ভোলার চরাঞ্চলগুলোতে হাঁস পালনে আগ্রহ বাড়ছে

জেলার উপজেলা সদরের মেঘনা ও তেতুলিয়া নদীর বিভিন্ন চরাঞ্চলে হাঁস পালনের আগ্রহ বাড়ছে। বিচ্ছিন্ন এসব চরগুলোতে সম্পুর্ণ নিজ উদ্যেগে গড়ে উঠেছে একাধিক হাঁসের খামার। চরাঞ্চলগুলোতে বেকারত্ব দূর করে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গূরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে হাঁস পালন। শুধু হাঁস প্রতিপালনে আর্থিক সংকট দূর করেছেন এখানকার বহু পরিবার। এসব খামারে উৎপাদিত ডিম গ্রামের হাট-বাজার হয়ে চলে যায় শহুরে দোকানগুলোতে। দৈনিক এসব চরে লাখ লাখ টাকার ডিম বিক্রি হয়। তাই বাণিজ্যিকভাবে খামার পদ্ধতিতে হাঁস পালন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে চরগুলোতে।

বিচ্ছিন্ন এসব দ্বীপগুলোতে প্রচুর বিলাঞ্চল ও সমতল জমি থাকায় এখানে হাঁস পালন অনেকটাই সহজ। চারদিকে নদী-খাল থাকায় প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর শামুক, ঝিনুক, কচুরিপানা, ছোট মাছসহ হাঁসের বিভিন্ন খাদ্য পাওয়া যায়। ফলে বাড়তি খাবার খরচ বেঁচে লাভ হয় ভালো। গত কয়েক বছরে হাঁস পালনে এখানে বেকারত্ব দূর করে আত্বকর্মসংস্থানের পথ সৃষ্টি হয়েছে অনেকের। পরিবারের পূরুষদের পাশাপাশি নারী সদস্যরাও হাঁস পালনে সহযোগিতা করছে।

ভেদুরিয়া ইউনিয়নের চর চটকিমারা, ভেলুমিয়া ইউনিয়নের চর গাজী, চর মোহাম্মদ, ভেদুরিয়া চর, চর রমেশ, চর চন্দ্রপ্রসাদ, ইলিশা ইউনিয়নের মাঝের চর, রাজাপুর ইউনিয়নের চর রামদাসপুর, চর শ্যামপুর, দক্ষিদিঘলদী ইউনিয়নের ট্যাগরার চরসহ বিভিন্ন চরে খবর নিয়ে জানা যায় সাম্প্রতিক সময়ে হাঁস পালন বাড়ছে।

সদরের ভেদুরিয়া ইউনিয়নের বিচ্ছিন্ন চর চটকিমারা গ্রাম। খেয়া নৌকার মাধ্যমে প্রায় ১০ মিনিটের তেতুলীয় নদী পাড়ি দিয়ে যেতে হয় এই চরে। প্রায় দেড় হাজার মানুষের বসবাস এই গ্রামে। এখানে হাঁস পালন করে অনেকেই বেকারত্ব দূর করেছেন। ভাগ্য বদলেছে এখানকার বহু পরিবারের। বসত ঘরের পাশে নেট দিয়ে গড়ে তুলেছেন হাঁসের খামার। প্রতিটি খামারে ৪’শ থেকে ১ হাজার হাঁস রয়েছে।

কথা হয় হাঁস খামারী মো: আলাউদ্দিন মিয়া (৪৩) এর সাথে। তিনি গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে হাঁস পালন করে আসছেন। বসত ঘরের পাশের জমিতে গড়ে তুলেছেন হাঁসের খামার। প্রথমে ২’শ হাঁস দিয়ে শুরু করলেও বর্তমানে তার প্রায় ৯’শ হাঁস রয়েছে। দৈনিক প্রায় ৭’শ ডিম হয় তার খামারে। ১’শ ডিম ৯’শ টাকা মূল্য হারে বিক্রি করেন।

তিনি বলেন, প্রতিদিন সকালে হাঁসগুলোকে ধান খাওয়ানোর পর নদী, খাল অথবা বিলের ধারে চড়ানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেলে খামারে নিয়ে এসে আবার খাবার দিতে হয়। মো: মোসলেউদ্দিন (২৮) বলেন, গত ৪ বছর যাবত তিনি হাঁস পালন করছেন। আগে কৃষি কাজ করলেও অধিক লাভের আশায় হাঁস পালন শুরু করেছেন। বর্তমানে তার ৫’শ হাঁস রয়েছে। দৈনিক প্রায় সাড়ে ৩’শ ডিম হয় তার খামারে। ডিম বিক্রি করে তিনি স্বচ্ছলতা ফিরে পেয়েছেন বলে জানান।

শুধু মোসলেউদ্দিন ও আলাউদ্দিন নয়, হাঁস পালন করে ভাগ্য বদল করেছেন অনেক খামারী। এর মধ্যে আবুল কালাম (৩২) ৫’শ হাঁস রয়েছে। রুবেল (৩০) ৪’শ হাঁস, ইউসুব জমাদ্দার (৩৩) সাড়ে ৩’শ হাঁস, জসিমউদ্দিন (৩০) ৫’শ হাস, আব্দুল হাই (৩৫) ৬’শ হাঁসসহ প্রায় অর্ধশত খামারে হাজার হাজার হাঁস রয়েছে। শুধু হাঁস প্রতিপালন করে জীবিকা নির্বাহ করছে এসব পরিবার। ডিমের পাশাপাশি এই শীতে হাঁস বিক্রি করেও লাভবান হয়েছেন অনেকে।

ইলিশা ইউনিয়নের মাঝের চরের খামারী জোছনা বেগম জানান, তার স্বামী কৃষি কাজ করেন। তার খামারে ৫’শ হাঁস রয়েছে। তিনি ছেলেকে নিয়ে খামার পরিচালনা করেন। হাঁস পালনে তেমন পরিশ্রম হয় না জানিয়ে বলেন, সকালে এসব হাঁস তার ছেলে বিল ও নদীর পাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে দলবদ্ধ ভাবে শামুকসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক খামার খায় তারা। সন্ধ্যের আগে আবার খামারে নিয়ে আসা হয়। তারপরেও দিনে ২বার করে তাদের খাবার হিসেবে ধান দিতে হয়। দৈনিক প্রায় ১ হাজার টাকা খরচ হয় ৫’শ হাঁসের জন্য। আর লাভ হয় প্রায় ২ হাজার টাকা।

দক্ষিণ দিঘলদী ইইনয়নের বাসিন্দা শফি কানাই। তিনি ১ হাজার হাঁস পালন করেন। তার বাড়ির পাশের তেতুলিয় নদীর ঐ পাড় বিচ্ছিন্ন চর ট্যাগরা। প্রতিদিন তিনিসহ প্রায় ২০ জন এই চরে হাঁস চরান। এসব চরে প্রাকৃতিকভাবে অনেক খাবার পাওয়া যায়। তাই বিশেষ করে শীতের সময়টাতে তাদের খাবার খরচ কম হয় ও লাভ বেশি হয়।

রাজাপুরের চর রামদাসপুরের বাসিন্দা লোকমান হোসেন (৩৮)। তিনি বলেন, চরগুলোতে অনেক দিন থেকেই হাঁস পালন হয়ে আসছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বানিজ্যিকভাবে হাঁস পালনের প্রবনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি ৮ বছর যাবত হাঁস পালছেন। এতে করে অনেক পরিবার অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত হচ্ছে। হাঁস পালনে স্বল্প খরচ হওয়ায় অনেকেই এর সাথে যুক্ত হচ্ছে।

চরাঞ্চলের বাসিন্দারা জানায়, বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপের বাসিন্দারা কৃষি কাজ ও মাছ ধরার পেশায় নিয়োজিত। আবার কেউ কেউ গবাদী প্রাণী পালন করেন। বহু পরিবার হাঁস পালনের সাথে সম্পৃক্ত। প্রতিটি পরিবারই এখন অভাবকে জয় করেছে। তাদের ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যায় নিয়মিত। আর এতে করে বদলে যাচ্ছে অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠির জীবনমানসহ সার্বিক চিত্র। সদর উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা: দীনেশ চন্দ্র মজুমদার বাসস’কে জানান, তার এখানে বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় শতাধিক হাঁসের খামার গড়ে উঠেছে।

এসব খামারে লক্ষাধিক হাঁস রয়েছে। চরাঞ্চলে সাধারণত ঝিনঝিং ও ক্যম্বেল জাতের হাঁস বেশি পালন করা হয়। এসব হাস ১৯ সপ্তাহ বয়স থেকে ডিম পাড়া শুরু করে। ৯০ সপ্তাহ পর্যন্ত ডিম দিয়ে থাকে। একটি উন্নত জাতের হাঁস বছরে ২৮০ থেকে ৩’শ ডিম দেয়। খামারীদের সাথে উঠোন বৈঠক, সেমিনার, প্রশিক্ষণ ও প্রচার পত্র বিলি ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের দক্ষ করে তোলা হচ্ছে। তথ্য-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান