মাদারীপুরে অনলাইনে কাজীর ভাত বিক্রি করে সাবলম্বী বলাকা

জেলায় অনলাইনে কাজীর ভাত বিক্রি করে সাবলম্বী বলাকা।কাজীর ভাত মাদারীপুর অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহি খাবার। তবে এখন অধিকাংশ বাসা বাড়িতে কাজীর ভাত রান্না হয় না। কাজীর ভাতে টক স্বাদ ও টক গন্ধ বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছে অপছন্দের হলেও মহিলাদের কাছে অনেক প্রিয় কাজীর ভাত।

বর্তমানে শহুরে জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খাবার কাজীর ভাত। কাজীর ভাত রান্নার প্রক্রিয়া তুলনা মূলক কঠিন এবং ঝামেলাপূর্ন। তাই অনেকের ইচ্ছে করলেও এই খাবার খেতে পারেন না। হোটেল -রেস্তরাগুলোতেও বিক্রি হয় না কাজীর ভাত। তবে সেই ঐতিহ্যবাহী খাবার অনলাইনে বিক্রি করে বলাকা মাসে আয় করেন অর্ধলাখ টাকা।

জেলা শহরের কুকরাইল এলাকার আ. গফুর বেপারীর মেয়ে রেবেকা সুলতানা বলাকা (৪০)। আট ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। খুব ডানপিটে স্বভাবের বলাকার ছোটবেলা থেকেই রান্নার শখ ছিল।

ছোটবেলা থেকেই রান্নার প্রতি আগ্রহ ছিল তার । আত্মীয়-স্বজন বা প্রতিবেশীদের কোনো অনুষ্ঠান হলে নিজ উদ্যোগেই ছুটে গিয়ে রান্না করতেন। সেই শখের রান্নাই একদিন আয়ের মাধ্যম হবে তা কোনোদিন ভাবেননি তিনি। একটি এনজিওতে চাকরি করতেন স্বামী এস এম বিপু হক। হঠাৎ করে চাকুরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েন স্বামী। তখন ২০২০ সালে মাদারীপুরের আছমত আলী খান সেন্ট্রাল হাসপাতালের স্টোর কিপারের চাকরি নেন বলাকা। কিন্তু এই চাকরিতে তিন ছেলের পড়াশুনাসহ সংসারের খরচ যোগানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। বড় ছেলে ফারদিন হক গণবিশ্ববিদ্যালয়ে বয়োমেডিকেল ইনঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ছে। মেঝ ছেলে ঢাকার নটরডেম কলেজে পড়ে। ছোট দুই ছেলে মাদারীপুরের ইউ আই স্কুল এসএসসি পরীক্ষার্থী।

এক সময় সহকর্মীদের পরামর্শে একটি ফেসবুক পেইজ খুলেন। ‘বলাকাস ফুড কর্নার’ নামে সেই পেইজে প্রথমে খিচুড়ি, ডিম ও ভর্তার ছবি তুলে পোস্ট করেন। সেইদিন মাত্র ৯০ টাকায় বিক্রি হয় সেই খাবার। এরপর আস্তে আস্তে নানা ধরনের খাবারের ছবি ও ভিডিও পোস্ট দেওয়া শুরু করেন। সাড়াও পেতে থাকেন। এর মধ্যে বেশি সাড়া পান ঐতিহ্যবাহি কাজীর ভাতের। ঘরোয়া পরিবেশে মজাদার বিভিন্ন খাবার পেয়ে দিন দিন তার জনপ্রিয়তা বাড়ে। বর্তমানে প্রতিমাসে ৫৫ হাজার থেকে ৮০হাজার টাকার খাবার বিক্রি করছেন রন্ধনশিল্পী বলাকা। একজন সহযোগী নিয়ে তিনি একাই সব রান্না করেন। রেবেকা সুলতানা বলাকা বলেন, কখনো ভাবিনি এভাবে রান্না দিয়ে আয় করতে পারবো। আমি প্রায়ই আমার অফিসের স্টাফদের জন্য বিভিন্ন আইটেম রান্না করে নিয়ে যেতাম। তারা খেয়ে খুব প্রশংসা করতেন। তাই আমার অফিসের ম্যানজার ম্যাম ও কম্পিউটার সেকশনে কাজ করা আমার সহকর্মীর আগ্রহে অনলাইনে পেইজ খুলে বিভিন্ন আইটেম পোস্ট করা শুরু করি। প্রথম দিন মাত্র ৯০ টাকায় বিক্রি শুরু হলেও এখন মাসে ৫৫ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকার বেশি বিক্রি করছি। এই কাজে আমার স্বামী ও ছেলেরা আমাকে খুব সহযোগিতা করছে। তিনি আরও বলেন, কাজীর ভাতের অনেক চাহিদা। কাজীর ভাত আমাদের মাদারীপুরের ঐতিহ্যবাহি খাবার। ঐতিহ্যবাহী কাজীর ভাত সঙ্গে নানা রকমের ভর্তা, ইলিশ মাছ ও পুঁটি মাছ ভাজা সবাই খুব পছন্দ করে। তাছাড়া বিরিয়ানি, পোলাও, সাদা ভাত, নানা প্রকারের মাছ, মাংস, শাক-সবজি, পিঠা, পায়েস, সেমাই, জর্দা, পুডিং, হালুয়া, আচারসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার আমি রান্না করে থাকি। গ্রাহকরা চাহিদা অনুযায়ী আগে থেকেই অর্ডার দিয়ে থাকেন। সেই অনুযায়ী রান্না করা হয়। নিয়মিতভাবে আছমত আলী খান সেন্ট্রাল হাসপাতাল, মাদারীপুর সদর হাসপাতালের ডাক্তার ও স্টাফরা আমার কাছ থেকে খাবার নিয়ে থাকেন।

পাশাপাশি বিভিন্ন ঘরোয়া অনুষ্ঠানেও খাবারের অর্ডার থাকে।

অনেকেই অতিথি এলে বা কাজের চাপে রান্না না করতে পারলে পুরো পরিবারের জন্য খাবার অর্ডার দেন। আসলে পরিচিতি যত বাড়ছে, ততোই আমার রান্না খাবারের অর্ডার বাড়ছে। এই কাজকে আমি অনেক দূর নিয়ে যেতে চাই। নিয়মিত গ্রাহক আছমত আলী খান সেন্ট্রাল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. দিলরুবা ফেরদৌস বলেন, আমি নিয়মিত বলাকার রান্না খেয়ে থাকি। ওর রান্না খুব মজা ও স্বাস্থ্যসম্মত। তাই ঢাকা থেকে এসে মাদারীপুরে যে কদিন থাকি বলাকাকে আগে থেকে কী খাবো বলে রাখি। ও তাই রান্না করে নিয়ে আসে।

জেলার সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ওয়াদিয়া শাবাব বলেন, বলাকা নিজের চেষ্টায় আজ প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন। নারীরা ঘরে বসেও আয় করতে পারেন, তার উদাহরণ বলাকা। উদ্যোক্তা বলাকা আরও এগিয়ে যাক, তাকে দেখে আরও নারী এভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবে। সমাজে সে দৃষ্টান্ত। (বাসস)