে ক্যাশ সার্ভিস দিতে হবে। শহর থেকে গ্রামে ক্যাশ লোড করতে গেলে, প্রয়োজনীয় সিকিউরিটি দরকার হবে। ফোর্স না পেলে সেটা সম্ভব হবে না। আমরা সবসময় পুলিশ বাহিনীকে বলতে পারি না যে আমাদের সাথে ফোর্স দিন। তাদের পক্ষে আমাদের প্রতিদিন এভাবে সার্ভিস দেয়া সম্ভবও হবে না। এজন্য আমাদের আলাদা ও নিজস্ব সিকিউরিটি ফোর্স দরকার।
গ্রামের মানুষকে যদি ব্যাংকিংয়ের আওতায় নিয়ে আসতে হয়, তাহলে এসব সুবিধা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। ৪৫০০ ইউনিয়নে এর মধ্যেই কানেক্টিভিটি পৌঁছে গিয়েছে। এখন কেবল অপেক্ষার পালা, সেখানে থ্রি জি সেবা চালুর। বিটিআরসি উন্মুক্ত করে দিলেই, দেশের প্রত্যন্ত এলাকার সাধারণ মানুষ, এই সেবার সুবিধা ভোগ করতে পারবে। শহরে যেমন এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে, সবাই সবধরনের সুবিধা পাচ্ছে, একইভাবে প্রত্যন্ত এলাকার একজন সাধারণ মানুষও একই সেবা পাবে। আর এটিএম বুথের মাধ্যমে, টাকা উত্তোলনের মতো সুবিধা তো থাকবেই। গ্রামের মানুষ ব্যাংকে একাউন্ট করতে পারবে। আপনি কত দ্রুত টাকার আদান প্রদান করতে পারবেন, আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটাই আমরা প্রোভাইড করছি। আজকের দিনে অর্থনীতিকে চাঙা করতে হলে ভার্চুয়াল মানি, ইলেক্ট্রনিক মানি, ইন্টারনেট বা অনলাইন ফ্যাসিলিটির বিকল্প নেই। কিছুদিন আগে ভারতের অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তিনি ক্যাশ মানি মানুষের হাতে দেখতে চান না। ইংল্যান্ডে আপনি সবার কাছে কার্ড দেখবেন। কার্ডের মাধ্যমেই তারা তাদের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ সারেন। তাদের হাতে অনেক লিক্যুইড মানি থাকে কার্ডের মাধ্যমে। এসব দেশ যদি সেবা দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ কেন পারবে না? বাংলাদেশে ওই অবকাঠামো কিন্ত আমরা দেখতে পাচ্ছি।

ক্যাশলেস সোসাইটিতে অনেক সুবিধা রয়েছে। আপনার ইকোনোমিটা সাউন্ড হবে, আপনার ট্র্যানজেকশন স্মুথ হবে। এখন আর মানুষের ক্যাশ নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর প্রয়োজন নেই। আপনি নির্ভেজালভাবে কার্ড দিয়েই সব কিছু সহজেই করতে পারছেন । আমি মনে করি বাংলাদেশ এসব দিক দিয়ে দ্রুতই উন্নতি করছে। এবং এটাই বাংলাদেশর উন্নয়নের সঠিক রাস্তা। এভাবেই ভিশন ২০-২১ এ বাংলাদেশ একটি শক্তিশালি ও মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবে। এর জন্য অর্থনীতি হচ্ছে সঠিক মাধ্যম।

যশোদা জীবন দেবনাথ
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
টেকনো মিডিয়া লিমিটেড