বৈশ্বিক মহামারি করোনায় সারা বিশ্বের মানুষের জীবনধারাতেই এসেছে নানা পরিবর্তন। পরিবর্তন এসেছে বাঙালি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সম্পর্কিত ধ্যান ধারনারও। সেসময় অনেকেই চাকুরি হারিয়ে উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন। কেউ স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছেন স্বাধীন ব্যবসা।
কিন্তু নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের বারদী এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ নাহিদ (৩১)-এর গল্পটা ব্যতিক্রম। বাবা-মা-আত্মীয়-পরিজনসহ একে একে পরিবারের সবাই যখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে খাঁটি মধুর খোঁজ করছিলেন তখন খাঁটি মধু না পেয়ে নিজেই উদ্যোগী হন মধু চাষে।
নাহিদ বাসসকে জানান, করোনার সময়ে আপনজনের মৃত্যু দেখে নিজের পরিবারের চাহিদা মেটাতে খোঁজ শুরু করেন ভেজালবিহীন খাদ্যদ্রব্যের। সব জায়গাতেই ভেজাল আর ধোঁকা খেয়ে নিজেই ভেজালবিহীন খাদ্যের যোগান দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। সেই চেষ্টা থেকেই ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে হয়ে ওঠেন একজন সফল মৌ চাষি।
বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ থেকে এমএ পাশ করে সাউথ ইস্ট ব্যাংকে যোগ দেন। সেখানে তিনি টেলিক্যাশ বিভাগের মার্কেটিং এ্যান্ড অ্যাকুইজিশন অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। করোনার সময় চাকরির পাশাপাশি মৌ চাষের প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন তিনি। চাকরির পাশাপাশি মৌ চাষ নিয়ে পড়াশোনা করার কারণে অফিসে প্রায়ই কটাক্ষের শিকার হতেন। এমনকি তাকে বদলি করার হুমকিও দেয়া হয়।
এরপরই আত্মপ্রত্যয়ী নাহিদ চাকরি ছেড়ে মৌ চাষেই আত্মনিয়োগ করেন। মধু বিক্রি করে এখন তিনি স্বাবলম্বী। এখন নেই কটাক্ষ বা বদলির ভয়। বরং আরো অনেকের কর্মসংস্থান করেছেন তিনি। আর ভেজাল মধুর বদলে খাঁটি মধু সরবরাহ করছেন নিজের পরিবার ও এলাকার মানুষকে। অনলাইন পেজের কল্যাণে তার মধু পৌঁছে যাচ্ছে সারাদেশে।
মধু আর মৌমাছির সাথে এখন দারুণ মিতালি নাহিদের। দেশের বিভিন্ন জেলায় মৌয়ালদের সাথে হাতেকলমে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজ উদ্যোগে শুরু করেন ভ্রাম্যমাণ মধু আহরণ। মানিকগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ থেকে সরিষা মধু , নাটোর ও পাবনা থেকে লিচু মধু, এছাড়াও শরিয়তপুর, ফরিদপুর ও সাতক্ষীরা জেলা থেকে কালোজিরা সহ মিশ্র মধু সংগ্রহ করেন। এসব অঞ্চলে মৌসুম অনুযায়ী তিনি মৌ বক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করেন। সুন্দরবনের নিয়ম মেনে সেখান থেকেও মধু সংগ্রহ করে থাকেন। মধু ও অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী খাঁটি পণ্য বিক্রি করে এখন স্বচ্ছন্দেই চলছে তার জীবন ও জীবিকা।
নাহিদ জানান, দেশের বিভিন্ন জেলায় তার ১৫০ টি মৌ বক্স রয়েছে। প্রতি মৌসুমে ৩০ থেকে ৪০ মন মধু সংগ্রহ করা যায়। যা থেকে বছরে আয় করেন দশ লাখেরও বেশি। সব খরচ বাদ দিয়ে বছরে তার আয় থাকে প্রায় সাত লাখ টাকা। মধুর ভিন্নতা অনুযায়ী প্রতি কেজি মধু ছয়’শ থেকে দুই হাজার পাঁচশ টাকায় বিক্রি হয়।
একজন সফল মধু ব্যবসায়ী হতে তিনি নিয়েছেন নানা প্রশিক্ষণ। নারায়ণগঞ্জ জেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) থেকে মৌ চাষের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
এছাড়াও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প এর আওতায় এক মাসের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন নাহিদ। তিনি ২০২৩ সালে নারায়ণগঞ্জ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে জাতীয় যুব দিবসে সফল আত্মকর্মী হিসেবে পুরষ্কার লাভ করেন।
নতুন কোনো কিছু শুরু করার পথেও থাকে নানা বেদনা ও হতাশার গল্প। নাহিদের গল্পও তার ব্যতিক্রম নয়। ব্যাংকের কটাক্ষ থেকে রক্ষা পেতে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিলেও পরিবার এবং সমাজ তাকে রেহাই দেয়নি।
নাহিদ বলেন, আমার বাবা একজন শিক্ষক, মা একজন ডাক্তার। তাদের ছেলে একজন মৌয়াল হবে শুনে অনেকেই কটু মন্তব্য করেছেন। অনেকেই ঈর্ষান্বিত হয়েছেন। কিন্তু আমি মনে করি, কোন কাজই ছোট নয়, বরং চাকরির চেয়ে মৌ চাষ করে সফলভাবে ব্যবসায়ী হওয়া কঠিন। আমার ফুপা করোনায় মারা যাওয়ার পর আমাদের পরিবারের অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হই। তখন ভেজালবিহীন মধুর খোঁজ করি যেটা সহজে পাচ্ছিলাম না। মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে হই প্রতারিত। এরপর মৌ চাষ করার সিদ্ধান্ত নেই। তখনো চাকরি করতাম, কিন্তু চাকরির পাশাপাশি এই কাজ করা সম্ভব না। অফিসের লোকেরাও কটাক্ষ করত। তাই চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি এই পেশা বেছে নিয়েছি। ১০-১২ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে মৌ চাষ শুরু করেছিলাম। এখন খরচ শেষে বাৎসরিক ৭-৮ লক্ষ টাকা আয় করতে পারি।
তিনি আরো বলেন, সময়ের সাথে সাথে প্রশিক্ষণ নিয়ে, বিভিন্ন জায়গায় মৌ খামারীদের সাথে থেকে আমি মৌচাষ করা শুরু করি। এপিস মেলিফেরা প্রজাতির মৌমাছি চাষ করে মধু সংগ্রহ করি। মৌ চাষের প্রধান শক্র পিঁপড়া। পিঁপড়া বাক্সে গিয়ে মধু এবং পোকাগুলো নষ্ট করে ফেলে। এ ছাড়া কিছু পাখিও মৌমাছি খেয়ে ফেলে। এজন্য আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হয়।
নায়ায়নগঞ্জ সিটি করপোরেশনের আমলাপাড়া ও কলেজ রোড এলাকায় ‘নাহিদ হানী’ নামের দুটি দোকান দিয়েছেন নাহিদ। যেখানে তিনি তার মধুসহ ভেজাল মুক্ত বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করেন। দুটি দোকান থেকে মাসে প্রায় ৮০ হাজার টাকা আয় করেন। যেখানে আরো ৬ জন কর্মচারীর কর্মসংস্থান করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নাহিদ-হানী পেজের মাধ্যমেও মধু বিক্রি করেন।
(https://www.facebook.com/groups/2869065540007334/?ref=share&mibextid=lOuIew)
নাহিদ হানীর নিয়মিত ক্রেতা আমলাপাড়া এলাকার বাসিন্দা সোবর। তিনি বলেন, নাহিদ ভাই খাঁটি মধু বিক্রি করেন। এজন্য নিজেও খাই, আবার আমার পরিচিতদের গিফটও দেই। ভালো মধু দেয় বলেই দিনে দিনে তার ক্রেতা বাড়ছে। তার কথা শুনে দোকানে থাকা অন্য একজন ক্রেতা নাজনীন আক্তার বলেন, নাহিদ হানীর মধুর মতো অন্যান্য খাবারগুলোও বেশ ভালো। বিভিন্ন জেলার ভালো ভালো খাবার ওনার দোকানে পাওয়া যায়। নারায়ণগঞ্জ শহরে এরকম দোকান কমই আছে।
চাকরি ছেড়ে মধু চাষ করার বিষয়টি প্রথমে নেতিবাচক চোখে দেখলেও ছেলেকে নিয়ে এখন বেশ গর্ববোধ করেন নাহিদের বাবা-মা। নাহিদের বাবা অবসরপ্রাপ্ত প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ছেলে এমবিএ করে মধু বেঁচে, তেল বেঁচে, এই বিষয়টা প্রথমে ভালো ভাবে নিতে পারিনি। কিন্তু এখন ছেলে যেভাবে জীবনে এগিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য খুব গর্ব হয়। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর ওর দোকানেই দিনের অনেকটা সময় কাটে। বাসায় বসে থাকার চেয়ে এখানেই ভালো লাগে। দোকানের মায়ায় পড়ে গেছি।
নাহিদের মা লাইলি আক্তার সোনারগাঁ উপজেলা কমপ্লেক্সে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত। তিনি বলেন, আমি চেয়েছিলাম নাহিদ সরকারি চাকরি করবে। কিন্তু ও সেটা করেনি। এখন কেউ নাহিদের কাজের প্রশংসা করছে শুনলে অনেক ভালো লাগে। বর্তমান সময়ে মৌ চাষ করেও বেশ সফলতা অর্জন করা যায় সেটা দেখিয়ে দিয়েছে নাহিদ।
বাবা-মা’র কাছ থেকে মৌ চাষে সহয়তা না পেলেও উৎসাহ পেয়েছেন নাহিদের নিকটবর্তী চাচা মোহাম্মদ মিলনের কাছ থেকে। মোহাম্মদ মিলন বলেন, নাহিদের পরিবারের কাছাকাছি থাকায় দেখতাম নাহিদ ছোটবেলা থেকেই যেকোন কাজে বেশ উদ্যমী আর আত্মবিশ্বাসী। যে কাজ করে, সেটা অনেক ভালোভাবে করে। শুরুর দিকে অনেকেই ওকে নিয়ে কটাক্ষ করেছে, কিন্তু ও সেসব কথায় থেমে যায়নি।
আরো ভালোভাবে কাজ করেছে। ওর সফলতা দেখে এখন সবাই বাহবা দেয়।
নাহিদ আরো বলেন, আমার প্রচুর ভ্রমণ করার শখ, সেই শখ থেকে যখন কোন জেলায় ঘুরতে যেতাম, সেখানের ঐতিহ্যবাহী খাবারের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করলে সবাই নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করত। সেই থেকে চিন্তা আসল, দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার নিজের দোকানে বিক্রি করবো। এখন আমার দোকানে মধু প্রধান পণ্য হলেও বিভিন্ন জেলার ভেজাল বিহীন খাদ্যদ্রব্য আমার দোকানে বিক্রি করি। চাকরির পিছু ছুটে বেকার না বসে থেকে দেশের তরুনদের আমি আত্মকর্মী হওয়ার পরামর্শ দেই। দেশের যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, বিসিকসহ একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের এবং অন্যদের কর্মসংস্থান করা সম্ভব। আমার সাথে এখন নয়জন কর্মী কাজ করেন।
নারায়ণগঞ্জ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপপরিচালক হাসিনা মমতাজ মৌয়াল নাহিদকে তরুণ প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের প্রেরণার উৎস মনে করেন। তিনি বলেন, যুবক-যুবনারীদের বেকারত্ব দূর করে তাদের আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। নাহিদ এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আজ সফল আত্মকর্মী। তাকে এখান থেকে পুরস্কৃত করা হয়েছে সফল আত্মকর্মী হিসেবে। তার সফলতা দেখে অন্যরাও উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত হবে। (বাসস)