মাগুরায় আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের সহায়তায় স্বাবলম্বী আমিরুল ও দুর্গারানী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার ‘আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের’ সহয়তায় নিজের বাড়িতে খামার গড়ে তুলে স্বাবলম্বী হয়েছেন মাগুরা জেলার সদর উপজেলার বেলনগর পূর্বপাড়া গ্রামের তোজাম্মেল হোসেনের ছেলে আমিরুল ইসলাম (৪০) ও আনন্দনগর গ্রামের দুর্গা রানী বিশ্বাস(৪০)। আমিরুল ইসলাম থাকার ঘর বাদে পুরো বাড়ি ঘিরেই গড়ে তুলেছেন একটি পূর্ণাঙ্গ খামার। আমিরুল ইসলাম জানান, তার বাড়িতে ৫০ শতক জায়গার মধ্যে ৩ শতক জমিতে বসবাসের জন্য ঘর নির্মাণ করেছেন। বাকি ৪৭ শতক জমিতেই ‘আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের আওতায়’ খামার গড়ে তুলেছেন। ২০১২ সালে ‘প্রযুক্তি ভিত্তিক কাজ করি স্বনির্ভর দেশ গড়ি’ নিজের এ স্লোগান নিয়ে সীমিত আকারে খামার তৈরির কাজ শুরু করেন। কিন্ত আর্থিক সমস্যার কারণে খামার এগিয়ে নিতে অসুবিধা হচ্ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে তিনি এ প্রকল্পের সমিতির সদস্য হওয়ায় সে অসুবিধা দূর হয়। ওই বছর তিনি সমিতি থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে খামারের পরিধি বাড়াতে শুরু করেন। এরপর সমিতি থেকে ২০১৯ সালে ২০ হাজার টাকা ও ২০২০ সালে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে খামারের ব্যাপকতা বাড়িয়ে সফলভাবে খামার পরিচালনার পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। বর্তমানে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে ২০০ টাকা জমা দিয়ে ৫ হাজার টাকা সঞ্চয় জমা করেছেন। এর পাশপাশি নিয়মিত ঋণ শোধ করছে।

সরেজমিন আমিরুল ইসলামের খামার ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে তার খামারে দেশী মুরগীর বাচ্চা উৎপাদনের জন্য ছোট একটি হ্যাচারি রয়েছে। যেখানে প্রতি মাসে ৩০০টি বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে। প্রতিটি বাচ্চা তিন বিক্রি করছেন ৩৫ টাকায়। এছাড়া তার বাড়িতে রয়েছে দুইটি দেশি মুরগীর খামার। যেখানে ছোট,বড় ও মাজারি মিলিয়ে প্রায় ৪০০ মুরগী রয়েছে। প্রতি কেজি মুরগী বিক্রি করছেন ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা দরে। সব খরচ বাদে প্রতি মাসে মুরগী বিক্রি করে তার লাভ থাকে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এছাড়া মুরগীর খামারের পাশে ৭ শতক জমিতে পুকুর কেটে বিভিন্ন জাতের মাছের চাষের পাশপাশি ১ শতক জমিতে মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছের চাষ করছেন। বাড়ির বাকি জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফলদ ও বনজ গাছ লাগিয়েছেন। এছাড়া বাড়ির অবশিষ্ট জমিতে স্বল্প পরিসরে বেড তৈরি করে বাঁধাকপি, লালশাক, পালনশাক,পেঁয়াজ , রসুন, লাউ, করলা উচ্ছে, হলুদ, সরিষা, ভুট্টাসহ বিভিন্ন ধরণের সবজি ও ফসলের চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। মাছের পুকুর ও ফসলী জমিতে সেচের জন্য বাড়িতে রয়েছে সেচ পাম্প। উৎপাদিত মাছ ও ফসল বিক্রি করে খরচ বাদে প্রতি মাসে আমিরুলের লাভ থাকে প্রায় ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে খামার থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা আয় করছেন তিনি। বাসস প্রতিনিধির সাথে আলাপ কালে তিনি জানান, পরিবারের ৯ ভাই বোনের মধ্যে তিনি অষ্টম। ২০১২ সালে বিএ পাসের পর কিছু দিন একটি ওষুধ কম্পানীতে চাকুরী করেছেন। কিন্তু চাকুরী ভালো না লাগায় তিনি নিজ বাড়িতে খামার গড়ার সিন্ধান্ত নেন। ২০১৮ সালে আমার ‘বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের সমিতির সদস্য হয়ে একটি পরিপূর্ণ খামার গড়ে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তার এ কাজে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা নিয়মিত সহযোগিতা করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেয়া বিশেষ উদ্যোগ ‘আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প’ চালুর জন্য প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমিরুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উপহার আমার ‘বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের’ ঋণ নিয়ে এর সঠিক ব্যবহার করে সাফল্য পেয়েছি। আমার সফলতার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। বর্তমানে তিনি স্ত্রী জামিলা পারভীন, ছেলে সাইফ (৮) ও মেয়ে ফাতিমা (৪) কে নিয়ে সুখে আছেন।

অপর দিকে জেলার শ্রীপুর উপজেলার দারিয়াপুর ইউনিয়নের আনন্দনগর গ্রামের দুর্গা রানী বিশ্বাস (৪০) জানান, আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের আওতায় সমিতির সদস্য হিসেবে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আয়বর্ধকমূলক কাজে ব্যবহার করে স্ববলম্বী হচ্ছেন। সমিতিতে ২০০ টাকা হারে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার টাকা সঞ্চয় জমা হয়েছে তার। ২০১৮ সালে সমিতি থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নেন। যা দিয়ে তার বাড়িতে থাকা একটি গাভী পালনের কাজে খরচ করেন। ২০১৯ সালের শেষের দিকে তার গাভীটি থেকে একটি বাছুর হয়েছে। গাভীটি প্রতি দিন প্রায় ২ কোজি দুধ দিচ্ছে। যার কিছু অংশ বিক্রির পাশাপাশি বাকি দুধ পরিবারের পুষ্টি চাহিদা মেটাচ্ছে। দুর্গা রাণীর স্বামী বিশ্বজিৎ বিশ্বাস পেশায় একজন মৎস্যজীবী। ২০১৯ সালে সমিতি থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তার স্বামীর মাছের ব্যবসায় কাজে লাগানোর পাশাপাশি বাড়ির পাশে ৬০ শতক জমি লিজ নিয়ে ধান,গম পেঁয়াজসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদনে কাজে লাগিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। দূর্গা রাণী আরো বলেন, ‘আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ির আয়বর্ধক কাজে ব্যবহার করায় তার পরিবার এখন অনেকটাই সুখের মুখ দেখেছে। এ জন্য আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ। দুর্গা রাণী বর্তমানে স্বামী, দুই ছেলে ভবেশ (১৪), প্রতাপ(১০) ও মেয়ে সুদিপ্তা(৮) নিয়ে ভালো আছেন। এ বছর প্রকল্প থেকে ঋণ নিয়ে গরুর খামার সম্প্রসারণের পাশপাশি আয় আরো বাড়াতে চান তিনি। জেলা পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) সূত্রে জানা গেছে, এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হচ্ছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি বিশেষ উদ্যোগের মধ্যে অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প হিসেবে ২০০৯ সালে জুন মাস থেকে আমার বাড়ি আমার খামর প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দরিদ্র মানুষের অংশ গ্রহণে সরকারি সহায়তায় স্থায়ী তহবিল গঠন, তহবিলের ঘুর্ণায়মান বিনিয়োগের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের বসতভিটায় আয়বর্ধক কৃষি খামার স্থাপন, আয় বৃদ্ধি ও টেকসই দরিদ্র বিমোচন। এ প্রকল্পের জেলা সমন্বয় কমিটির প্রধান হিসেবে জেলা প্রশাসক, উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন। জেলা পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের উপ-পরিচালক শাহানারা বেগম জানান, প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার উপহার ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের আওতায় খামার সমিতি ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের প্রতিটি দরিদ্র সদস্যদের বাড়িকে খামারে পরিণত করে টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে দেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

তাদের দেয়া তথ্য মতে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের আওতায় মাগুরা সদর উপজেলার বেলনগর গ্রামের আমিরুল ইসলাম ও শ্রীপুর উপজেলার আনন্দনগর গ্রামের দুর্গা রাণী বিশ্বাসের মত প্রকল্পের উপকারভোগী ৪৩ হাজার ২৮৭ দরিদ্র পরিবার স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য সচেষ্ট রয়েছেন। এসব উপকারভাগী সদস্যদের ঋণ দানের পাশাপাশি আত্মকর্মসংস্থানের জন্য হাঁস মুরগী পালন, গরু মোটাতাজাকরণ,গাভী পালন, মৎস্য চাষসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের জেলা সমন্বয়কারী আসীম কুমার সিংহ জানান, প্রধানমন্ত্রী বিশেষ উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম অগ্রাধিকার প্রকল্প ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের আওতায় জেলায় ৪৩ হাজার ২৮৭ জন দরিদ্র উপকারভোগী সদস্য রয়েছেন। মাগুরার ১টি পৌরসভাসহ ৩৬টি ইউনিয়নে ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত ১ হাজার ৯৪টি সমিতির আওতায় উল্লেখিত দরিদ্র পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭৯ কোটি ৬৮ লাখ ৬ হাজার ৪৮০টাকার ঋণ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া জেলাকে ভিক্ষুক মুক্ত করার লক্ষ্যে তাদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য এ প্রকল্প থেকে ঋণ দেয়া হচ্ছে। সুবিধাভোগী সদস্যদের প্রত্যেকে মাসিক ২০০ টাকা হারে প্রায় ১৫ কোটি ২ লাখ ৬৬ হাজার ৪৫৫ টাকা টাকা সঞ্চয় জমা করেছেন। সমিতির তহবিল গঠন করা হয়েছে ৬০ কোটি ২৪ লাখ ৮৭ হাজার ৪৪ টাকা। মাগুরা জেলা প্রশাসক ড.আশরাফুল আলম জানান, আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি অগ্রাধিকারমূলক কর্মসূচি। সুষ্ঠুভাবে এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার পাশাপাশি দেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে। খবর-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান