মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ

আহমেদ রশীদ:
দশ বছরে উৎপাদন ৫৩ শতাংশ, রপ্তানি ১৩৫ গুণ বেড়েছে। মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদন কমছে । বিগত ৫ বছরে নতুন ৫৫০টি অভয়াশ্রম তৈরি মাছ উৎপাদন করে বিশ্বে বিপ্লব করেই চলেছে বাংলাদেশ। বিগত ১২ বছর ধরেই বিশ্বে এ খাতে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। আর সমুদ্রে মাছ আহরণের দিক থেকে পঁচিশতম। দশ বছরে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ৫৩ শতাংশ এবং রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে ১৩৫ গুণ। দেশে মাথাপিচু মাছ খাওয়ার পরিমাণও বেড়ে হয়েছে শতভাগ। এমনই তথ্য প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ‘এফএও’। তবে বদ্ধ জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বাড়লেও মুক্তভাবে মাছ উৎপাদন কমছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ‘এফএও’ বিশ্বের মাছ চাষ পরিস্থিতি নিয়ে ‘দ্য স্টেট অফ ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড এক্যুয়াকালচার’ নামে একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে ধারাবাহিকভাবেই এক যুগ ধরে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ পাঁচে। প্রতিবেদনটিতে পুকুর ও জলাশয়ে মাছ চাষের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মৎস্যজীবীদের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে মাছ চাষ করে সাফল্য উদাহরণ আকারে তুলে ধরা হয়েছে। মাছ উৎপাদনের ধারাবাহিকতা চতুর্থ হওয়ায় বিশ্ব দরবারে অতি প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখে চলেছে বাংলাদেশ। আর বাকি শীর্ষ তিন দেশ হলো চীন, ভারত ও মায়ানমার। যদিও ২০০৬ সালে ভারতকে টপকে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছিল বাংলাদেশ।

দেশে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ২৭ দশমিক ০১ লাখ মেট্রিক টন। পরবর্তীতে মৎস্যবান্ধব কার্যক্রম, চাষি ও উদ্যোক্তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণের ফলে ২০১২-১৩ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ ১০ মেট্রিক টন। যদিও দেশে মাছের চাহিদা ৩৭ লাখ ৯২ হাজার মেট্রিক টন। চাহিদার অনুপাতে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে উৎপাদন প্রায় ৩৫ লাখ মেট্রিক টন অর্জিত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে মৎস্য অধিদফতর। শুধুমাত্র বিদায়ী অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে ৩ লাখ ৮৫ মেট্রিক টন। যা এক দশক আগেও উৎপাদন কমে ২০০২-০৩ অর্থবছরে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩২ টনে নেমে আসে। এরপর মা-ইলিশ রক্ষা কর্মসূচি সরকার বিশেষভাবে নজর দিলে উৎপাদন বাড়তে থাকে। এর ফলে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ২ লাখ ৯৮ হাজার ৯২১ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। যা পর্যায়ক্রমে বেড়ে চলেছে। এতে ২০০৪-২০১৪ সালে অর্থ্যাৎ এক দশকে বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ৫৩ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে ২০২০-২১ অর্থবছরের মধ্যে প্রায় সব মিলিয়ে ৪৫ দশমিক ৫২ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন সম্ভব বলে ধারণা করা হচ্ছে।

একই বিষয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারি অনুযায়ী চাষ করা মাছের পরিমাণ তিন দশকে তিন রকম। এর মধ্যে ১৯৯০ সালে ছিল যা ১ লাখ ৯৩ হাজার টন। ২০০০ সালে ছিল ৬ লাখ ৫৭ হাজার টন। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ টন। এসব উৎপাদন মূলত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের নদী, সুন্দরবন, কাপ্তাই লেক, বিল ও প্লাবন ভূমি এবং বদ্ধ জলাশয়ের মধ্যে পুকুর, মৌসুমি চাষকৃত জলাশয়, বাওড় ও চিংড়ি ঘের থেকে উৎপাদিত হয়ে থাকে।

তবে চাষকৃত মাছের উৎপাদন বাড়লেও কমেছে উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছের উৎপাদন। মৎস্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী ১৯৮৩-৮৪ সালে এ খাতে উন্মুক্ত জলাশয়ের অবদান ৬৩ শতাংশ থাকলেও ২০১২-১৩ সালে এ খাতের অংশ দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৮ শতাংশে। মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদন কমে যাওয়ার একমাত্র কারণ হিসেবে বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতার কারণে নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাওড়ের পানির আয়তন কমে যাওয়াকে এর কারণ বলছেন মৎস্য অধিদফতর উৎপাদন বিভাগের মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোহাম্মাদ কামরুজ্জামান হোসাইন।
তিনি বলেন, বিভিন্ন এলাকায় জোর-দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর তদারকিও অনেকটাই ঢিলেঢালা। তবে মুক্ত জলাশয়ের আয়তন কমে এলেও সেসব এলাকায় বিভিন্নভাবে চাষাবাদ করে মাছেন উৎপাদন বৃদ্ধির কাজ অব্যাহত রাখা হয়েছে, বলেন এই কর্মকর্তা।

উৎপাদন বৃদ্ধিতে নানামুখী কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে পোনা অবমুক্তকরণ, বিল নার্সারি স্থাপন ও মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন। পরিসংখানে দেখা যায়, উন্মুক্ত জলাশয়ে পোনা অবমুক্তকরণের ফলে বিগত ২০০৯-১০ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট ৭১৫টি বিল নার্সারি স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে বিদায় অর্থবছরেই স্থাপন করা হয়েছে ২০৬টি। এর মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার মেট্রিক টন অতিরিক্ত মাছ উৎপাদন হচ্ছে এবং এসবে অনেক বিপন্নপ্রায় মাছের আবির্ভাব ঘটেছে। এছাড়া বিগত ৫ বছরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন নদ-নদী ও অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে ৫৩৪টি অভয়াশ্রমসহ দেশব্যাপী প্রায় ৫৫০টি অভয়াশ্রম স্থানীয়ভাবে পরিচালতি হচ্ছে। এসব অভয়াশ্রমে চিতল, ফলি, বামোস, কালিবাউস, আইড়, টেংরা, মেনি, রাণী, সরপুটি, মধু পাবদা, রিটা, গজারসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।

উৎপাদনের পাশাপাশি মাছের রপ্তানির পরিমাণও বেড়েছে ১৩৫ গুণ। ২০০৩-০৪ সালে প্রায় ৫৪ হাজার মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে প্রায় ২ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা আয় করা হয়। যা ১০ বছরের ব্যবধানে ২০১৩-১৪ সালে বাংলাদেশের হিমায়িত মৎস্য রপ্তানির পরিমাণ ১৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেড়ে প্রায় ৪ হাজার ৩১২ কোটিতে দাঁড়ায়।

যোগাযোগ করা হলে মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ সংবাদকে বলেন, উৎপাদনে সফলতার একটি বড় অংশ হলো ইলিশ। ২০১১ সালেও আগেও আমাদের জানা ছিল না যে মা ইলিশ কোন সময়টিতে ডিম ছাড়ে। এ বিষয়ে ৪ থেকে ৫ বছর আমরা গবেষণা করেছি। বিশেষজ্ঞসহ ইলিশ উৎপাদনের বিভিন্ন এলাকার মানুষ, জেলে এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কয়েকদফা মিটিং করেছি। তারপর স্বচ্ছ ধারণা আসার পর আমরা এ বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নেই। এরফলে এক দশকেই প্রায় তিনগুন ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এছাড়া চাষকৃত মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে তেলাপিয়া, পাঙ্গাশ ও কই এই তিন শ্রেণীর মাছ বেশি উৎপাদন করা হচ্ছে। তবে সরকার, সাধারণ মাছচাষি ও ব্যবসায়ীসহ দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো সার্বিকভাবে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের জন্যই এই সফলতা অর্জন সম্ভভ হয়েছে।

এদিকে মাছের দাম সাধারণ ক্রেতাদের সামর্থ্যরে মধ্যে থাকায় গত ১০ বছরে দেশে মাথাপিচু মাছ খাওয়ার পরিমাণও শতভাগ বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মৎস্য খাতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি কৃষির অন্য উপখাত শস্য, প্রাণিসম্পদ ও বনের তুলনায় অনেক বেশি। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বিধানেও মৎস্য খাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় প্রায় ৬০ শতাংশ প্রাণিজ আমিষের চাহিদার যোগান দেয় মাছ। এফএও-এর জরিপেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের ৫৭ শতাংশ শুধু মাছ থেকেই মেটানো হয়।

সংস্থাটির ওই জরিপে আরও বলা হয়, বিশ্বে মাথাপিচু মাছ খাওয়ার পরিমাণ ২২ দশমিক ৪ কেজি। আর বাংলাদেশের একজন মানুষ বছরে মাছ খায় প্রায় ১২ কেজি। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মাছ খায় চট্টগ্রামের লোকেরা। যা বছরে প্রায় ১৭ কেজি। সবচেয়ে কম মাছ খায় রংপুরের লোকেরা, বছরে প্রায় সাড়ে ৭ কেজি।

বর্তমানে বিশ্ববাজারে মাছের চাহিদা বিভিন্নভাবে প্রসার লাভ করছে। এর বড় কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, স্বাভাবিকভাবে মাছ খাওয়ার পাশাপাশি মাছ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য সামগ্রী, গ্লাটিন, সস এবং মাছের উচ্ছিষ্ট অংশ দিয়ে বায়োগ্যাস, ডাইটেটিক সামগ্রী, মেকআপ, পিটফুড ও সার তৈরি করা হচ্ছে। এর ফলে ব্যাপকহারে চাহিদা বাড়ছে।

আজকের বাজার: আরআর/ ২৭ আগস্ট ২০১৭