ব্যাংকিং খাতে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে নজর দিতে হবে

মানবসম্পদ উন্নয়নে ব্যাংকগুলোকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। দেশীয় অর্থনীতিতে ব্যাংকিং সেক্টর যেভাবে অবদান রাখছে সেভাবে মানবসম্পদ তৈরি করে কার্যক্রম পরিচালানা করার পরাপর্শ দিয়েছেন মেঘনা ব্যাংক লিমিটেডের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আমিন। আজকের বাজার ও এবি টিভির সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। আলোচনার চুম্বক অংশ তারই ভাষায় প্রকাশ করা হলো।

বাংলাদেশে ব্যাংকিং
ব্যাংকিং সেক্টর বাংলাদেশের অর্থনীতে যে অবদান রাখছে এবং যেভাবে এর ব্যবস্থাপনার কাজ চলছে, সে হিসেবে বাংলাদেশের অন্যান্য সেক্টরের তুলনায় ব্যাংকিং খাত অনেক শৃংখলবদ্ধ। এই খাত নিয়মনীতি মেনে চলে এবং অনেক রেগুলেশনস ও কমপ্লায়েন্স প্রসেসগুলো ভালো ভাবে মানেন। তবে এসবের ব্যত্যয়ও আছে সেটা প্রসঙ্গক্রমে পরে আসবো।  আমার জোর দিয়ে বলার কথাটা হচ্ছে,  ব্যাংকিং সেক্টরে রেগুলেটারের সংখ্যা বেশি, সে কারণে এদেরকে নিজস্ব রেটিং করতে হয়, এক্সটারনাল অডিটর আছে, বাংলাদেশ ব্যাংক আছে আবার সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন আছে। এসব  মানতে গিয়ে ব্যাংকগুলো অন্য সেক্টরগুলোর তুলনায় অনেক সুশৃংখলভাবে চলে। দু‘একটি সংবাদ বিভিন্ন সময়ে বের হয়, আপনারা তা দেখেছেন। ‘ব্যাংকিং এখন দেশের  অনেক বড় সেক্টর’। আমাদের সাড়ে ৮ লাখ কোটি টাকা ডিপোজিট হয়। এর মধ্যে প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকা হচ্ছে লোনস এ্যান্ড  এডভান্স, তাহলে এটা নিশ্চয়ই তো বড় বিষয়। বহু মানুষ কাজ করেন এই সেক্টরে, তো ছোট খাটো নৈতিক স্খলন তো হতেই পারে। তবে আমি মনে করি সেক্টরটি যেমন অবদান রেখে যাচ্ছে তেমনি কমপ্লায়েন্স কাজও করে যাচ্ছে।

কার্ডে ইন্টারেস্ট কতটা?
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে আমার কিছু পার্থক্য হবে, বাংলাদেশ ব্যাংক রেগুলেটর হিসেবে চিন্তা করেছেন, আমরা কিন্তু অপারেটর, আমরা ক্রেডিট কার্ডটাকে ঋণ মনে করি না, এটা লাইফ স্টাইল সাপোর্ট মনে করি, এ সার্ভিসটা আপনি ২৪ ঘন্টাই পাচ্ছন । কার্ডটা একটা প্লাস্টিক কার্ড কিন্তু এটা আপনার হাতে নগদ টাকা তুলে দিচ্ছে, আপনি স্বাচ্ছন্দে টাকা তুলতে পারেন আবার কেনাকাটাও করতে পারেন, দেশে- বিদেশে এর কোনো ব্যাংকিং সময় নেই, এগুলো অনেক সুপার ভিশন করতে হয়। কার্ড ইস্যু করা, মনিটর করা, আইটি খরচ, ২৪ ঘণ্টা কল সেন্টারের খরচ অনেক বেশি। আপনাকে কার্ডটা দেওয়া মানে আপনার হাতে ১ লাখ, ৫ লাখ ১০ লাখ নগদ  টাকা তুলে দেওয়া।  এটার কোনও সিকিউরিটি আমরা নিই না। শুধু একটা ব্যক্তিগত প্রোফাইল এবং ব্যাকগ্রাউন্ডটা দেখি। এখানে যে খেলাপি হচ্ছে না তা না, এ জায়গাটাতে অবশ্যই যেহেতু খরচ বেশি, ইন্টারেস্টটা আরেকটু বেশিই হওয়া উচিত। কার্ডে ইন্টারেস্ট রেট বেঁধে দেওয়াটা আমার মনে হয় ব্যাংকিং সেক্টরে নিরুৎসাহ হিসেবে কাজ করবে। এটা অপারেশনাল একটা দিক।

আরেকটি দিক দেখুন, এই কার্ডটা যে যে ব্যাংগুলো দেশে বিদেশে ইস্যু করছে অনেকে লাউঞ্জ ব্যাবহারের সুযোগ দিচ্ছে দেশে বিদেশে, অনেকে না করলেও সুযোগ তো আছে। বিজ্ঞাপনের খরচ আছে, আমরা ডিসকাউন্ট দিই কেননা স্বাচ্ছন্দে গ্রাহকরা কেনাকাটা করবে, ডিসকাউন্ট পাবে, খাওয়া দাওয়া করবে। এই যে আমরা লাইফস্টাইল সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছি এটার কিন্তু একটি খরচ আছে। মানুষ কিন্তু এতে আপত্তি করে নাই। আমাদের ৫/৬ লক্ষ কার্ড হোল্ডার আছেন। এই দাবি কিন্তু গ্রাহকদের পক্ষ থেকে আসেনি, আমরা বাজারে যাই পকেটে  নগদ টাকা যা আছে তা দিয়েই কেনাকাটা করে চলে আসি। কিন্তু আরেকজন মনে করে, আমি আরেকটু ভালো কেনাকাটা করব এখন পকেটে না থাকলে পরবর্তি সময়ে দিব, এটা হলো একটা কমফোর্ট।

আরেকটা উদারহণ দিই, আপনি যখন ট্র্যাভেল করেন ফার্স্ট কাস, সেকেন্ড কাস, থার্ড কাসের টিকেট নেন কেন? গন্তব্য তো একই জায়গা। সবারই উদ্যেশ্য জীবনটাকে চালানো, আরেকটু অবস্থান অনুযায়ী ব্যাটার করে চালানো।  আমরা লাইফ স্টাইল বলি সেজন্যই। এ জন্য এটাকে নির্দিষ্টভাবে বেঁধে দেওয়া উচিত নয়। আমার মনে হয় সুপারভিশন এবং রিস্ক ম্যানেজমেন্টের বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার।  যত বেশি রিস্ক তত বেশি কস্ট থাকা উচিত। আলোচনা চলছে। আমাদের একটি ছোট কমিটি আছে তারা এগুলো ঠিকঠাক করে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিবে। আমরা মনে করি এটা কোনভাবেই ২০ এর নিচে হওয়া উচিত নয় ।

ব্যাংকিং খাত ও সাইবার ঝুঁকি
প্রথমত, ঝুঁকি সব জায়গাই আছে, আপনি হেঁটে গেলে ঝুঁকি আছে, বাসে গেলে ঝুঁকি আছে, সিএনজিতে গেলেও ঝুঁকি আছে সব জায়গাতেই ঝুঁকি আছে। দ্বিতীয়ত, কিছু কর্মকাণ্ডের সিস্টেম লস আছে কিছু ঝুঁকি আছে।  ব্যাংকিং যখন ম্যানুয়েল ছিল, তখন কি ঝুঁকি ছিল না ? ভুলত্রুটি হয়নি ? এখন আমরা ডিজিটালে যাচ্ছি, এ জন্য যে, মানুষের এখন সার্ভিস দরকার দ্রুত, সার্ভিস দরকার সঠিক ও নিরাপদ। ব্যাংকগুলো আইটিতে গত ১০ বছরে যত টাকা খরচ করেছে ম্যানুয়েল যুগের রক্ষণাবেক্ষণে এত টাকা কখনো খরচ হয়নি। তাহলে আমরা কী চাচ্ছি ? ভোক্তার সন্তুষ্টি, সময় সংক্ষেপ করা, তার পর তো ব্যাংককে কস্ট অব ফান্ড কভার করে প্রফিট করতে হয়। আমাদের সেদিকটাও চিন্তা করতে হয়। তো এত কিছু খরচ করার পরে আমরা সিকিউরিটির দিকে নজর রাখতে যথেষ্ট চেষ্টা করি। কিন্তু যারা এসব কাজ মনিটর করে তারা কিন্তু এর ত্রুটি খুঁজে বেড়ায়, ফাঁক খুঁজে বেড়ায়। কোন্ জায়গা দুর্বল; ওই জায়গাটিতেই আমাদের বেশি সচেতনতা দরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভ চুরি নিয়ে যেটা হয়েছে, হ্যাকাররা সূক্ষ্মভাবে সময়টা নির্ধারণ করেছে।  তারা একদিনের চিন্তা করেনি। তারা বৃহস্পতিবার রাত ১২টার সময়কে বেছে নিয়েছে, যেন ৪৮ঘন্টার পূর্ণাঙ্গ একটি সময় পায়। শুক্রবার, শনিবার আমাদের বন্ধ থাকে। আর রোববার বিদেশে বন্ধ। এই মোট ৭২ ঘন্টার সুযোগ তারা নিয়েছে। এ জায়গাটাতে আমাদের একটা সতর্কতার সমস্যা হয়তো বা ছিল ।
ব্যাংকের এটিএম কার্ডগুলো সম্পর্কে আপনি জানেন, এখানে সুয়াইব করা কার্ড,ম্যাগনিটিক স্ট্রিপ কার্ডগুলো একটি ডিভাইস বসিয়ে ফটো নেয়া সম্ভব বলে নম্বরটা নকল করা গেছে। ঐ নাম্বার দিয়ে নকল একটি কার্ড করে একাউন্ট হ্যাক করার চেষ্টা করা হয়েছে । সেটাও আমরা অতিক্রম করেছি একটা চীফগেস্ট কার্ড নিয়ে এখন আর ওই সুযোগটা নেই। সর্বোপরি সমস্ত কিছুরই নিরাপত্তা রাখতে হয়। হাঁটার সময় নিরাপদ স্থান দিয়ে হাঁটতে হয়, ঘুমানোর সময় নিরাপদ স্থানে ঘুমোতে হয়।  দেখার বিষয় আপনি আপনার নিরাপত্তাটা সঠিক রাখছেন কি না ? এটার জন্য আরও যতœবান হওয়া দরকার। ব্যাংগুলো পুরোপুরি চেক অপা করছি আমরা নিজেরা। তুলনামূলকভাবে আমরা অনেক উন্নতির দিকে যাচ্ছি, কিন্তু আরও সর্তক থাকতে হবে ।

আমাদের কনফিডেন্স লেভেলটা এরকম যে, বংলাদেশ ব্যাংক  দুই দিন আগে বলেছে, এ বছরের মধ্যে সব ব্যাংককে অনলাইনের আওতায় আসতে হবে। অনেক কঠিন সময় পার করছে আমাদের ব্যাংকিং সেক্টর। আমরা প্রথম শুরুই করেছি অনলাইন ব্যাংকিং দিয়ে।

সম্প্রতি ক্রেডিট কার্ডে সুদের হার বিষয়ক বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা কে আপনি কিভাবে দেখছেন?
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে আমাদের ব্যাংকিং এর ধারাটা একটু আলাদা আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক হচ্ছে রেগুলেটর এবং আমরা হলাম অপারেটর । আমরা এটাকে ঋণ মনে করছি না আমরা মনে করি এটা একটা লাইফষ্টাইল সাপোর্ট। কার্ডটা একটা প্লাষ্টিক কার্ড কিন্তু আপনার হাতে নগত টাকা তুলে দেওয়া হচ্ছে। ২৪ ঘন্টা সার্ভিসের আওতায় আপনি দেশে বিদেশে কেনাকাটা করতে পারেন চাইলে নগদ টাকাও তুলতে পারেন। আপনি আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করে দেখবেন বিভিন্ন ডিসকাউন্ট সহ লাইফষ্টাইল সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছি তা একটা খরচ আছে। এব্যাপারে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে আলোচনা করবো।

ডিজিটাল ব্যাবস্থায় সাইবার ঝুকি এই বিষয়কে আপনি কিভাবে দেখছেন?
দেখুন ঝুকি সব কিছুতেই আছে। আপনি বাসে যান সিএনজিতে যান কিংবা গাড়ীতে যান ঝুকি সব যায়গায় আছে। আগে যখন ডিজিটাল ব্যাবস্থা ছিলো না তখন কী ঝুকি ছিলো না??আমাদের ব্যাংকিং ব্যাবস্থা ডিজিটালের আওতায় নেয়ার কারণ হচ্ছে গ্রাহকের কাছে দ্রুত সেবা পৌছে দেয়া। সাইবার ঝুকির বিষয়ে আমাদের সচেতনতা জরুরী তাহলেই কেবল এই সমস্যার সম্ভাবনা মোকাবেলা করা সম্ভব।

অনলাইনে ব্যাংকিং কার্যক্রম
ডিজিটাল ব্যাবস্থার ফলে অনলাইনে লেনদেন করা যাচ্ছে। এক ব্রাঞ্চের টাকা অন্য ব্রাঞ্চ থেকে তোলা যাচ্ছে।  এখন চেক ট্রানজাকনে ইমেজ কিয়ারিং ব্যবস্থা হয়েছে।  আমরা অনলাইনে বিএফটিএন এর মাধ্যমে ইলেক্ট্রনিক্স ফান্ড ট্রান্সফার  ব্যবস্থা চালু করেছি। এভাবেই বিভিন্ন ধাপে ডিজিটাল পদ্ধতিতে এগিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকিং সেবা।

দক্ষ জনশক্তির অভাব
দেখুন দক্ষ জনশক্তি একটি ব্যাংকের চালিকা শক্তি। আমাদের দেশে দিন দিন ব্যাংক বাড়ছে তার মানে বাজার বাড়ছে। পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তির চাহিদাও বাড়ছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। তারা মাঝে মাঝে আমাদের ডাকে আমরাও যাই। তবে দেশে এখন দুটি খাতে প্রচুর জনশক্তি নিয়োগ চলছে।  এর মধ্যে একটি বিসিএস আরেকটি ব্যাংকিং খাত।

দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে  পরামর্শ
মেধার ভিত্তিতে বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে জনবল নিয়োগ করা উচিৎ। একটি ব্যাংক ক্যাডার টিম সৃষ্টি করা উচিৎ।  পর্যাপ্ত ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে তাদের ব্যাংকিং খাতের মেরুদণ্ড হিসেবে তৈরি করা যায়। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ব্যাংক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকসহ কর্মরত প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা ভালো ভূমিকা রাখতে পারে।

খোলাপি ঋণ থেকে পরিত্রাণ
অনেকে একটি খাতের জন্য ঋণ নিয়ে অন্য খাতে বিনিয়োগ করেন বলেই ঋণ খেলাপির ঝুঁকি থেকে যায়। খোলাপি ঋণ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে, বুঝে শুনে ঋণ দিয়ে তা শক্ত মনিটরিং ব্যবস্থার মধ্যে আনতে হবে।

মেঘনা ব্যাংকের বিশেষত্ব
সব ব্যাংকেরই কাজ হচ্ছে গ্রাহককে আর্থিক সেবা  দেওয়া । তবে, সেই সেবা কতটুকু ভালো, দ্রুত এবং কম সময়ে পাওয়া যায় এটাই প্রধান বৈশিষ্টের একটি অংশ। মেঘনা ব্যাংক গ্রাহক সেবা খুব দ্রুত নিশ্চিত করে। এখানেই  মেঘনা ব্যাংকের বিশেষত্ব।
   
মোহাম্মদ নুরুল আমিন
ব্যবস্থাপনা পরিচালক
মেঘনা ব্যাংক লিমিটেড

আজকরে বাজার: ডিএইচ/ আরআর/ ২৯ মে ২০১৭