রংপুরের গঙ্গাচড়া থানার আলমবিদিতর গ্রামের আয়েশা বেগম (২৭) নয় মাসের গর্ভবতী ছিলেন। একদিন হঠাৎ তার পেটব্যাথ্যা শুরু হয়। আয়েশা ভাবেন, তার প্রসববেদনা উঠেছে। তিনি বাড়িতে থাকেন এবং স্থানীয় দাই ডেকে কাঙ্খিত সময়ের জন্য অপেক্ষা করেন। কিছুক্ষণ পর তার যখন প্রচুর পরিমাণে রক্তক্ষরণ শুরু হয় তখন তিনি বুঝতে পারেন না কি করবেন। তখন পরিবার এবং দাই কেউই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি এবং তাকে তারা হাসপাতালে নেননি। শেষ পর্যন্ত অবস্থা অনেক খারাপ হলে তাতে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেয়া হয়। তখন আয়েশা অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল এবং সে মারা যায়। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক বলেন, ‘রক্তক্ষরণের সাথে সাথে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আয়েশাকে নিয়ে গেলে বাঁচানো সম্ভব হতো। কেননা এ ধরনের সমস্যায় কী করতে হবে তা চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া রয়েছে। তারা এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেন।’
চিকিৎসকরা বলছেন, এ রকম নানা জটিলতায় প্রসবকালীন সময় এবং এর পরবর্তীতে অনেক নারী মারা যাচ্ছে। সাধারণ কিছু সচেতনতা থাকলে মায়েরা এ ধরনের অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেতে পারেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং সেন্ট্রাল হাসপাতালের বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফারহানা দেওয়ান বলেন, ‘মূলত দুটি কারনে মায়েরা মারা যান। প্রসবকালীন বা প্রসব পরবর্তী সময়ে সাধারণত খিঁচুনী এবং রক্তক্ষরণে বেশি মা মারা যায়। খিঁচুনি অনেক সময় ডেলিভারির আগে হতে পারে এবং পরেও হতে পারে। এজন্য গর্ভকালীন চেকআপ জরুরি। চেকআপের মাধ্যমে জানা যায় তার এ ধরনের সমস্যা হতে পারে কিনা এবং সেভাবে তাকে ওষুধ দেয়া হয় কিংবা নিয়মকানুন জানিয়ে দেয়া হয়। খিঁচুনির সম্ভাবনা যার থাকে অবশ্যই তার ডেলিভারি হাসপাতালে করানো প্রয়োজন। কেননা তার মৃত্যু ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।’
তিনি আরো বলেন, ‘রক্তক্ষরণ গর্ভকালীন সময়ে হতে পারে বা প্রসবকালীন সময় বা তার পরেও হতে পারে। এজন্য বাড়িতে প্রসবের চেষ্টা না করে হাসপাতালে যেতে হবে। কেননা হাসপাতালে যখন চিকিৎসকরা ডেলিভারি করান তখন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। আমরা ডেলিভারির আগে একটা ইনজেকশন দেই যাতে রক্তক্ষরণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু বাড়িতে দক্ষ বা অদক্ষ দাই তা জানে না।’ তবে পরিস্থিতি যাই হোক মায়ের খিঁচুনি বা রক্তক্ষরণ দেখা দেয়ার সাথে সাথেই তাকে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গেলে বাঁচানো সম্ভব বলে তিনি জানান।
ইউনিসেফ-এর এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজার ২০০ নারীর মৃত্যু হয় গর্ভকালীন, প্রসবকালীন এবং সন্তান জন্মের পর সৃষ্ট জটিলতায়। অধিকাংশ মায়েরই মৃত্যু ঘটে কোনো চিকিৎসক বা দক্ষ ধাত্রী ছাড়া বাড়িতে সন্তান প্রসবের সময়। এছাড়া গর্ভধারণকালে নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী হাসপাতাল, ক্লিনিক ও স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে গিয়ে মাতৃত্বকালীন সেবা না নেওয়ার কারণেও অনেক মায়ের মৃত্যু হয়।
‘ইউনিসেফ’-এর কৈশর ও মাতৃস্বাস্থ্য বিষয়ক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু সাদত মো. সায়েম বলেন, ‘হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে একজন গর্ভবতী মা বা প্রসবকালীন মায়ের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও গ্রামাঞ্চলের অনেক নারী সেখানে যায় না বলে মার্তৃমৃত্যুর হার কমানো কষ্টসাধ্য থাকছে।’
সরকার এ বিষয়ে সচেতন এবং নানাভাবে কাজ করছে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘মাতৃস্বাস্থ্য কর্মসূচি’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আজিজুল আলীম। তিনি বলেন, ‘মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে সরকার স্বাস্থ্যকর্মী এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সরকারের এ ধরনের সেবা রয়েছে। এজন্য মানুষকে সচেতন হতে হবে এবং বাড়িতে ডেলিভারি না করে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হবে। কেননা সেখানে সব ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা কয়েকটি সহযোগি পার্টনারের সাথেও কাজ করছি। তারা আমাদের কর্মীদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয় এবং গবেষণার কাজগুলো করে। যেমন, কোনো মা প্রসবকালীন সময়ে মারা গেলে কেনো তিনি মারা গেলেন সে বিষয়ে বিস্তারিত জেনে তারা রিপোর্ট তৈরি করেন। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে আমরা নানা পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। কাজেই সরকার মাতৃমৃত্যুর হার কমানোর জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক এবং বাস্তবসন্মতভাবে আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে। এছাড়াও সরকার দরিদ্র ও দুস্থ্য মায়েরা যাতে গর্ভকালীন সময়ে ঠিকভাবে খেতে পারেন বা সেবা নিতে পারেন এজন্য ৫৬টি জেলায় প্রসবকালীন ভাতা দিচ্ছে।’
মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে গর্ভকালীন সময় থেকে শুরু করে শিশু জন্মের কয়েক মাস পর্যন্ত একজন মাকে নিয়ম মেনে চলার পাশাপাশি হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে এমনই বলছেন সংশ্লিষ্টজন। খবর-বাসস
আজকের বাজার/আখনূর রহমান