মসজিদের ইমামের মাইকিং ঠেকিয়ে দিল আরেকটি দাঙ্গা

ভারতের আসাম রাজ্যে আরও একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু সেটি ঠেকিয়ে দিয়েছেন আসানসোলের নূরানী মসজিদের ইমাম হাম্মদ ইমদাদুল্লাহ। যদিও গত মঙ্গলবারের ভয়াবহ দাঙ্গায় তিনি হারিয়েছেন নিজের আত্মজাকে। তার ছেলেকে ঠাণ্ডা মাথায় নির্মমভাবে খুন করেছিল দাঙ্গাকারীরা। কিন্তু পিতৃশোক বুকে চেপে তিনি দাঙ্গা ঠেকানোর চেষ্টায় নেমেছিলেন। চলুন তাহলে শোনা যাক সেই পুত্রহারা ইমামের বদান্যতা আর মানবতার কাহিনী।

আসামের আসানসোলের যে অঞ্চলে মঙ্গলবার সন্ধ্যে থেকে দাঙ্গা শুরু হয়েছিল সেই চাঁদমারি আর কুরেশী মহল্লা পেরিয়ে অনেকটা ভেতরে নূরানী মসজিদ। বৃহস্পতিবার খবর এলো, মসজিদের ইমাম মুহাম্মদ ইমদাদুল্লাহর নিখোঁজ ছেলের লাশ পড়ে আছে স্থানীয় হাসপাতালে। তাকে বলা হলো হাসপাতালে গিয়ে লাশ সনাক্ত করতে।

দুদিনের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার জের ধরে আসানসোলের পরিস্থিতি তখনো থমথমে। সবকিছু বন্ধ। চারিদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে নানা গুজব। ইমাম মুহাম্মদ ইমদাদুল্লাহ হাসপাতালে গেলেন। সনাক্ত করলেন নিজের ছেলের ক্ষত-বিক্ষত লাশ। নখ উপড়ে নেয়া হয়েছে। ঘাড়ে ধারালো অস্ত্রের কোপ। লাশটি আধপোড়া, মনে হচ্ছে কেউ পুড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। এর আগে দুদিন ধরে নিখোঁজ ছেলেকে খুঁজেছেন ইমদাদুল্লাহ আর তার মহল্লার সব মানুষ। কোথাও পাওয়া যায়নি তাকে।

ক্ষত-বিক্ষত লাশটি যখন মহল্লায় আনা হলো, পরিস্থিতি হয়ে উঠলো আরও অস্থির আরও অগ্নিগর্ভ। ইমাম সাহেবের ছেলের মৃত্যুর ঘটনাটা শুনে প্রথমে সবারই মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল মহল্লার বাসিন্দা মুহম্মদ ফারহাদ মালিকের। ‘এটা তো রক্ত গরম করে দেওয়ার মতোই ঘটনা।’

বিচক্ষণ ইমাম মুহাম্মদ ইমদাদুল্লাহ বুঝতে পারলেন, এই প্রতিহিংসার রাশ টানতে হবে এখনই। নইলে আরও রক্ত ঝরবে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চলে যাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। প্রাণ যাবে আরও মানুষের। একটা মাইক হাতে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে সবার প্রতি শান্ত থাকার আবেদন জানাতে লাগলেন।

পুত্র হারানোর কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে আসছিল ইমামের। তবে তার মধ্যেও তিনি বলছিলেন, এই অবস্থাতেও আমি সবার কাছে আবেদন করতে রাস্তায় বেরিয়েছিলাম – সবাইকে বুঝিয়েছি যে আমার যে ক্ষতি হয়েছে, সেটা যেন আর কোনও বাপ-মায়ের না হয় – কেউ যেন দাঙ্গা না বাধায় তার ছেলের হত্যাকে কেন্দ্র করে।

পুত্রশোকের মধ্যেও এলাকায় ঘুরে ছেলের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অশান্তি না ছড়ানোর জন্য তার এই আবেদনে কাজ হলো। লোকজন ঘরে ফিরে গেল।

আসানসোলের চাঁদমারি আর কুরেশী মহল্লা মূলত মুসলমান প্রধান এলাকা। শুক্রবার জুম্মার নামাজ শেষে এলাকার মানুষ ইতিউতি জটলা করেছিলেন, ভীড় ছিল মসজিদের সামনেও। ইমামের ১৬ বছরের ছেলে মোহাম্মদ শীবগাতউল্লাহ দাঙ্গা শুরুর পর দুদিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। বৃহস্পতিবার প্রথম তার লাশের সন্ধান পান তারা।

ইমদাদুল্লাহ বলছিলেন, ছেলেটা মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল, একই সঙ্গে নানা জায়গায় কোরান পড়তেও যেত। বুধবার যখন দাঙ্গা শুরু হয়, তখন নেহাতই কৌতূহলবশে দেখতে গিয়েছিল। তখন রাস্তা থেকে একদল লোক ওকে টেনে নিয়ে যায়। পরের দিন জানলাম একটা মৃতদেহ পাওয়া গেছে – ওটাই আমার ছেলের লাশ।

বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে ইমাম বলেন, খুব যন্ত্রণা দিয়ে মেরে তো ফেলেইছে ছেলেটাকে, তারপরে লাশটাও জ্বালিয়েও দিয়েছিল। এটা কেন করল ওরা! এই নিদারুণ পুত্রশোক ভুলে ইমদাদুল্লাহ যে বলিষ্ঠ অবস্থান নেন, সেটি আসানসোলকে আরও বড় বিপর্যয় থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এই ভয়ংকর ঘটনার পরও তার এলাকায় আরও দাঙ্গা অথবা কোনওরকম সাম্প্রদায়িক অশান্তি রোধ করা গেছে।

ওই পাড়ায় হিন্দু আর মুসলমান পরিবারগুলো বহু বছর ধরেই যেমন একসঙ্গেই বাস করছেন, তেমনই সেখানকার মন্দির বা মসজিদ – সবই অক্ষত রয়েছে।

ওই মহুয়াডাঙ্গাল এলাকারই বাসিন্দা প্রমোদ বিশ্বকর্মা বলছিলেন, ইমাম সাহেবকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব! ছেলে হারানোর পরেও রাস্তায় মাইক নিয়ে বলে বেরিয়েছেন যে সবাই যেন শান্তি বজায় রাখে। তবে আমাদের এই পাড়াতে আমরা হিন্দু আর মুসলমান সবাই একসঙ্গেই থাকি বহু যুগ ধরে। পাড়ায় একটা মন্দির আছে প্রায় দেড়শা বছরের পুরনো, আবার মসজিদও আছে। বাইরে যা হয় হোক, আমাদের পাড়ায় কেউ ঝামেলা করতে পারে না।

জুলফিকার আলি দেখাচ্ছিলেন বহু যুগ ধরে মহুয়াডাঙ্গা এলাকায় কীভাবে হিন্দু আর মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ পাশাপাশিই বাস করছেন।

আরেক বাসিন্দু কুন্দন যাদব দুধ বিক্রি করেন। তিনি বলছিলেন, খালাসী মহল্লা, মুসদ্দি মহল্লা – সব জায়গাতেই দুধ দিতে গেছি। মঙ্গলবার দাঙ্গা বাধার পরেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিল অনেকেই, বিশেষ করে কমবয়সী ছেলেরা। কিন্তু তারপরে তারাও নিশ্চিন্ত হয়েছে যে অন্য যেখানে যাই হোক না কেন.. আমাদের পাড়ায় কোনও গণ্ডগোল হবে না। তাই এলাকা ছেড়ে কেউ যায়ও নি।

মুহম্মদ ফারহাদ মালিক বলছিলেন, ইমাম সাহেব যা বললেন, তারপরে সবাই বুঝেছে যে বাইরে থেকে এসে কেউ কেউ রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য অশান্তি ছড়াচ্ছে, উস্কানি দিচ্ছে। আমরা কেন তার মধ্যে জড়াব?

শুধু ফরহাদ মালিক নয়, মহুয়াডাঙ্গাল এলাকার বাসিন্দা খোশনূর আদাব, সিদ্ধার্থ বিশ্বকর্মা, পি এন শর্মা আর মুহম্মদ শামসুল আলমেরও একই কথা। রাজনীতি করার জন্য বাইরে থেকে লোক এসে দাঙ্গা বাধাবে কেউ, এ মেনে নেওয়া যায় না। সূত্র: বিবিসি।

এস/